তালেবানি ফতোয়া
১৪ এপ্রিল ২০১২কাবুল থেকে ১২০ কিলোমিটার দূরে তালেবানি শাসনব্যবস্থা ক্রমশ শিকড় বিস্তার করছে৷ নুরিস্তানের পুরুষদের দাড়ির দৈর্ঘ্য সঠিক না হলে কারাবাসের ভয় রয়েছে৷ উত্তর-পূর্ব এই প্রদেশটির প্রায় অর্ধেকই তালেবানের নিয়ন্ত্রণে এসে গেছে৷ সেখানকার জীবনযাত্রা ও ব্যক্তিগত জীবনের খুঁটিনাটি বিষয়গুলিও উগ্র ইসলামপন্থীরাই স্থির করে দেয়৷ মানুষ কী পরবে, চুল-দাড়ির দৈর্ঘ্য কতটা হবে, তারা রেডিও বা টেলিভিশনে কী শুনবে বা দেখবে, কোথায় কাজ করবে – সশস্ত্র তালেবান যোদ্ধারাই তা ঠিক করে দেয়৷ তারা নিজেদের ‘শিয়া পোশান' বা ‘কালো পোশাক পরা' হিসেবে পরিচয় দেয়৷
প্রাদেশিক গভর্নর তামিম নুরিস্তানি এবিষয়ে বললেন, ‘‘বিশেষ করে কামেজ ও বার্গ-ই-মাতাল জেলায় তালেবান কার্যকলাপ সম্পর্কে আমাদের কাছে রিপোর্ট রয়েছে৷ আমরা এটাও জানি, কেউ সরকারের জন্য কাজ করলেই মারাত্মক হুমকি দেয় তারা৷ প্রতিশোধের ভয়ে অনেক পরিবার গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে৷''
আন্তর্জাতিক তৎপরতা
চলতি বছরেই নুরিস্তান থেকে তালেবানকে বিদায় করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন গভর্নর তামিম নুরিস্তানি৷ তবে মানুষ সেই প্রতিশ্রুতি বিশ্বাস করে না৷ কামেজ জেলার মহম্মদ গুল বলেন, এর আগেও অনেকবার তালেবানের বিরুদ্ধে সংগ্রামে জয়ের আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল৷ কিন্তু বাস্তবে কিছুই বদলায় নি৷ উল্টে তাদের শক্তি বেড়েই চলেছে৷ সংখ্যাও বাড়ছে৷ মার্কিন বাহিনীও তাদের বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারে নি৷
কথাটা অবশ্য পুরোপুরি ঠিক নয়৷ মার্কিন নেতৃত্বে আইসাফ বাহিনী গত কয়েক বছরে একাধিক বার নুরিস্তান থেকে তালেবানকে তাড়িয়ে দিতে পেরেছিল৷ কিন্তু সেই সাফল্য বেশিদিন টেকে নি৷ তালেবান বার বার ফিরে এসেছে৷ তারপর ২০১০ সালের শেষে মার্কিন বাহিনী এলাকা থেকে পাকাপাকি পাততাড়ি গুটিয়ে চলে যায়৷ অনেক আফগান বিশেষজ্ঞ মনে করেন, সেটা ছিল মারাত্মক এক ভুল৷ কারণ আফগান নিরাপত্তা বাহিনী এখনো একা তালেবান যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের উপযুক্ত হয়ে ওঠে নি৷
সীমান্তের পরোয়া নেই
নুরিস্তান প্রদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের সীমান্ত এলাকা প্রায় ২৪০ কিলোমিটার দীর্ঘ৷ যখনই আইসাফ বাহিনী তালেবান যোদ্ধাদের কোণঠাসা করেছে, তখনই তারা সীমান্ত পেরিয়ে পাকিস্তানের চিতরাল'এ আশ্রয় নিয়েছে৷ আবার পাকিস্তানে তালেবান কোণঠাসা হয়ে পড়লে তারা নুরিস্তানে চলে আসে৷
প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য হেনায়াতুল্লাহ মাজাবইয়ার এবিষয়ে বললেন, ‘‘নুরিস্তানে শুধু পাকিস্তানি তালেবান যোদ্ধারা নয়, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত অফিসাররাও বেশ তৎপর রয়েছে৷ প্রাক্তন সেনা অফিসাররা প্রায়ই সীমান্ত পেরিয়ে চলে আসে, টাকাপয়সা বিলিয়ে দেয় এবং মানুষকে বিদেশিদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে প্ররোচনা যোগায়৷''
মাজাবইয়ার মনে করেন, পাকিস্তানি ও আফগান তালেবান নুরিস্তানে নিজেদের আরও নিরাপদ মনে করছে৷ তারা আসলে সীমান্তের দুই প্রান্তের এলাকা নিয়ে একটি শক্তিশালী ঘাঁটি গড়ে তোলার চেষ্টা করছে৷ প্রয়োজনে সীমান্ত পেরিয়ে পাকিস্তানে প্রবেশ করে আবার ফিরে আসতে পারে তারা৷ তাদের এই তৎপরতা বন্ধ করতেই আইসাফ বাহিনী এই অঞ্চলে বড় অভিযানের পরিকল্পনা করছে৷
কাবুলের শাসনের সীমা
রাজধানী কাবুলে অবশ্য নুরিস্তানের পরিস্থিতি নিয়ে এত বেশি দুশ্চিন্তা দেখা যাচ্ছে না৷ তালেবানের হামলা মোকাবিলা করতে যথেষ্ট প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে বলে দাবি করেছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সেদ্দিক সেদ্দিকি৷ তাঁর মতে, আফগান পুলিশ ও সেনাবাহিনী কামেজ ও অন্য এলাকায় তালেবান দমন অভিযানের পরিকল্পনা করছে৷
তবে শুধু সামরিক অভিযানের মাধ্যমে তালেবান সমস্যার সমাধান সম্ভব নয় বলে মনে করেন নুরিস্তানের সাংসদ মাওলাউয়ি আহমাদুল্লাহ৷ তাঁর অভিযোগ, নুরিস্তানের প্রশাসন যন্ত্রের বেহাল অবস্থা৷ সারা বছর তাদের নাগাল পাওয়া কঠিন৷ সেনারা আসে যায়, তালেবান বার বার ফিরে আসে৷ তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে নুরিস্তানের জন্য সার্বিক ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার দাবি জানিয়ে আসছেন৷ সরকার তার কথা না শুনলে নুরিস্তান হয়তো আফগানিস্তানের প্রথম তালেবান নিয়ন্ত্রিত প্রদেশে পরিণত হতে পারে৷
প্রতিবেদন: রতবিল শামেল, সঞ্জীব বর্মন
সম্পাদনা: দেবারতি গুহ