আরো বড় সংকটের শঙ্কায় বিদ্যুৎ খাত
৪ নভেম্বর ২০২৪আদানি ৭ নভেম্বরের মধ্যে তাদের পাওনা পরিশোধের তাগিদ দিয়েছে৷ নয়তো তারা বিদ্যুৎ সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ করবে বলে জানিয়েছে৷
বকেয়া আদায়ে ভারতের ‘আদানি পাওয়ার' আগেই তার একটি ইউনিট বন্ধ করে দিয়েছে৷ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) সূত্রে জানা গেছে, ঝাড়খন্ডে বাংলাদেশের জন্য নির্মাণ করা বিদ্যুৎকেন্দ্রটির দুই ইউনিট থেকে প্রতিদিন বাংলাদেশকে এক হাজার ৪৯৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করছিল আদানি৷ গত বৃহস্পতিবার ৭০০ ইউনিটের একটি কেন্দ্র বন্ধ করে দেয়ায় বাংলাদেশে তাদের বিদ্যুৎ সরবরাহ অর্ধেকে নেমে এসেছে৷ সোমবার বিদ্যুৎ দিয়েছে ৭০০ মেগাওয়াটের কিছু বেশি৷
বাংলাদেশের বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোও জ্বালানি সংকটে আছে৷ ১,১৫০ মেগাওয়াট সক্ষমতার মাতারবাড়ি কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রটি কয়লা সংকটের কারণে পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে৷ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র রামপাল ও এস আলম গ্রুপের এসএস পাওয়ারের একটি করে ইউনিট কয়লার অভাবে বন্ধ রয়েছে৷ রামপালে ১,২৩৪ মেগাওয়াট সক্ষমতার কেন্দ্রটির সরবরাহ অর্ধেকে নেমেছে৷ ১,২২৪ মেগাওয়াট সক্ষমতার এসএস পাওয়ারের গড় উৎপাদন ৬১২ মেগাওয়াট৷ গ্যাস সংকটে মোট ২২টি বিদ্যুৎকেন্দ্র পুরোপুরি বা আংশিক বন্ধ রয়েছে৷ জ্বালানি তেলের সংকটে ২৭টি ফার্নেস অয়েল ও ডিজেলচালিত কেন্দ্র পুরোপুরি বা আংশিক বন্ধ রয়েছে৷ এমন পরিস্থিতিতে নভেম্বরে কম চাহিদার সময়েও দেশে লোডশেডিং করতে হচ্ছে৷ ফলে দেশে লোডশেডিং বেড়ে প্রায় ১০০০ মেগাওয়াটে দাঁড়িয়েছে৷
তবে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড দাবি করছে, এখন পর্যন্ত তেমন লোডশেডিং নেই৷ যেহেতু এখন তাপমাত্রা কম, তাই চাহিদাও কম৷ তবে গরমের সময় কী হবে তা এখনই তারা বলতে পারছে না৷ তাদের হিসাবে সোমবার দেশে বিদ্যুতের চাহিদা দেখানো হয় ১৩,৫০০ মেগাওয়াট৷ আর উৎপাদন দেখানো হয়েছে ১৩,৯৭৪ মেগওয়াট৷ তবে পাওয়ার গ্রিড বাংলাদেশের হিসাব তাদের সঙ্গে মিলছে না৷ পাওয়ার গ্রিডের হিসাবে সোমবার দুপুর পর্যন্ত বাংলাদেশে বিদ্যুতের চাহিদা দেখানো হয়েছে ১২,০৫০ মেগাওয়াট৷ আর উৎপাদন দেখানে হয়েছে ১১,৯৪৭ মেগাওয়াট৷ এখানে ঘাটতি দেখানো হয়েছে ৯৮ মেগাওয়াট৷ আর এই উৎপাদিত বিদ্যুতের মধ্যে আদানি দিয়েছে ৭৩৩ মেগাওয়াট৷ আরো আমদানি করা বিদ্যুৎ হলো ভেড়ামারার ৯০৫ মেগাওয়াট এবং ত্রিপুরার ৫৮ মেগাওয়াট৷ মোট ভারত থেকে আমদানি করা বিদ্যুৎ হলো ১৬৯৬ মেগাওয়াট৷ দেশের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে পাওয়া গেছে ১০,২৫১ মেগাওয়াট৷ দেশে উৎপাদিত বিদ্যুতের মধ্যে গ্যাস চালিত কেন্দ্রগুলো থেকে পাঁচ ৫,৩৩৯ মেগাওয়াট, তরল জ্বালানি থেকে ১,৬১৩, কয়লা ২,৫৫০, জলবিদ্যুৎ ১৭৬ এবং সৌরবিদ্যুৎ ৫৭৩ মেগাওয়াট৷
দেশে ছোট-বড় মিলিয়ে মোট ১৪৪টি বিদ্যুৎকেন্দ্র আছে৷ সবগুলো কেন্দ্র মিলিয়ে উৎপাদন ক্ষমতা ২৭ হাজার মেগাওয়াট৷ তবে এর মধ্যে বেশ কিছু কেন্দ্র মেরামতের জন্য বন্ধ আছে৷ আর জ্বালানির অভাবেও বন্ধ আছে বড় বড় কেন্দ্র৷
পওয়ার গ্রিড যে মাত্র ৯৮ মেগাওয়াট লোডশেডিং দেখাচ্ছে, তা আসলে ঠিক নয় বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা৷ কারণ, তাদের হিসাবে পাঁচ শতাংশ সিস্টেম লস ধরলে ঘাটতি দাঁড়ায় প্রায় ৬০০ মেগাওয়াট৷ তার চেয়েও বেশি ঘাটতি আছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা৷
বিদ্যুৎখাত বিশ্লেষক প্রকৌশলী শামসুল আলম বলেন, ‘‘বিদ্যুতের ঘাটতি না থাকলে সারাদেশে লোডশেডিং হচ্ছে কেন?৷’’
তার কথা, ‘‘লোডশেডিংয়ের যে হিসাব করা হয় তার মধ্যে অনেক ফাঁকি আছে৷ আসলে প্রকৃত চিত্র প্রকাশ করা করা হয় না৷’’
দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ব্যাপক লোডশেডিংয়ের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে৷ চট্টগ্রামে কেথাও কোথাও দিনে ৮-১০ ঘন্টা পর্যন্ত৷ বরিশালের পিরোজপুর এলাকায়ও লোডশেডিং হচ্ছে৷ দেশের উত্তরাঞ্চলেও একই পরিস্থিতি৷ পাওয়ার গ্রিডের এক কর্মকর্তা জানান, ‘‘যেসব এলাকায় পাওয়ার প্ল্যান্ট বন্ধ হয়ে গেছে, সেখানে লোডশেডিং হচ্ছে৷ চট্টগ্রামে ওই কারণে লোডশেডিং হচ্ছে৷’’
এদিকে ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায়ও এক থেকে দুই ঘণ্টা লোডশেডিং করা হচ্ছে বলে জানান তিনি৷
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের পরিচালক মোহাম্মদ শামীম হাসান বলেন, ‘‘আসলে এখন উৎপাদনে তেমন ঘাটতি নাই৷ তবে যে লোডশেডিং হচ্ছে তা সিস্টেমের কারণে৷ আর সামনে শীতকাল আসছে৷ তখন বিদ্যুতের চাহিদা কমে যাবে৷ তবে এই পরিস্থিতি থাকলে গরমের সময় সমস্যা হবে৷’’
বাংলাদেশে গরমের সময় বিদ্যুতের চাহিদা থাকে ১৭,০০০ মেগাওয়াটের বেশি৷ আর শীতের সময় ৯০০০ মেগাওয়াটে নেমে যায়৷ কিন্তু মূল সমস্যা হলো, উৎপাদনের সক্ষমতা থাকলেও বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রয়োজনীয় কাঁচামাল নেই৷
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের পরিচালক বলেন, ‘‘এখন গ্যাসের সংকট আছে৷ কয়লার সংসকট আছে৷ এলএনজিও পর্যাপ্ত পাওয়া যায় না৷ কয়লার সংকটের কারণে বড় বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ আছে৷ আদানির বিদ্যুৎ এখন কম আসছে৷ অর্ধেকে নেমে গেছে৷ এখন শীতকাল আসছে৷ বিদ্যুতের চাহিদা কমছে৷ কিন্তু এই পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে গরমকালে সমস্যা হবে৷’’
সংকট কোথায়?
বাংলাদেশের বিদ্যুৎ অনেকাংশে আমদানি নির্ভর৷ সরাসরি ভারত থেকে বিদ্যুৎ তো আমদানি করাই হয়, বিদ্যুৎ উৎপাদনের যে জ্বালানি কয়লা, গ্যাস, জ্বালানি তেল তা-ও আমদানি করা হয়৷ ফলে বিদ্যুৎকেন্দ্র থাকলেও বাংলাদেশের বিদ্যুৎখাত বলতে গেলে অন্য দেশের ওপরই নির্ভরশীল৷
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এজাজ হোসাইন বলেন, ‘‘আমরা যে পথে চলছি তাতে ২০৩০ সাল নাগাদ বিদ্যুতের জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানির ৯২ ভাগ আমদানি করতে হবে৷ আর এতে ডলারের ওপর চাপ অনেক বেড়ে যাবে৷’’
তার কথা, ‘‘আমাদের গ্যাস আছে, কিন্তু উত্তোলন করছি না৷ আবার কয়লাও আমাদের আছে, তা-ও নানা কারণে উত্তোলন করা যাচ্ছে না৷ আবার সরাসরি আমরা বিদ্যুৎ আমদানিও করছি৷ ফলে বিদ্যুৎ খাত বলতে গেলে পরনির্ভর হয়ে পড়েছে৷ এটা অব্যাহত থাকলে এই সংকট থাকবেই৷''
‘‘আবার আমরা যে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো নির্মাণ করেছি, তা অপরিকল্পিত৷ সেগুলো বসিয়ে বসিয়ে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হচ্ছে৷ আদানির সঙ্গে চুক্তির সময়ও আমরা দক্ষতার পরিচয় দিতে পারিনি৷ ফলে এখন আমরা সেটা নিয়ে ভুগছি,'' বলেন তিনি৷
আর প্রকৌশলী শামসুল আলম বলেন, ‘‘এখন বিদ্যুৎ খাত চলছে পুরো পরিকল্পনাহীনভাবে৷ তারা জানে না কতো কয়লা তারা আনতে পারবে৷ গ্যাসের পরিস্থতি কী, তরল জ্বালানি কয় মাসের আছে? আগের সরকারের পরিকল্পহীনতাই তাদের টানতে হচ্ছে৷ আগে যেভাবে ছিল সেভাবেই আছে৷ তবে এর মধ্যেও একটা কিছু করা যেতো৷’’
তার কথা, ‘‘আমাদের বিদ্যুৎ খাত নিয়ে এখন ভাবা উচিত৷ কারণ, যেভাবে এই খাত গড়ে তোলা হয়েছে, তাতে আসলে সংকট কাটবে না৷ অন্য দেশের উপর নির্ভর করে একটি খাত এভাবে চলতে পারে না৷ আমাদের কাঠামো ছাড়া আর কিছু নাই৷ আসলে এই পরিস্থিতি করা হয়েছে অন্যকে লাভবান করার জন্য৷’’
আদানি পাওয়ার
বকেয়া না পেলে ৭ নভেম্বরের পর থেকে আদানি পাওয়ার বাংলাদেশকে বিদ্যুৎ না দেয়ার যে হুমকি দিয়েছে তার জবাব দিয়েছে বাংলাদেশ৷
রোববার বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টা ফাওজুল কবির বলেছেন, ‘‘আমরা অক্টোবর মাসে ওদের (আদানি পাওয়ার) প্রায় ৯৮ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করেছি, যা সেপ্টেম্বরের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ৷ এছাড়া তাদের জন্য বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের মাধ্যমে ১৭ কোটি ডলারের এলসি করা হয়েছে৷ তারপরও তাদের এমন আচরণ খুব আশ্চর্যজনক, বিস্ময়কর এবং দুঃখজনক৷’’
তিনি বলেন, ‘‘আদানি সত্যিই বিদ্যুৎ বন্ধ করে দিলে আমরা এটা মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত আছি৷ গ্রাহকরা যাতে ভোগান্তির মধ্যে না পড়ে, সে জন্য আমরা বিকল্প ব্যবস্থা নিচ্ছি৷’’
আর প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, ‘‘আদানি গ্রুপ টাকা পায়, এটা সত্য৷ তাদের পেমেন্ট দেওয়ার ক্ষেত্রে গতি বাড়ানো হয়েছে৷ আগের যেসব বিল বাকি আছে, তার জন্য মূলত দায়ী পূর্ববর্তী আওয়ামী লীগ সরকার৷ তারা বিশাল একটা ঘাটতি রেখে গিয়েছিল৷''
তিনি বলেন, ‘‘আমাদের তরফ থেকে সর্বোচ্চ পেমেন্ট আরো দ্রুত করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে৷’’
পিডিবির চেয়ারম্যান রেজাউল করিম জানিয়েছেন, ‘‘আদানির যে বকেয়া রয়েছে, তার একটা পেমেন্ট দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে৷’’
আদানির দাবি, বংলাদেশের তাদের পাওনা দাঁড়িয়েছে ৮৫ কোটি ডলার৷ এই পাওনা কবে পরিশোধ করা হবে, সে ব্যাপারে একটি পরিষ্কার ধারণা চায় আদানি গোষ্ঠী৷ এর আগে বকেয়া পরিশোধের জন্য বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত সময় দিয়েছিল আদানি পাওয়ার৷ পাশাপাশি পাওনা পরিশোধের নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য ১৭ কোটি ডলারের ঋণপত্র দেয়ার জন্য কোম্পানিটি বলেছিল৷
প্রকৌশলী শাসুল আলম বলেন, ‘‘আসলে আদানির সঙ্গে বাংলাদেশের অসম চুক্তি হয়েছে৷ তারা যে দামে বিদ্যুৎ দেয় তার চেয়ে কম দামে এখানে বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব৷ তাদের দামের চেয়ে ভারতেও বিদ্যুতের দাম কম৷ চুক্তির ফাঁদে ফেলে বেশি দাম নেয়া হচ্ছে৷ কয়লার বাজার দরের কথা বলে এখন আবার তারা বেশি দাম দাবি করছে৷’’
আর ড. এজাজ হোসাইন বলেন, ‘‘আদানির সঙ্গে চুক্তিটি রিভিউ করে দেখা উচিত৷ কোনো প্রতারণা হয়ে থাকলে আন্তর্জাতিক সালিসি আদালতে এর প্রতিকার পাওয়া যাবে৷’’
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের পরিচালক মোহাম্মদ শামীম হাসান বলেন, ‘‘আদানি সোমবারও অর্ধেক (৭৩৩ মেগাওয়াট) বিদ্যুৎ দিয়েছে৷ তারা পেমেন্ট পেলে হয়তো পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে৷’’