আমার নতুন জন্ম হয়েছে: ইউক্রেন পেরিয়ে আসা বাংলাদেশি
১ মার্চ ২০২২পোল্যান্ডে ইউক্রেন সীমান্তবর্তী শহর শেমিসেলের রেল স্টেশনে তিল ধারণের জায়গা নেই৷ তীব্র ঠাণ্ডার হাত থেকে বাঁচতে ইউক্রেন সীমান্ত পেরিয়ে আসা অভিবাসীরা সেখানে আশ্রয় নিয়েছেন৷ ইউক্রেনীয়রাও ছাড়াও আছেন বিভিন্ন দেশের নাগরিক৷ তাদের একজন আরিফ চৌধুরী৷ দুইদিন আগেই তিনি কিয়েভ থেকে ডয়চে ভেলেকে দেয়া সাক্ষাৎকারে সেখানকার পরিস্থিতি বর্ণনা করেছিলেন৷ সোমবার সন্ধ্যায় ১৩জন বাংলাদেশিসহ তিনি পোল্যান্ড সীমান্তের কাছে পৌঁছান৷ রেল স্টেশনটিতে তিনি ডয়চে ভেলের সাংবাদিককে বলেন, ‘‘আমার সঙ্গে ১৩ জন প্রবেশ করেছেন৷ তাদের ছয়জন নারী, দুইজন শিশু৷ বাকিরা শিক্ষার্থী ছিল ওরা পার হতে পারেনি৷ ওদের জন্য আমি অপেক্ষা করছি৷''
নিজের অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ‘‘দীর্ঘ যাত্রা ছিল৷ আমার নতুন জন্ম হয়েছে৷ মৃত্যু যে কত কাছ থেকে দেখেছি, মৃত্যু যে কত প্রকার হতে পারে, সেটা এই পরিস্থিতিতে না গেলে বলে বোঝানো সম্ভব না৷ আমরা ঠিক এমন পরিস্থিতি দেখে আসছি৷ ঘুমিয়ে গেছি এর মধ্যেই বোমা বিস্ফোরণের শব্দ শুনেছি৷... রাশিয়া বাড়ি ঘরে হামলা শুরু করেছে৷ বাসা বাড়িতে ঢুকে গুলি করছে৷ যার জন্যই সেখান থেকে চলে আসতে বাধ্য হয়েছি৷’’
আরিফ জানান, পোল্যান্ডে বাংলাদেশের দূতাবাসের কাছ থেকে তারা সহায়তা পাচ্ছেন৷ ইউক্রেনে বাংলাদেশের কনস্যুলারও তাদেরকে সব ধরনের তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন৷ ইউক্রেন সীমান্তে নানা সংকট হলেও পোল্যান্ডে ঢুকতে তাদের কোন সমস্যা হয়নি৷
দেশটি সীমান্ত অঞ্চল থেকে বিনা টিকেটে অভিবাসীদের গণপরিবহণে যাতায়াতের সুযোগ দিচ্ছে৷ সরকারের পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবীরাও নানাভাবে অভিবাসীদের সহায়তা দিচ্ছেন৷ এমনকি স্থানীয় অনেকে অভিবাসীদের তাদের থাকার জায়গাও দিচ্ছেন৷
রেল স্টেশনটিতে অবস্থান করা আরেক বাংলাদেশি শিকার্থী আবু বকর বলেন, ‘‘আমি কিয়েভে থাকতাম৷ কিয়েভের পরিস্থিতি খুব খারাপ ছিল৷ আমরা জীবনের নিরাপত্তার জন্য দূতাবাসের জন্য যোগাযোগ করি৷ আমার পাসপোর্টসহ সব ডকুমেন্টসই আছে৷ তখন ওরা (পোল্যান্ড) আমাদের ১৫ দিনের ট্রাভেলিং ভিসা দিয়ে দিয়েছে৷’’
এদিকে ইউক্রেন থেকে পালিয়ে আসা মানুষের ঢলের কারণে দেশটির বিভিন্ন সীমান্তে তীব্র যানজট দেখা দিয়েছে৷ যার কারণে ৩০ থেকে ৪০ কিলোমিটার হেঁটে পোল্যান্ডে প্রবেশ করতে হচ্ছে তাদেরকে৷ মেডিকা সীমান্ত দিয়ে পোল্যান্ডে আসা বাংলাদেশের মোশাররফ হোসেনও এমন অভিজ্ঞতার কথা জানান৷ তিনি বিভিন্ন দেশের প্রায় ২০০ অভিবাসীর সঙ্গে সোমবার সন্ধ্যায় সীমান্ত অতিক্রম করেন৷
সেখানে আরেক বাংলাদেশি শেখ নাসের উদ্দিন ডয়চে ভেলের কাছে তার যাত্রার ভোগান্তির চিত্র তুলে ধরেন৷ তিনি বলেন, ‘‘ইউক্রেনীয়দের আলাদা লাইনে ইমিগ্রেশনে নেয়া হয়৷ সেখানে ওদের ডকুমেন্টও পরীক্ষা করা হয় না৷ আমরা যারা বিদেশি আছি তাদেরকে আলাদাভাবে ডকুমেন্ট পরীক্ষা করা হয়৷ সীমান্তে খুবই ভোগান্তি৷ আমি ছয় দিন ছয় রাত থেকে..খাওয়া দাওয়া ঘুম নাই, ঠান্ডার মধ্যে থেকে এসেছি৷ এই ছয়দিন রাস্তাতেই ছিলাম লভব সীমান্তের অংশটুকুতে৷ উন্মুক্ত জায়গায় ছিলাম৷’’
শুধু বাংলাদেশি নন এমন দুর্ভোগের বর্ণনা দিয়েছেন মেডিকায় পৌঁছানো ভারতীয় শিক্ষার্থী শীতল৷ তিনি বলেন, ‘‘সীমান্ত অতিক্রমে ৩৫ থেকে ৪০ কিলোমিটার হাঁটতে হয়েছে৷ ভারি ব্যাগ নিয়ে আসাটা ছিল খুবই কষ্টকর৷ আমি হাঁটতেও পারছিলাম না ঠিকমতো৷''
সীমান্তে ইউক্রেনীয় নিরাপত্তারক্ষীদের হাতে কয়েকজন ভারতীয় মারধরের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে৷ শীতল সেখানে ছিলেন বলে জানান৷ তিনি দাবি করেন, অভিবাসীরা অধৈর্য্য হয়ে ওঠার কারণে এক পর্যায়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হয়৷ এমন অবস্থায় নিরাপত্তকর্মীরাও তাদের দায়িত্ব পালন করেন৷
এদিকে রোববার পোল্যান্ডে নিয়োজিত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সুলতানা লায়লা হোসেন ডয়চে ভেলেকে সেদিন স্থানীয় সময় বিকাল পর্যন্ত চারশ বাংলাদেশি পোল্যান্ডে আশ্রয় নিয়েছেন৷ গত দুইদিনে যা আরো বেড়েছে৷ পুর্ব ইউরোপের দেশ ইউক্রেনে ঠিক কতজন বাংলাদেশি বাস করেন তার সঠিক হিসেব জানা যায়নি৷ তবে ধারণা করা হচ্ছে, এ সংখ্যা প্রায় দেড় হাজারের মতো হতে পারে৷
আরাফাতুল ইসলাম/এফএস