বিদ্যুৎ খাতে দেনার পাহাড়, উৎপাদন কমায় ব্যাপক লোডশেডিং
১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪এর বাইরে বাকিটা পাবে দেশীয় প্রতিষ্ঠান। সেই টাকা দিতে না পারার কারণে এলএনজি আমদানিতেও সংকট হচ্ছে, আনা যাচ্ছে না কয়লাও।
এমন পরিস্থিতিতে সক্ষমতা থাকলেও জ্বালানি সংকটে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমেছে। আবার ভারত থেকেও বিদ্যুৎ কম আসছে প্রায় এক হাজার মেগাওয়াটের মতো। সবকিছু মিলিয়ে বাড়ছে লোডশেডিং। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।
সপ্তাহখানেক ধরেই চলছে এই লোডশেডিং। চলছে ভোগান্তি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকছে না। বিতরণ কোম্পানিগুলো বলছে, চাহিদার অর্ধেক বিদ্যুৎও মিলছে না। তাই লোডশেডিং বেড়েছে। এতে ভোগান্তিতে পড়েছে মানুষ। ব্যবসা-বাণিজ্যে ক্ষতি হচ্ছে। ব্যাহত হচ্ছে সেচ কার্যক্রম। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে বড় ধরনের ক্ষতির শঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা। বিদ্যুৎ বিতরণের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দৈনিক প্রায় আড়াই হাজার মেগাওয়াট লোডশেডিং হচ্ছে।
যদিও পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি (পিজিসিবি)-র ওয়েবসাইটের তথ্য বলছে, মঙ্গলবার বিকেল ৩টায় চাহিদা ছিল ১৫ হাজার ২২৯ মেগাওয়াট। কিন্তু সরবরাহ করা গেছে ১৩ হাজার ৯৩৮ মেগাওয়াট। অর্থাৎ লোডশেডিং ছিল ১ হাজার ২৯১ মেগাওয়াচ। গত সোমবার বেলা ৩টায় ১ হাজার ৮৭৪ মেগাওয়াট লোডশেডিং হয়। গত রবিবারও দেশে গড়ে ১ হাজার ২৯১ মেগাওয়াট লোডশেডিং হয়।
জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, "জ্বালানি সংকটে বিদ্যুতের কিছু ঘাটতি আছে। আমরা সেই ঘাটতি কিভাবে পূরণ করা যায় তা নিয়ে আলাপ আলোচনা করছি, চেষ্টা করছি সমস্যা সমাধানের।”
মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ৩ হাজার ৫৯৬ মেগাওয়াট ক্ষমতার বেশ কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ আছে। জ্বালানি সংকটে দেশে ৬ হাজার ২৮৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন কমেছে। বিদ্যুতে প্রতিদিন গড়ে ৮৮ কোটি ঘনফুট গ্যাস দেওয়া হচ্ছে, যা এপ্রিলে ছিল ১৩৫ কোটি ঘনফুট। সামিটের এলএনজি টার্মিনাল বন্ধ থাকায় গ্যাসের সরবরাহ কমেছে। পেট্রোবাংলা প্রতিদিন সরবরাহ করছে ২৫৯ ঘনফুট গ্যাস। এদিকে জ্বালানি সংকটের পাশাপাশি ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি কমেছে। ত্রিপুরা থেকে ঘণ্টায় ১৬০ মেগাওয়াটের স্থানে ৬০ থেকে ৯০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে। ভারতের সরকারি-বেসরকারি খাত থেকে ভেড়ামারা দিয়ে ১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আসার কথা থাকলেও মিলছে ৮৮০ মেগাওয়াট। আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকেও ৪০০ মেগাওয়াট কম আসছে।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)-র সাবেক সদস্য মকবুল ই ইলাহী চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, "এখনই দু'টি কাজ করতে পারলে ৮০ ভাগ সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। প্রথমত চুরি বন্ধ করতে হবে। আমি পথও দেখিয়ে এসেছিলাম। প্রত্যেক জোনে একটা মিটার বসাতে হবে। তারা কতটুকু বিদ্যুৎ নিচ্ছে আর তার বিনিময়ে বিল কত দিচ্ছে? তাহলেই বোঝা যাবে কোন জোনে চুরি সবচেয়ে বেশি হচ্ছে। তাদের ধরতে হবে। আর দ্বিতীয়ত হল, গ্যাসের কুয়াগুলোকে একটু ঝালাই মোছাই করলে আগামী এক মাসের মধ্যে ১৫০ মিলিয়ন গ্যাস অতিরিক্ত পাওয়া যাবে। সেই কাজটাও কেউ করছে না।”
ঢাকার দুই বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি ডিপিডিসি ও ডেসকোর তথ্য বলছে, সোমবার ঢাকায় বিদ্যুতের ঘাটতি ছিল ৪০০ মেগাওয়াট। পরিস্থিতি সামলাতে ডেসকোকে অঞ্চলভেদে ৩ থেকে ৪ বার লোডশেডিং করতে হয়। ডিপিডিসির এলাকায় দুই থেকে তিনবার লোডশেডিং হয়। মিরপুরের বাসিন্দা তালেবুল ইসলাম জানান, "সোমবার দুপুর পর্যন্ত দুইবার বিদ্যুৎ যায়। একবার এক ঘণ্টা আরেকবার দেড় ঘণ্টার বেশি সময় বিদ্যুৎ ছিল না।” মোহাম্মদপুর এলাকার বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম বলেন, "সোমবার সারাদিনে ৫ ঘন্টা বিদ্যুৎ ছিল না।”
এই পরিস্থিতি থেকে সহসাই উত্তরণের পথ আছে কিনা জানতে চাইলে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিম ডয়চে ভেলেকে বলেন, "বিদ্যুৎ সেক্টরটা তো পুরোটাই আমদানি নির্ভর করে রেখে গেছে বিগত সরকার। একদিকে বিদ্যুৎ আমদানি করছে। আবার বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য তারা এলএনজি আমদানি করছে। আবার আমরা কয়লার দাম পরিশোধ করতে পারছি না। ফলে কয়লা আসছে না। আর তেলের বিদ্যুৎ কেন্দ্র অনেকগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। সে কারণেই আজকে এই অবস্থা।”
বিদ্যুৎ ঘাটতি মেটাতে সরকার চেষ্টা করছে বলে জানিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহ উদ্দিন আহমেদ। মঙ্গলবার সচিবালয়ে সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, "অগ্রাধিকার ভিত্তিতে জ্বালানি ও কয়লা আমদানি করা হচ্ছে। তবে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে কিছুটা সময় লাগবে।”
বিদ্যুৎ সংকটের কারণে কারখানার উৎপাদন কমে গেছে। জেনারেটরের উপর ভরসা করতে গিয়ে খরচ বেড়ে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে ব্যবসায়িরা কি করছেন? জানতে চাইলে পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল ডয়চে ভেলেকে বলেন, "লোডশেডিং হলে তো উৎপাদন ব্যহত হবেই। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় ওয়াশিং, নিটিং ও ডায়িং ফ্যাক্টরিগুলোতে। কারণে সেখানে হঠাৎ করেই বিদ্যুৎ চলে গেছে পুরো প্রোডাক্টই বাতিল হয়ে যেতে পারে। সেটা বড় ধরনের ক্ষতি। আবার জেনারেটর দিয়ে কারখানা চালালে খরচ পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব না। অন্যদিকে আমরা যাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করি, তারা কিন্তু নিরবিচ্ছিন্নভাবে বিদ্যুৎ পেয়ে থাকে। ফলে এভাবে চললে আমরা প্রতিযোগিতার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলব।”
গ্রামাঞ্চলের পরিস্থিতি বেশ খারাপ। হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ের পল্লী বিদ্যুৎ অফিস জানায়, বানিয়াচং উপজেলায় বিদ্যুতের চাহিদা ১৮ মেগাওয়াট। আর পাওয়া যাচ্ছে ৯ থেকে ১০ মেগাওয়াট। রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলে ঘন ঘন বিদ্যুৎ যাওয়ায় গ্রাহকদের মাঝে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। উত্তরের ১৬ জেলায় পল্লী বিদ্যুৎ ও নেসকো মিলে বিদ্যুতের চাহিদা ২ হাজার ৬০০ থেকে ২ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট। কিন্তু দু'দিন ধরে সরবরাহ মিলছে ১ হাজার ৭০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট। রাজশাহী বিভাগে ১ হাজার ৩০০ থেকে ১ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে পাওয়া যাচ্ছে ৮০০ থেকে ৯০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। সরবরাহ কম থাকায় ঘন ঘন লোডশেডিং দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে বিদ্যুৎ বিভাগ।
এদিকে টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদন বলা হয়েছে, বাংলাদেশের কাছে ভারতের ৫ বিদ্যুৎ কোম্পানির প্রায় ১০০ কোটি ডলার পাওনা। এই বকেয়ার মধ্যে আদানি পাওয়ার পাবে প্রায় ৮০ কোটি ডলার। ভারতের প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাহীরা বলেছেন, বকেয়া থাকার পরও বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ অব্যাহত রয়েছে। তবে সতর্ক করে তারা বলেছেন, এই অবস্থা অনির্দিষ্টকাল চলতে পারে না। কারণ বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলো অংশীদারদের কাছে দায়বদ্ধ।
বিদ্যুৎ বিক্রি বাবদ পাওনা অর্থ চেয়ে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে চিঠি দিয়েছেন ভারতের আদানি গ্রুপের চেয়ারম্যান গৌতম আদানি। ভারতীয় গণমাধ্যম হিন্দুস্তান টাইমস এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে। ইকোনমিক টাইমসের এক প্রতিবেদনের বরাতে হিন্দুস্তান টাইমস জানায়, বিদ্যুৎ সরবরাহ বাবদ আদানি গ্রুপ বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের কাছে ৮০ কোটি ডলার পায়। এ পাওনার জন্যই প্রধান উপদেষ্টার কাছে গৌতম আদানি চিঠি লিখেছেন। চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন, আমরা যখন বাংলাদেশকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি বজায় রাখছি, সেই সময়ে ঋণদাতারা আমাদের ওপর কঠোর হচ্ছে। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের কাছে থেকে আমরা যে ৮০ কোটি ডলার পাই, সেই অর্থ দ্রুত পরিশোধ করার জন্য হস্তক্ষেপ করতে আপনাকে অনুরোধ করছি। বিদ্যুৎ বিক্রি বাবদ যে পাওনা হয়, তা নিয়মিত ভিত্তিতে পরিশোধ করার জন্যও তিনি অনুরোধ করছেন।