1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

আদিবাসী হওয়ায় কুৎসার মুখে কৃতী অধ্যাপিকা

পায়েল সামন্ত কলকাতা
১২ সেপ্টেম্বর ২০২০

একুশ শতকের ভারতে ব্রাহ্মণ্যবাদের স্বর আরো জোরালো৷ আদিবাসী হওয়ার জন্য এক অধ্যাপিকাকে সোশ্যাল মিডিয়ায় হেনস্থা করা হচ্ছে৷ জাতিবিদ্বেষী কোনো দল বা গোষ্ঠী নয়, এই আক্রমণের পুরোভাগে রয়েছেন কলকাতার অগ্রণী কলেজের পড়ুয়ারা৷

https://p.dw.com/p/3iMyB
Indien Eingang zur Jadavpur Universität in Kalkutta
ছবি: DW/P. Samanta

বিশ্বজুড়ে উগ্র জাতীয়তাবাদের ঢেউ দেখা যাচ্ছে গত কয়েক বছরে৷ কোথাও আঙুল কালোর দিকে৷ কোথাও নিশানায় ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা৷ কেউ আবার জাতিভেদের শিকার৷ রামমোহন রায় কিংবা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর যে জাতির আলোকবর্তিকা হয়ে পথ দেখিয়েছেন, তার ছাত্রসমাজে এখনো কট্টর ব্রাহ্মণ্যবাদী মানসিকতার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে৷ জন্মপরিচয়ে আদিবাসী হওয়ার জন্য ছাত্রসমাজের তীব্র কটাক্ষের শিকার হয়েছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপিকা মেরুনা মুর্মু৷ একটি ফেসবুক পোস্ট করে তিনি ‘ট্রোল' বা সংঘবদ্ধ কুৎসার মুখে পড়েছেন৷ কী লিখেছিলেন মেরুনা? তিনি লিখেছিলেন, করোনা পরিস্থিতিতে পরীক্ষা নিয়ে ব্যগ্রতার প্রয়োজন নেই৷ জীবনের দাম সবচেয়ে বেশি৷

এই বক্তব্যের কোথাও বিতর্কের ছিটেফোঁটা গন্ধ না থাকলেও ফেসবুকে জাতিবিদ্বেষমূলক মন্তব্যের মুখে পড়েন অধ্যাপিকা৷ এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে তাঁর বিরুদ্ধে নানা কটুবাক্য লেখা হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ায়৷ সবচেয়ে আশ্চর্যের, ব্রাহ্মণ্যবাদী কোনো গোষ্ঠী নয়, এই আক্রমণের সূচনা করেছেন কলকাতার অগ্রণী কলেজের এক ছাত্রী৷ বেথুন কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী লেখেন, ‘‘এ ধরনের ভাবনাচিন্তা যাঁরা কোটা, সংরক্ষণ নিয়ে ভাবেন, তাঁদের মাথা থেকে আসতে পারে৷'' একইসঙ্গে তিনি লেখেন, ‘‘মেরুনা মুর্মু আদিবাসী হওয়ায় পড়াশোনা চাকরির ক্ষেত্রে নানা সুযোগ-সুবিধা লাভ করেছেন৷''

প্রেসিডেন্সি কলেজ ও দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী মেরুনা এর তীব্র প্রতিবাদ করেন৷ তাঁর পাশে দাঁড়ায় ছাত্রসমাজের বড় অংশ৷ বিভিন্ন কলেজের শিক্ষকরাও মেরুনাকে সমর্থন জানান৷ কিন্তু তা সত্ত্বেও ‘ট্রোল' থামেনি, আজও চলছে৷ মেরুনা হিমশৈলের চূড়া মাত্র, তাঁকে উপলক্ষ করে ক্রমশ প্রকাশ্যে আসছে বাঙালিদের মধ্যে এখনও বেঁচে থাকা ব্রাহ্মণ্যবাদী পরম্পরার কদর্য রূপ৷

মেরুনা তাঁর লেখনীতে বরাবরই জাতিবিদ্বেষের বিরুদ্ধে সরব৷ তাই নেটিজেনদের একাংশের প্রবল আক্রমণকে অনেকে বিচ্ছিন্ন হিসেবে দেখছেন না, এর পিছনে সংঘবদ্ধ প্রয়াস থাকতেই পারে৷ কিন্তু তাতে ভারতের সাংস্কৃতিক রাজধানী কলকাতার ছাত্রসমাজ জড়িয়ে যাওয়ায় সকলেই ব্যথিত৷ সংরক্ষণ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে জোরালো মত থাকতেই পারে, কিন্তু তা ব্যক্ত করার এই পদ্ধতি বিস্মিত করেছে বিদগ্ধজনদের৷ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের চলচ্চিত্রবিদ্যার অধ্যাপক মানস ঘোষ বলেন, ‘মেরুনার বিরুদ্ধে আক্রমণ সংবিধান ও মানবতার বিরোধী৷ আমরা চেষ্টা করি জাতি-ধর্ম-লিঙ্গভেদের ঊর্ধ্বে একটা ক্যাম্পাস তৈরি করতে৷ শিক্ষককে কটাক্ষ করার এই চেষ্টা তার ১৮০ ডিগ্রি বিপরীতে৷'

‘ছাত্ররা বিদ্বেষ পোষণ করলে পরিণতি কী হবে তা ভেবে শিউরে উঠতে হয়’

একে ছাত্রসমাজের অবক্ষয় বলে তীব্র নিন্দা করেন প্রেসিডেন্সির প্রাক্তন অধ্যক্ষ, শিক্ষাবিদ অমল মুখোপাধ্যায়৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমাদের সাবেকি সমাজের যে মূল্যবোধ থেকে যে আমরা এখনো বেরিয়ে আসতে পারিনি, এই ঘটনা তার প্রমাণ৷ এখন বিয়ের ক্ষেত্রে জাতপাতের বাধা কমে এসেছে, তাহলে শিক্ষিকাকে নিশানা করা হচ্ছে কেন? ছাত্রসমাজের একাংশের আধুনিকতা শুধু বহিরঙ্গে, তাদের মধ্যে উদারনৈতিক ধ্যানধারণা গড়েই ওঠেনি৷''

ছাত্র-ছাত্রীদের একাংশ এর সঙ্গে রাজনীতির যোগও দেখছেন৷ যাদবপুরের স্নাতকোত্তরের পড়ুয়া, ছাত্র সংসদের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক দেবরাজ দেবনাথ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘কেন্দ্রের শাসক দল দেশজুড়ে বিদ্বেষের আবহ তৈরি করছে৷ এই মানসিকতাকে তার থেকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখলে হবে না৷ অতীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনেই অধ্যাপক আব্দুল কাফিকে আক্রমণ করা হয়েছে৷ মেরুনা ম্যাডামের বিরুদ্ধে ট্রোল-এর পিছনে একই বিদ্বেষ রয়েছে৷'' অমল মুখোপাধ্যায়ের মতে, ‘‘ঘৃণার বিরুদ্ধে ছাত্ররাই তো রুখে দাঁড়াবে৷ কিন্তু তারাই এমন বিদ্বেষ পোষণ করলে পরিণতি কী হবে তা ভেবে শিউরে উঠতে হয়৷''

উচ্চবর্ণের আস্ফালন সত্ত্বেও গত কয়েক দশকে ভারতে দলিত-আদিবাসীদের ক্ষমতায়ন হয়েছে যারা দীর্ঘকাল বঞ্চনার সুবাদে পিছিয়ে পড়েছে৷ সেটা এত সহজে বানচাল করা সম্ভব নয় বলে মনে করেন মানস ঘোষ৷ তাঁর বক্তব্য, ‘‘এটা ঠিকই, অবক্ষয়ের বীজটা রয়ে গিয়েছে যা এখনো আমরা উৎপাটন করতে পারিনি৷ কিন্তু মেরুনাকে যদি ১৮০০-১৯০০ জন ট্রোল করে থাকে, তাহলে তার কয়েকগুণ বেশি মানুষ তাঁকে সমর্থন করেছে৷ এটাই আমাদের শক্তির জায়গা৷''