ইউক্রেন সংকটে কূটনীতি তার সীমায় পৌঁছে গেছে
১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৫যখন কোনো কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ শহর বেদখল করা হয়, তখন আর অস্ত্রবিরতির কথা খাটে না৷ যখন হামলাকারীরা সাঁজোয়া গাড়ি ও রকেট লঞ্চার নিয়ে বিশাল অভিযান চালায়, তখন সামরিক সরঞ্জাম প্রত্যাহারের কথাও খাটে না৷ মিনস্ক চুক্তির পর এক সপ্তাহও এখনো কাটেনি৷ ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে ধাপে ধাপে শান্তি আনার ক্ষেত্রে এই চুক্তির উপর ভরসা করা হচ্ছিল৷ কিন্তু মনে হচ্ছে, দোনেৎস্ক শহরের উত্তরে ডেবাল্টসেভে রণক্ষেত্রে এই প্রক্রিয়া বন্দুকের গুলি আর বোমাবর্ষণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে৷
মিনস্ক শহরে আলোচনার সময়ই ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে উত্তেজনা কমার তেমন আশা দেখা যাচ্ছিল না৷ মিনস্ক চুক্তির ১৩টি শর্তের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ডেবাল্টসেভেতে প্রথম দুটি – অর্থাৎ অস্ত্রবিরতি ও অস্ত্র প্রত্যাহার সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেছে৷ সামরিক সুবিধার স্বার্থে যুদ্ধবিরতির শর্ত তারা ঢালাওভাবে লঙ্ঘন করেছে৷ এভাবে তারা কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অর্থহীন করে দিচ্ছে – এবং তাতে রাশিয়ার সম্মতি ছিল বলেই মনে হচ্ছে৷ ইউক্রেনেরই প্রতিবেশী দেশ হাঙ্গেরি সফরের সময় রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুটিন এক সংবাদ সম্মেলনে অত্যন্ত প্ররোচনামূলক সুরে সেটা স্পষ্ট করে দিয়েছেন৷ সবজান্তা ভাব দেখিয়ে তিনি কিয়েভ-এর রাজনৈতিক নেতৃত্বকেই ডেবাল্টসেভের রক্তগঙ্গার জন্য দায়ী করেছেন৷ পুটিন এমনকি ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের দাবিও করেন৷ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের জবরদখলের পরিকল্পনার প্রতি এর চেয়ে স্পষ্ট ভাষায় সমর্থন হয়ত তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না৷
পোরোশেংকোর অপমান
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট পেট্রো পোরোশেংকো-র জন্য ডেবাল্টসেভের ঘটনা শুধু সামরিক নয়, এক রাজনৈতিক বিপর্যয়ও বটে৷ তাঁর নিজের দেশেই মিনস্ক চুক্তির বিরুদ্ধে জোরালো সমালোচনা শোনা যাচ্ছে৷ ইউক্রেন ও রুশপন্থি বিচ্ছন্নতাবাদীদের মধ্যে অনেক দর কষাকষির পর জার্মানি, ফ্রান্স, রাশিয়া ও ইউক্রেনের সরকারপ্রধানদের আলোচনার ফল হিসেবে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিলো৷ তাতে অনেক আপোশের কথা বলা আছে, যা মেনে নেওয়া কিয়েভের পক্ষে অত্যন্ত কষ্টকর৷ কারণ এর ফলে সংকটটিকে কার্যত জিয়ে রেখে ইউক্রেনের ভূখণ্ডেই রাশিয়ার প্রভাবের আওতায় এক বিচ্ছিন্নতাবাদী রাষ্ট্র মেনে নেওয়া হচ্ছে৷
মিনস্ক শহরেই এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, ডেবাল্টসেভে শহর ইউক্রেনীয় হয়ে থাকবে – রাশিয়া এবং বিচ্ছিন্নতাবাদীরা এমনটা মেনে নেবে না৷ কারণ এই শহরের মধ্য দিয়েই দোনেৎস্ক ও লুগানস্ক শহরের মধ্যে সড়ক ও রেল যোগাযোগের মূল পথটি রয়েছে৷ অর্থাৎ এই শহরের মধ্য দিয়েই দুই ‘গণপ্রজাতন্ত্র'-এর মধ্যে পরিবহণের সংযোগ স্থাপন করা সম্ভব৷ তার উপর এখান থেকেই রেলপথে রাশিয়া যাওয়া যায়৷ ফলে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের জন্য সামরিক সাহায্য এখন আগের তুলনায় অনেক সহজ হয়ে পড়েছে৷ ডেবাল্টসেভে শহরে আধুনিক রুশ সামরিক সরঞ্জামে সজ্জিত প্রতিপক্ষের সামনে ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনী গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই অসহায় অবস্থায় ছিল৷ কিন্তু তা সত্ত্বেও পোরোশেংকো হাল ছাড়তে চাননি, তাদের প্রতিরোধ চালিয়ে যাবার নির্দেশ দিয়েছেন৷ এবার বিপর্যস্ত ইউক্রেনীয় সৈন্যদের মাথা হেঁট করে ডেবাল্টসেভে ছেড়ে চলে যেতে হচ্ছে৷ এই পরাজয় পোরোশেংকোর জন্যও অত্যন্ত অপমানজনক৷ ফলে তাঁর উপর অভ্যন্তরীণ চাপ আরও বেড়ে চলেছে৷
কূটনীতি একা আগ্রাসন থামাতে পারবে না
ইউক্রেনের বেশিরভাগ মানুষই বুঝতে পারছেন, সম্পূর্ণ একা অবস্থায় যুদ্ধ জয়ের কোনো সম্ভাবনা নেই৷ তাই কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে৷ রুশপন্থি যোদ্ধারা ডেবাল্টসেভে দখল করে যদি ক্ষান্ত হয়, সে ক্ষেত্রে মিনস্ক চুক্তির সাফল্যের একটা সম্ভাবনা থেকে যায়৷ কিন্তু আরও একটি বিপদের আশঙ্কা দেখা যাচ্ছে৷ ডেবাল্টসেভে-র উত্তরে খারকিভ শহরটি বেশি দূরে নয়৷ দক্ষিণের মারিউপোল শহরও বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নিয়ন্ত্রিত এলাকার কাছেই অবস্থিত৷ ফলে যুদ্ধ আরও তীব্র রূপ নিতে পারে৷
বিচ্ছিন্নতাবাদীরা হয়ত লুগানস্ক ও দোনেৎস্ক অঞ্চল দখল করেই সন্তুষ্ট থাকবে৷ কিন্তু ডেবাল্টসেভের ঘটনা দেখিয়ে দিচ্ছে, যে এমনকি একেবারে শীর্ষ স্তরে কূটনৈতিক উদ্যোগও জবরদখলকারী আগ্রাসী শক্তিকে থামিয়ে রাখতে পারে না৷ রুশপন্থি যোদ্ধারা যদি সত্যি খারকিভ বা মারিউপোলের দিকে এগিয়ে যায়, তখন ইউক্রেনকে অস্ত্র সরবরাহের বিষয়টি আবার চাঙ্গা হয়ে উঠবে৷ তখন বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মদতকারী দেশ রাশিয়ার বিরুদ্ধে আরও নিষেধাজ্ঞাও প্রস্তুত করতে হবে৷ কারণ ইউরোপের কূটনীতি এখন তার সীমা ছুঁয়ে ফেলেছে৷