আমাদের নিত্যদিনকার পাখিহীন শাস্ত্র
২১ জানুয়ারি ২০১৯এটি একদমই ছেলেবেলার গল্প৷ বড় হতে হতে প্রকৃতিতে আর টুনটুনি পাখি দেখার সৌভাগ্য আমাদের হয়নি৷
আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সামনে থেকে ঠাকুরমার ঝুলি আর টুনটুনি পাখি একসঙ্গে উধাও হয়ে যাচ্ছে৷
ছোটবেলার একটা স্মৃতি ভীষণ নাড়া দেয় এখনো – মা রুটি বানাচ্ছেন, সেখান থেকে আটার গোলা নিয়ে কাক খাওয়াচ্ছি, মিনিট দশেকের মধ্যে কাকের আওয়াজে আর কানপাতা দায়, আর ঠোকরের ভয়ে হাত থেকে ফেলে দিয়েছি আটার গোলা৷ সেই নিয়ে কাকদের মধ্যে চলছে লড়াই৷
ছোটবেলার সেই কাক আর কবিময় ঢাকা শহরে কবিরা রয়ে গেলেও কাক একদম নেই বললেই চলে৷ সেই কাকগুলো কোথায় গেছে? গ্রামে যায়নি এটি নিশ্চিত৷ গ্রামে সাবান আগলে রাখা হতো৷ কখন কাক নিয়ে উড়াল দেয়৷ শুধু কী সাবান, শুটকি, আঁচার, নিত্যদিনকার সংসারের জিনিস কাকের নজর থেকে আড়ালে রাখার সে কী প্রাণান্ত চেষ্টা ছিল! এখন তেমন করে কাকের মিছিল চোখেই পড়ে না৷ সে কী গ্রাম, কী ঢাকা শহর!
অর্থাৎ, পাখি কমছে৷ গল্পের কাহিনিতে পাখির বিচরণ কমার সঙ্গে সঙ্গে বাস্তবজীবনে পরিবেশ প্রকৃতিতে পাখির সংখ্যা কমছে৷ গল্পের হীরামন পাখিরা এখন যেমন ঘুম পারায় না, তেমনি সকালে পাখির ডাক শুনে ঘুম ভাঙে না৷ শেষ কবে পাখির ডাকে ঘুম ভেঙেছে নগরবাসীর? কিংবা গ্রামেই কী এখন কেউ মাঝরাতে প্যাঁচার ডাকে ঘুম ভেঙে আঁতকে ওঠে?
সারা দেশে পাখির সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমছে৷ রীতিমতো ভীতিকর একটি সংখ্যা জানিয়েছে পাখি জরিপকারী সংস্থাগুলো৷ প্রতিবছরই পাখির সংখ্যা কমছে৷ বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব ও প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক সংস্থাগুলোর আন্তর্জাতিক জোট আইইউসিএন ২০১৮ সালের জুন মাসে একটি যৌথ জরিপ প্রকাশ করে৷ সেখানে দাবি করা হয়, এক বছরে পাখির বিচরণ কমেছে প্রায় ৪০ হাজার৷ বিশেষ করে উপকূল ও দ্বীপ এলাকায় সবচেয়ে বেশি পাখি কমেছে৷ এর মধ্যে সোনাদ্বীপ উল্লেখযোগ্য৷
২০১৮ সালের ১৫ জুন প্রথম আলোতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৯৯৪ সালে প্রথম যখন পাখি জরিপ করা হয়, তখন পাখি পাওয়া গিয়েছিল প্রায় ৮ লাখ। ২০১৭ সালে পাখি দেখা গেছে ২ লাখ ৩৩ হাজার ৩২টি, যা ২০১৮ সালে নেমে এসেছে ১ লাখ ৬৩ হাজার ২১টিতে৷ ধারণা করা হচ্ছে, চলতি বছর আরো পাখি কমবে৷ আবহাওয়া, জলবায়ু পরিবর্তন, বন উজাড়ের মতো বিষয়কে পাখি কমার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করছেন বিশেষজ্ঞরা৷
সেই প্রতিবেদনে আরো জানানো হয়, ‘‘বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের সদস্যরা চলতি বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি দুই মাসের বিভিন্ন সময়ে পাখি বেশি থাকে দেশের এমন পাঁচটি এলাকায় শুমারিটি করেছেন৷ ১৯৯৪ সাল থেকে প্রতিবছর একই সময়ে তাঁরা জরিপটি করে থাকেন৷ এ বছর দেশের উপকূলীয় এলাকার ভোলা ও নোয়াখালীর চর সোনাদিয়া দ্বীপ, সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর, সিলেট ও মৌলভীবাজারের হাকালুকি হাওর ও বাইক্কার বিলে জরিপটি করা হয়৷ শীতের এই সময়টাতে ওই এলাকাগুলোতে পাখি বেশি থাকে বলে জরিপটি করা হয়৷’’
জলবায়ু পরিবর্তনের মতো ভারিক্কী বিষয়ের সঙ্গে ব্যক্তি-দায় উল্লেখ করলে ভীষণ ক্লিশে হয়ে যাবে বিষয়টি৷ কিংবা, গুরুত্ব হারাবে৷ তবে ব্যক্তি মানুষ হিসেবে ব্যক্তি-দায় উল্লেখ না করে পারছি না৷ আমরা মানুষ সবচেয়ে সভ্য প্রজাতি হলেও আমাদের আচরণগত কিছু ত্রুটিপূর্ণ কর্মকাণ্ড আমাদের পাখিদের থেকে বিচ্যুত করেছে৷ নয়তো সেই গল্প তো খুব বেশিদিনের পুরানো নয়, যখন আমাদের ইট-কাঠের দালানেও পাখি বাসা করতো৷
শহরে আধুনিক জীবন যাপনের নামে আর গ্রামে উন্নয়নের নামে আমরা পাখির আবাস ধ্বংস করেছি৷ নিজেরাই তো মনে করতে পারি না শেষ কবে প্রচণ্ড দাবদাহে বাড়ির বাইরে মাটির খোলায় পানি রেখেছিলাম পাখির জন্য৷ কিংবা কবে শেষ ভাত ছড়িয়েছিলাম কাকের জন্য? আমাদের উচ্ছিষ্ট খাবার এখন যায় ডাস্টবিনে পলিথিনে প্যাকেট হয়ে৷ অথচ চাইলেই আমরা সানসেটে কিংবা বারান্দায় পাখির জন্য একটু খাবার ছড়িয়ে রাখতে পারতাম৷ এইটুকু মানবিক আচরণ আমরা পাখির জন্য করতে পারি না বলেই পাখিগুলো কমে যাচ্ছে৷
এখনো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি পাখি আসে প্রতি শীতে৷ তবে কতদিন আসবে সেটা প্রশ্নযোগ্য৷ কারণ, পাখি দেখতে গিয়ে যে হারে চিপসের প্যাকেট, কোকের ক্যান, বর্জ্য লেকের পানিতে ফেলে আসি, তাতে প্রতি বছর বিদ্যুৎগতিতে পাখি না কমার কোনো কারণ নেই৷ এ বছরের এখনো এক মাস যায়নি, এরমধ্যেই প্রায় প্রতিটি গণমাধ্যমে খবর এসেছে, শ্রীমঙ্গলের বাইক্কা বিলে পাখি কমেছে৷ বাইক্কা বিল পাখিদের জন্য অভায়শ্রমই ছিল৷
এখানকার কচুরিপানা, নলখাগরা পাখিদের খাবার ও আশ্রয়স্থল৷ পাখিরা এগুলো খায়, এখানেই থাকতো৷ কিন্তু নদীর দুধারে গড়ে ওঠা বাড়িঘর ও ফিশারি পাখিদের ভীত করছে বলে জানান বিশেষজ্ঞরা৷ অন্যদিকে ফিশারি মালিকরা দুইদিন পরপর বিল পরিষ্কারের নামে কচুরিপানা, নলখাগড়া পরিষ্কার করছেন৷ এতে পাখির খাদ্য এবং আবাস দুইই নষ্ট হচ্ছে৷
এইতো কদিন আগেই চারপাশে শালিকের এত আনাগোনা দেখেছি৷ এক শালিকে বিপদ, দুই শালিকে সুখ৷ শেষ কবে শালিক দেখেছেন ভেবে দেখুন তো? কিংবা হলুদ রঙের ইষ্টি পাখি, বাড়ির গাছে যে পাখি বসলে সবাই মনে করতো আজ মেহমান আসবে৷
ঢাকা শহরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রমনা পার্ক কিংবা বলধা গার্ডেনেও এখন সেই কলকাকলিমুখর পরিবেশ নেই৷ এখন আর লাল টুকটুকে তেলাকচু ফল খেতে টিয়া পাখি বসে না৷ গাছের কাঁচামরিচ গাছেও জাল দিয়ে ঢাকা দিতে হয় না৷ আমাদের প্রতিদিনকার জীবন থেকে হারিয়েই যাচ্ছে পাখি৷ আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের গল্পে আর লেখা হবে না পাখির কথা৷
ফাতেমা আবেদীন নাজলার এ লেখাটি আপনার কেমন লাগলো? জানান নীচের ঘরে৷