আমরা সবাই রোহিঙ্গা!
৬ মে ২০১৮সময়মতো পৌঁছে গেলাম ভেন্যুতে৷ দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে মামা, ওরফে ড. ইমতিয়াজ আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রফেসর৷ নিজেও ‘জেনোসাইড' নিয়ে একটি সেন্টার খুলেছেন৷ বললাম, ‘‘যে মানুষগুলোর কিচ্ছু নেই, যাঁরা নিঃস্ব, যাঁরা বছরের পর বছর ধরে নির্যাতনের শিকার, ঘৃণা-বিদ্বেষের শিকার, সেই মানুষগুলোর পাশে বাংলাদেশ অন্তত ঠায় দাঁড়িয়ে আছে৷ এটা ভেবেও কেমন গর্ব হয়৷ তাই আজ তাঁদের কথা শুনতে এসে দারুণ লাগছে...৷''
কথা বলতে বলতেই এগোচ্ছিলাম৷ কিন্তু মিনিটখানেক পরেই থামতে হলো৷ অসম্ভব ভিড়৷
কোলন শহরের নামকরা মারিটিম হোটেল, তারই হলে বিশাল আয়োজন৷ সংগঠক ‘হাসেনে' বলে একটি গোষ্ঠী৷ সত্যি বলতে কি, হাসেনের নাম আগে আমি কখনও শুনিনি৷ অনুষ্ঠান কক্ষে গিয়ে দেখলাম অন্তত শ'তিনেক অংশগ্রহণকারী তো হবেই৷ তাঁদের অনেকেই বহুদিন ধরে হাসেনের সঙ্গে যুক্ত – জার্মানি, অস্ট্রিয়া, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, হল্যান্ড, ডেনমার্ক, সুইডেন, নরওয়ে, সুইজারল্যান্ড, ইটালি, ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া, ক্যানাডা, তুরস্ক – সর্বত্রই যে তাদের দপ্তর আছে৷ আছে কাজের বাহারও৷ পানি নিয়ে প্রকল্প, শিক্ষা নিয়ে প্রকল্প, স্বাস্থ্য সংক্রান্ত প্রকল্প, খাদ্য সংক্রান্ত প্রকল্প, অনাথ বাচ্চাদের নিয়ে নানা পরিকল্পনা এবং রোহিঙ্গাদের অধিকার নিয়ে চর্চা৷
বাব্বা, এত কিছু? নিজেকে কেমন যেন মূর্খ মনে হতে লাগলো৷ তার ওপর বক্তাদের তালিকাটি হাতে নিয়েও চোখ ছানাবড়া৷ কে নেই সেখানে? মালয়েশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী, অস্ট্রেলিয়ার সাবেক সাংসদ থেকে শুরু করে চীন, মিয়ানমার, তুরস্কের ইমাম, বাংলাদেশ থেকে আসা মানবাধিকার কর্মী, শিক্ষক, জাতিসংঘের অগুন্তি প্রতিনিধি, যুক্তরাজ্যের সোয়াস বা যুক্তরাষ্ট্রের ডসন কলেজের প্রফেসর, সাহায্য সংস্থা, মিডিয়ার লোক, ছাত্র-ছাত্রী – কোনো শেষ নেই৷
বেশ উৎসাহিত বোধ করলাম৷ আসলে বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়ার পর এহেন ‘ইন্টেলেকচুয়াল' সম্মেলন বা বুদ্ধিজীবীদের আড্ডায় যাওয়ার আর যে বিশেষ সুযোগ হয় না আমার৷ মাঝেমধ্যেই বিশ্বের চলতি রাজনৈতিক বা সামাজিক সমস্যা নিয়ে তাত্ত্বিক আলোচনার অভাব বোধ করি৷ তাই তাড়াতাড়ি নিজের নোটপ্যাডটা বের করলাম৷ বাহ্, রোহিঙ্গাদের ইতিহাস, সমস্যা, সমাধান – সব কিছু লিখে নিতে হবে না?
কিন্তু প্রথম ‘কি-নোট স্পিচ'-এর আগে পবিত্র কোরআন থেকে সুরা পাঠ শুরু করলেন এক ব্যক্তি, সম্ভবত তুর্কি৷ থতমত খেলাম৷ এটা কেন? চারিদিকে তাকিয়ে দেখি অংশগ্রহণকারীদের প্রায় অর্ধেক নারী, কিন্তু তাঁদের অন্তত ৯৫ শতাংশই হিজাবধারী৷
আমি ব্যক্তি স্বাধীনতায় বিশ্বাসী, কিন্তু একটি সম্মেলনকক্ষে এত বেশি হিজাব পরিহিতাদের দেখে একটু দমেই গেলাম৷ তাহলে কি রোহিঙ্গাদের সমস্যাকে ‘মুসলমানদের সমস্যা' বলে ধরে নিচ্ছে এরা? তবে কি বৌদ্ধধর্ম বনাম ইসলাম – এমনই সাদা-কালো এ লড়াই?
জানি, রোহিঙ্গা সমস্যার রাতারাতি কোনো সমাধান সম্ভব নয়৷ জানি, বাংলাদেশও আর এই রোহিঙ্গাদের ভার এককভাবে বইতে পারছে না৷
ওদিকে মানুষগুলোকে নিয়ে দুর্নীতি হচ্ছে, হচ্ছে নোংরামি৷ ভারত মিয়ানমারের সঙ্গে হাত মেলাচ্ছে৷ চীনের মাথায় ঘুরছে রাখাইনের প্রকৃতিক সম্পদের ‘লিস্ট', যুক্তরাষ্ট্র, ক্যানাডাসহ পশ্চিমা বিশ্ব, জাতিসংঘ মানবিক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেও, বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণহত্যার কোনো বিচার হচ্ছে না৷
ইতিহাস অবশ্য অন্য কথা বলে৷ মনে আছে, ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশ রাজের হাত থেকে স্বাধীন হওয়ার পর বার্মা তার সীমানাভুক্ত সব জাতিগোষ্ঠীকে পূর্ণ নাগরিক বলে স্বীকার করে নিয়েছিল৷ পরে ১৯৮০-এর দশকে দেশটির সামরিক শাসকেরা হঠাৎ করেই যেন আবিষ্কার করে বসে যে রোহিঙ্গারা বার্মিজ নয়৷ কেড়ে নেওয়া হয় নাগরিকত্ব৷
তখন থকেই শুরু৷ এরপর একে একে নব্বইয়ের দশক পার হয়, পার হয় ২০১২, ২০১৬, ২০১৭ – ‘মন্থর' এ গণহত্যা আরো বেশি শক্তিশালী, আরো বেশি বিভৎস হয়ে ওঠে৷ অথচ অমর্ত্য সেন বলেছিলেন, ‘‘রোহিঙ্গারা বার্মায় যায়নি, বার্মিজরাই রোহিঙ্গাদের মাটিতে এসেছিল?'' তাহলে আজ মিয়ানমার সরকার বোবা কেন? কেন বধির গণতন্ত্রের মানসকন্যা অং সান সু চি?
আমি বলবো, কারণ রাজনীতি৷ ক্ষমতার রাজনীতি আর মানবিকতার চরম অধঃপতন৷ তাই তো বসনিয়া ও রুয়ান্ডায় গণহত্যার প্রসঙ্গ টেনে তুর্কি প্রেসিডেন্ট এর্দোয়ান যখন বলেন, ‘‘মিয়ানমারের এ শোচনীয় পরিস্থিতি না পালটালে মানবতার ইতিহাসে ফের কালো ছাপ পড়বে'', তখন তিনি এ কথা কি মানবাধিকারের স্বার্থে বলেন? নাকি বলেন শুধুমাত্র তাঁর মুসলমান ভাইদের দলে টানার জন্য?
সম্মেলনে একজনের পর একজন বক্তা বক্তব্য রাখেন৷ মিয়ানমারের মানবাধিকার কর্মী ড. মায়ু জার্নি, ড. হাবিব সিদ্দিকি, বাংলাদেশ থেকে আসা প্রফেসর ড. সি আর আবরার, ড. ইমতিয়াজ আহমেদ অথবা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার প্রধান প্রফেসর ডেভিড জে শেফার বার বার মিয়ানমারের মানসিকতা, ভারত-চীনের স্বার্থদ্বন্দ্ব, বাংলাদেশের অবস্থানের কথা বলেন, তুলে ধরেন সমাধানের নানা পথ৷
তারপরও উপস্থিত সকলেই প্রায় রোহিঙ্গাদের বর্ণনা দেন হয় রোহিঙ্গা মুসলিম বলে অথবা জাতি বা ভাষাগত সংখ্যালঘু হিসেবে৷ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে একটি বিশেষ ধর্মের, জাতির চাদরে মুড়ে দেওয়া কি ঔপনিবেশিক ভাবধারার প্রতিফলন নয়? এঁরা কি জানেন না, রোহিঙ্গাদের মধ্যে হিন্দু ধর্মাবলম্বীও আছেন? আছেন ভিন্ন ভাষার মানুষও?
তাহলে তাঁদের মানবাধিকারের দাঁড়পাল্লায় কেন বিশ্লেষণ করা হচ্ছে না? কেন আমরা তাঁদের শুধুমাত্র মানুষ হিসেবে মর্যাদা দিতে পারছি না? কেন পারছি না এই গণহত্যার বিরুদ্ধে তাঁদের হাতে হাত রেখে সবাই মিলে রুখে দাঁড়াতে? কেন আমরা বলতে পারছি না, ‘‘আমরাও রোহিঙ্গা, কারণ আমরা মানবতার অংশ৷ আমরা সবার আগে মানুষ?''
বন্ধু, আমরা কি সত্যিই এই গণহত্যার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারি না? লিখুন নীচের ঘরে৷