আমলাতন্ত্রের ইশতেহার ও ‘উজিরে খামাখা’
২১ এপ্রিল ২০২০অফিস আদেশটিতে বর্ণিত কর্মকর্তারা হলেন বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিব ও সিনিয়র সচিবগণ৷
ওইখানে সমন্বয়ের সঙ্গে ‘সু’ যোগ করা হয়েছে, বোধহয় উপসর্গই হবে, কিন্তু সমন্বয়ের আগে পরে সু-এর ব্যবহার আমি এই প্রথম দেখলাম৷
এই অফিস আদেশটি একাধিক কারণে তাৎপর্যপূর্ণ৷ তবে বিস্তারে না গিয়ে বলি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই আদেশটি বোধহয় দেশে আমলাতন্ত্রে প্রবেশের ছোট ও পরীক্ষামূলক ঘোষণা৷ এই পরীক্ষা সফল হলে দেশের এমপি ও মন্ত্রীদের একটাই পরিচয় হবে আর তা হলো ‘উজিরে খামাখা’৷
খেয়াল করলে যে কেউই দেখবেন, মন্ত্রীদের কর্মহীনতা এর মধ্যে অনেকটাই প্রমাণিত৷ দেশের সব বিষয়ে মন্ত্রীরা প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের কথাই বলেন আর অপেক্ষা করেন৷ একজন চোরকে ধরা হবে কিনা সে নির্দেশও প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে আসে বলে গর্বভরে জানান স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী৷ প্রতি মন্ত্রণালয় ধরে ধরে এর ব্যাখ্যা না দিলেও চলে৷
অনেকদিন থেকেই দেশে এমন একটি অবস্থা হয়েছে যে, কোনো মন্ত্রী, মানে যিনি মন্ত্রণা বা উপদেশ দেন বা দেবেন এরকম কথা শোনা যায় না৷ সকল দায়ও যেমন দিনশেষে শেখ হাসিনার, সকল প্রশংসার উৎস আর লক্ষ্যও তিনি৷ তাই তার দেওয়া দায়িত্বগুলো পালন করার জন্য তার তো আমলাই দরকার, মন্ত্রীরাও একেকজন আমলা বৈ তো নয়৷
ইদানীং এই ব্যাপারে আর রাখঢাকও নেই যে, প্রধানমন্ত্রী তার পারিষদদের মধ্যে আমলাদের উপরই নির্ভর করেন বেশি৷ স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে মনে আছে? তিনি বলেছিলন, করোনা প্রতিরোধে জাতীয় কমিটির তিনি চেয়ারম্যান হলেও তাকে কিছু জানানো হয় না৷ ওই কমিটিও একটি আমলা-নির্ভর কমিটি, নিজের ভাষাতেই গুরুত্বহীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছাড়া আর কোনো মন্ত্রী এমপি বা রাজনীতিবিদ সেই কমিটিতে ছিলেন না৷
আর এমপি ও মন্ত্রীরা জনগণের কথা বলার কথা, কারণ, জনগণ তাকে নির্বাচিত করে৷ কিন্তু আমরা একজন মন্ত্রী বা এমপিও পাই না যিনি শুধু আওয়ামী লীগ সভাপতির হাতকে শক্তিশালী করার জন্য ভোট চান না৷ তাই সব এমপি বা মন্ত্রী জানেন, দিনের শেষে শেখ হাসিনাই তাকে মন্ত্রী বা এমপি বানান, জনগণ নয়৷
ত্রাণ সমন্বয়, থুড়ি সুসমন্বয়ের কথায় ফিরে আসি৷ টানা ১১ বছরের বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ৷ শীর্ষমহলের সুনজরের কারণে আজ কারো গাড়িতে পতাকা আর কেউ এখন দাওয়ায় বসে ‘অতীত দিনের স্মৃতি' মনে করেন৷ সে যাক, আওয়ামী লীগের মধ্যে তাই ক্ষমতায়, ক্ষমতার বলয়ে বা ক্ষমতার বাইরে থাকা একে অপরের শত্রু জ্ঞান করা জন বা গোষ্ঠী রয়েছে৷ জেলা, উপজেলা, থানা, ইউনিয়ন পর্যায়ে তারা ক্ষমতাবানও বটে৷ তারা জানেন, জনগণ হয়তো তাদের ক্ষমতায় আনতে পারেন না, কিন্তু জনগণের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার না করা গেলে কেন্দ্রের কেউ বা কেউকেটারা দাম দেবে না৷ তাই আধিপত্য বিস্তার গুরুত্বপূর্ণ৷
রাজনীতিবিদদের এই অসামান্য হেলাফেলার সময়েও তাই আমরা পোস্টারে পোস্টারে চারদিক ছেয়ে যেতে দেখি, দেখি আওয়ামী লীগের নেতাদেরও বাড়ি বাড়ি ঘুরে ভোট চাইতে৷ এই আধিপত্য বিস্তারের মাধ্যমেই সরকারের ঠিকাদারি পাওয়া সম্ভব হয়, কাঁচা টাকা পায়ে হেঁটে বাড়ি চলে আসে৷ নেতারা ভাবেন, তিনি যে গুরুত্বপূর্ণ, একথা তাকেই প্রমাণ করতে হবে, তা ভয় দেখিয়ে হোক বা বৈধ-অবৈধ বিত্ত দিয়ে৷ তারপর একে-ওকে ছোট-মাঝারি গ্রহ বা উপগ্রহ ধরে উপস্থাপিত হতে হবে ক্ষমতাবলয়ের কেন্দ্রের সামনে৷ নীতি বা আদর্শের সঙ্গে এই যাত্রার বা পালার কোনো সম্পর্ক নেই৷ এটা কিন্তু সবাই জানেন আর মানেন আর তাই কিছুদিন পরপর আমরা হাইব্রিড, কাউয়া, অনুপ্রবেশকারী এসব অসাধারণ শব্দ শুনতে পাই৷
স্থানীয় পর্যায়ে আধিপত্য বিস্তারের একটি বড় হাতিয়ার হলো ত্রাণ৷ দেশে গরিব মানুষ বেশি, তাই ত্রাণসামগ্রী দিয়ে হাতে রাখার সুযোগও বেশি৷ তাই রাজনীতিবদদের ত্রাণের দায়িত্ব দিলে চুরি করে মাটির নীচ, খাটের তল ভরিয়ে ফেলতে এত দেখা যায় আমার এক বন্ধু প্রস্তাব করেন যে, ত্রাণের নাম দেওয়া হোক চুরি৷ তাই একথা বলাই যায়, কারা ত্রাণ পাবে এই তালিকা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী বা এমপিকে করতে দিলে স্বজনতোষণের এক পাপী অধ্যায় রচিত হতে পারতো৷ আর তার সঙ্গে যোগ হতো অন্তর্কোন্দল আর বিভাজন৷
তাই বলে আমলারা কি ভালো আর দক্ষ? তা হয়তো না, কিন্তু তাদের অন্তত জনগণের সামনে যাওয়ার অভিনয়টুকু করতে হয় না৷ প্রধানমন্ত্রীকে সন্তুষ্ট করে নির্বাহী ক্ষমতাবলেই তারা গুরুত্বপূর্ণ৷ তাই এ আশা প্রধানমন্ত্রী করতেই পারেন যে, আমলারা ত্রাণের সমন্বয় ভালো করবেন৷
তাই নিরাপদ রাস্তায় হেঁটেছেন শেখ হাসিনা৷ মন্ত্রীদের হয়তো বলেছেন, ঘরে থাকো, বেশি করে হাত ধোও৷