রায়ের আগেই রায় নিয়ে বিতর্ক
৭ মার্চ ২০১৬২৪শে ফেব্রুয়ারি, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে শুনানির শেষ দিন, ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন এবং তদন্ত সংস্থার কাজ নিয়ে চরম অসন্তোষ প্রকাশ করেন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা৷ তিনি বলেন, ‘‘তাঁদের (প্রসিকিউটর ও তদন্ত সংস্থা) পেছনে সরকার যথেষ্ট অর্থ খরচ করছে৷ অথচ তাঁরা সঠিকভাবে মামলা তদন্ত ও পরিচালনা করছেন বলে মনে হয় না৷'' তাঁর কথায়, ‘‘যেসব প্রসিকিউটর অদক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন, তাঁদের সরিয়ে দেয়া উচিত৷''
পরে ঐ দিনই অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘মীর কাসেমের আপিল শুনানির সময় আপিল বিভাগে বেশ কিছু অসংগতি ধরা পড়ার ফলে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন ও তদন্ত সংস্থার ওপর আদালত গভীর অসন্তোষ প্রকাশ করেছে৷''
এরপর থেকেই এই মামলা নিয়ে কয়েকজন মন্ত্রীর প্রকাশ্য মন্তব্য এক নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি করে৷ খাদ্যমন্ত্রী এবং সাবেক আইন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম প্রকাশ্যে বলেন ‘‘এই মামলার রায় কী হবে, তা প্রধান বিচারপতির প্রকাশ্য আদালতে বক্তব্যের মধ্য দিয়ে আমরা অনুধাবন করতে পেরেছি৷ তাঁর বক্তব্যের মধ্যে এটা অনুধাবন করেছি যে, এই মামলায় আর মৃত্যুদণ্ডের রায় দেয়ার কোনো সুযোগ নেই৷'' তাই তিনি এই মামলার ফের শুনানি দাবি করেন৷
ওদিকে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম মন্ত্রীর ঐ বক্তব্যকে ‘অসংবিধানিক' আখ্যা দিয়ে বলেন, ‘‘প্রধান বিচারপতি কোনো ব্যক্তি নন, একটি প্রতিষ্ঠান৷ প্রধান বিচারপতিকে বিতর্কিত করা মানে, বিচারব্যবস্থাকে বিতর্কিত করা৷ তাই প্রধান বিচারপতি বা বিচারালয় নিয়ে বক্তব্য দেয়া থেকে বিরত থাকতে সকলের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি৷''
জানা গেছে, এই বিতর্কের পর সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মীর কাসেম আলীর মামলা নিয়ে মন্ত্রীদের প্রকাশ্য মন্তব্য করা নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করেন৷ শুধু তাই নয়, এ নিয়ে আর কোনো কথা না বলতেও নির্দেশ দেন তিনি৷
এই প্রেক্ষাপটে মানবতাবিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর রানা দাসগুপ্ত ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমার কাছে পুরো বিতর্কটিকে কোনোভাবেই শোভন মনে হয়নি৷ তবে আমি মনে করি যে, এতে মামলার রায়ে কোনো প্রভাব পড়বে না৷''
তিনি বলেন, ‘‘বিচারকরা স্বাধীন, তাঁরা স্বাধীনভাবেই সিদ্ধান্ত নেন৷ এছাডা় এই মামলার আপিল শুনানি করেছেন প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে চারজন বিচারপতি৷ আমার মতে, কোনো বিচারপতির ভিন্নমত থাকতেই পারে৷''
রানা দাসগুপ্ত আরো বলেন, ‘‘আমি মনে করি, প্রধান বিচারপতি তাঁর রায়ের মধ্যে দিয়েই কথা বলতে পারেন৷ তাই প্রকাশ্য আদালতে এমন কোনো মন্তব্য করা ঠিক নয় যা বিতর্কের সৃষ্টি করতে পারে৷ আর যাঁরা প্রধান বিচারপতির কথা নিয়ে বাইরে কথা বলেছেন, তাঁরাও ঠিক করেননি৷ আমার কাছে পুরো বিষয়টি অশোভন মনে হয়েছে৷ ভবিষ্যতে এ ধরনের বিতর্ক এড়িয়ে চলাই উচিত হবে৷''
২০১৪ সালের ২রা নভেম্বর মীর কাসেম আলীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালয়২৷ আটজনকে নির্যাতন করার পর হত্যা ও মরদেহ গুম করা এবং ২৪ জনকে অপহরণের পর চট্টগ্রামের বিভিন্ন নির্যাতন কেন্দ্রে আটকে রেখে নির্যাতনসহ মানবতাবিরোধী ১০টি অভিযোগে অভিযুক্ত হন তিনি৷ অভিযোগ, মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি জামায়াতের কিলিং স্কোয়াড আল-বদর বাহিনীর তৃতীয় শীর্ষ নেতা এবং সে সময়ের ইসলামি ছাত্র সংঘের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন৷
এই রায়ের বিরুদ্ধে গত ৯ই ফেব্রুয়ারি থেকে মীর কাসেমের আপিল মামলাটির শুনানি শুরু হয় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে৷ আপিল বিভাগ ২৪শে ফেব্রুয়ারি শুনানি শেষ করে ৮ই মার্চ (মঙ্গলবার) রায়ের দিন ধার্য করে৷
প্রসঙ্গত, আপিল বিভাগে যুদ্ধাপরাধ মামলায় এর আগের ছয়টি রায়ের মধ্যে চারটিতে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লা ও মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ এবং বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয়৷ ইতিমধ্যে এদের সকলেরই ফাঁসি কার্যকর হয়েছে৷
এছাড়া আপিল বিভাগের আরেক রায়ে জামায়াতের নায়েবে আমির মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে৷ সেই রায়ের ব্যাপারে দুই পক্ষের করা রিভিউ আবেদন এখন নিষ্পত্তির অপেক্ষায়৷
আপিল বিভাগের সর্বশেষ রায়ে জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীর সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে আপিল বিভাগ৷ পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হলে দণ্ড কার্যকরের প্রক্রিয়া শুরু হবে৷