রবিউল নামের একটি শিশুকে নির্মমভাবে হত্যা
৫ আগস্ট ২০১৫রাবিউলের বয়স মাত্র ১১৷ বরগুণার তালতলী থানার এক গ্রামে মাছ চুরির অভিযোগে এ শিশুটিকে তার এক প্রতিবেশী নাকি পিটিয়ে হত্যা করে পুকুরে লাশ ফেলে দেয়৷ অন্যদিকে রাকিব খুলনার একটি মোটর সাইকেল গ্যারেজে কাজ করতো৷ আর সেই গ্যারেজ ছেড়ে অন্য একটি গ্যারেজে চলে যাওয়াটাই ছিল তার ‘অপরাধে'৷ আর এ জন্যই তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়৷ পায়ুপথে কম্প্রেসার মেশিন দিয়ে বাতাস ঢুকিয়ে হত্যা করা হয় তাকে৷ আর সিলেটে রাজিবকে হত্যা করা হয়েছিল দড়ি দিয়ে বেঁধে পিটিয়ে৷ এমনকি হত্যার পর সেই ভিডিও-ও প্রকাশ করা হয় সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে৷
গত কয়েক দিনে ঢাকায় একটি সুটকেসের মধ্যে অন্য একটি শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে বলে খবর৷ তার শরীরে আঘাতের চিহ্ন ছিল বলে জানায় পুলিশ৷ একইদিনে ঢাকায় এক শিশু গৃহকর্মীকে গরম খুন্তির ছ্যাঁকা দিয়ে নির্যাতনের খবরও জানায় তারা৷
মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৩ সাল পর্যন্ত তিন বছরে এক হাজার ৭৩০টি শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে বংলাদেশে৷ তবে কতজন শিশুকে হত্যা করা হয়েছে, তার হিসেব এই মন্ত্রণালয়ের কাছে নেই৷
র্যাব-এর কাছ থেকে পাওয়া তথ্য থেকে জানা গেছে, গত বছরের শেষ তিন মাসে সারাদেশে শতাধিক শিশু হত্যার শিকার হয়েছে৷ এর মধ্যে গত আগস্ট মাসে ৩৫, সেপ্টেম্বরে ৪০ এবং অক্টোবর মাসে ২৫ জন শিশু হত্যার তথ্য জানায় র্যাব৷
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞানের অধ্যাপক হাফিজুর রহমান কার্জন ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘শিশুর প্রতি এই নির্মম সহিংসতার প্রধান কারণ বিচারহীনতা৷ এছাড়া নির্যাতিত এবং নিহত শিশুদের অধিকাংশই নিম্নবিত্ত পরিবারের৷ ফলে বিচার পাওয়া তাদেও জন্য বেশ দুরূহ৷'' তবে তিনি মনে করেন, ‘‘আমাদের সমাজ শিশুদের জন্য এখনো যথেষ্ট সভ্য হয়ে ওঠেনি৷ এখানে শিশুদের প্রতি নির্মম আচরণ এবং সহিংসতা সাধারণ ভাবেই নেয়া হয়৷ দু-একটি ঘটনায় হয়ত সংবাদমাধ্যমের কারণে ব্যাপক আলোচনায় আসে৷ তখন মানুষ প্রতিবাদী হয়৷ কিন্ত এটা ব্যতিক্রম৷ শিশুদের প্রতি সহিংসতা এখানে অতি সাধারণ ঘটনা৷''
তিনি জানান, ‘‘বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ জরিপে জানা গেছে যে, দুই তৃতীয়াংশ শিশু তার পরিবারের সদস্যদের দ্বারাই কোনো না কোনোভাবে নির্যাতনের শিকার হয়৷ আর নির্যাতনের শিকার হওয়া শিশুদের মধ্যে ৭৭ ভাগের বয়স চার থেকে ১২ বছরের মধ্যে৷''
হাফিজুর রহমান কার্জন আরো বলেন, ‘‘পরিবারের বাইরে শিশুদের যে ভয়াবহ নির্যাতন করা হচ্ছে, তার একটি কারণ বিকৃতি৷ এক শ্রেণির অপরাধী শিশুদের নির্যাতন এবং যৌন নির্যাতন করে বিকৃত আনন্দ পায়৷ তারা ক্ষমতার প্রকাশ দেখাতে চায়৷ এটা সম্ভব হয় বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে৷ আসলে আমাদের রাষ্ট্র এবং সমাজ কাঠামো এখনো শিশুবান্ধব নয়৷''
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘এটা স্পষ্ট যে শিশুর প্রতি সহিংসতা এবং নির্মমতা বাড়ছে বাংলাদেশে৷ এটাকে শুধু ব্যক্তির দায় হিসেবে দেখলে চলবে না৷ সমাজ ও রাষ্ট্রেরও দায় আছে এতে৷''
তিনি বলেন, ‘‘আমাদের দেশে নিম্নবিত্ত শিশুরা পেটের দায়ে নানা ধরনের কাজ করতে বাধ্য হয়৷ নিজেদের কর্মস্থলে নানা নির্যাতনের শিকার হতে হয় তাদের৷ এটাই যেন স্বাভাবিক৷ এই মানসিকতা আমাদের মধ্যেও কাজ করে৷ আর এর সঙ্গে যোগ হয় কিছু বিকৃতি৷ বড় ধরনের বিকৃতির ঘটনা আমাদের চোখে পড়ে, আমরা প্রতিবাদী হই৷ কিন্তু এর মূলে কাজ করছে আমাদেরই প্রচলিত ধ্যান-ধারণা এবং স্যাডিস্ট সংস্কৃতি৷ তার ওপর দেশে বিচারহীনতার কারণে পরিস্থিতি দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে৷''
মানবাধিকার নেত্রী অ্যাডভোকেট এলিনা খান ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘আমাদের রাষ্ট্রকাঠামো শিশুদের জন্য যথেষ্ট সহনশীল নয়৷ তাই তাঁর কথায়, ‘‘শিশু যেন তার পরিবারের মধ্যেই নিরাপত্তা পায়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে৷ তারপর আসবে সমাজ ও রাষ্ট্রের ভূমিকা৷ আর এ জন্য আমাদের মানসিকতা ও সংস্কৃতিতে গুণগত পরিবর্তন আনতে হবে৷''