ইউক্রেনে বসবাসরত বাংলাদেশিরা উদ্বিগ্ন
২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২ডিসেম্বর থেকেই উত্তেজনার পারদ উঠতে শুরু করেছিল৷ পশ্চিমা দেশগুলো বলে আসছিল, ইউক্রেনে আগ্রাসন চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে রাশিয়া৷ তখন থেকেই উদ্বেগের শুরু৷
সোমবার ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নিয়ন্ত্রণে থাকা দুটি অঞ্চলকে ‘স্বাধীন' রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিয়ে ‘শান্তি রক্ষার' নামে সেখানে সেনা পাঠিয়েছে রাশিয়া৷ আর এ ঘটনাকে আগ্রাসনের সূচনা হিসেবে দেখছে পশ্চিমা দেশগুলো, রাশিয়ার ওপর জারি করা হচ্ছে একের পর এক অবরোধ৷ যুদ্ধ বাঁধার শঙ্কায় বিভিন্ন দেশ ইতোমধ্যে ইউক্রেন থেকে তাদের নাগরিকদের সরিয়ে নিতে শুরু করেছে, বাংলাদেশের প্রতিবেশী ভারতও সেখানে উড়োজাহাজ পাঠিয়েছে নাগরিকদের ফিরিয়ে আনার জন্য৷
সোয়া ৪ কোটি জনসংখ্যার দেশ ইউক্রেনে দেড় হাজারের মতো বাংলাদেশি রয়েছেন৷ কেউ কেউ ব্যবসা করেন, অনেকে পড়তে গেছেন৷
ডয়চে ভেলের কনটেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে ইউক্রেন প্রবাসী ব্যবসায়ী মাহবুব আলমের টোলিফোনে কথা হয় মঙ্গলবার৷ কিয়েভ থেকে মাহবুব জানান, ১৯৮২ সাল থেকে তিনি ইউক্রেনের বাসিন্দা৷ সরকারি শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে সেখানে গিয়েছিলেন তিনি, এখন ইউক্রেনের নাগরিক৷ তিনি বলেন, ‘‘একটা কাজে আমি দেশে গিয়েছিলাম৷ গতকাল (সোমবার) বিকেলে কিয়েভ ফিরেছি৷ বাংলাদেশে থাকার সময় মিডিয়ায় নানা খবর দেখে বেশ দুঃশ্চিন্তায় ছিলাম৷ এখানে চোখের দেখায় সব মোটামুটি স্বাভাবিক বলে মনে হয়, গণপরিবহনও চলছে৷ তবে সবার মধ্যে এটা নিয়ে আলোচনা চলছে, দুশ্চিন্তা আছে৷” মাহবুবের অফিসে এখন রাশিয়ার মতিগতি সবার আলোচনার বিষয়৷
‘‘রাশিয়া ইউক্রেনের দুটো অঞ্চলকে স্বাধীনতার স্বীকৃতি দিয়ে ফেলেছে, স্বাভাবিকভাবেই মানুষ এটা নিয়ে চিন্তিত৷ ইউক্রেনে সীমান্তে তো আগে থেকেই রাশিয়ার সেনারা ছিল৷ এখন পিস মিশনের নামে আরো সেনা ঢোকানো হচ্ছে৷ দেখা যাক রাশিয়া কতদূর এগোয়,” বলেন মাহবুব৷ বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রিত যে দুটি এলাকাকে রাশিয়া স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিয়েছে, সেই লুহানস্ক ও দোনেৎস্ক রুশ সীমান্ত লাগোয়া ইউক্রেনের দুটি ডিভিশন বা বিভাগ৷ ২০১৪ সালে রাশিয়া ইউক্রেনের কাছ থেকে ক্রিমিয়া দখল করে নিলে, এ দুটো বিভাগে বিদ্রোহীদের ইন্ধন দিয়ে যুদ্ধ বাধিয়ে রেখেছে মস্কো৷
মাহবুব বলেন, ‘‘ডিভিশন দুটোর একটা অংশ বিদ্রোহীরা দখল করে আছে এবং একটা অংশ ইউক্রেন কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণে ছিল৷ এখন ইউক্রেন কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণে থাকা অংশ তারা দখলের চেষ্টা করবে কিনা- সেটা একটা প্রশ্ন৷যদি দখল করার চেষ্টা করে তখন ইউক্রেন কী সিদ্ধান্তে নেবে, কী করবে, পাল্টা জবাব দেবে কিনা, সেগুলোও গুরুত্বপূর্ণ৷ ইউক্রেন এ ব্যাপারে পুরোপুরি পশ্চিমের ওপর নির্ভরশীল৷ এখন ওয়েস্ট নিজেদের প্রতিশ্রুতি কতটুকু রাখবে সেটাও দেখার বিষয়৷’’
ইউক্রেনে ঠিক কতজন বাংলাদেশি আছেন, তার সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান নেই তবে সংখ্যাটা এক থেকে দেড় হাজারের মধ্যে হবে বলে মাহবুবের ধারণা৷ সবচেয়ে বেশি অনিশ্চিয়তার মধ্যে রয়েছেন দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক এবং কাছাকাছি এলাকায় থাকা বিদেশিরা৷ তবে ওই দুটি এলাকায় কোনো বাংলাদেশি আছেন কি না, সে বিষয়ে নিশ্চিত নন তিনি৷মাহবুব বলেন
‘‘২০১৪ সালের যুদ্ধের পর ওই দুই অঞ্চলে এখন আর তেমন বাংলাদেশি থাকেন না বলেই আমি জানি৷ লুহানস্কের মেডিকেল ইন্সটিটিউটে বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি পড়তেন, দোনেৎস্কেও ছিলেন৷ যুদ্ধের পর অধিকাংশ বাঙালিই চলে যান৷ তারা এখন কিয়েভ, ওডেসাসহ অন্যান্য শহরে ট্রান্সফার হয়ে গেছেন৷এ মুহূর্তে লুহানস্ক বা দোনেৎস্কে বাংলাদেশি কেউ থেকে থাকলেও কিয়েভে বাংলাদেশের অনারারি কনস্যুলেটের সঙ্গে হয়ত যোগাযোগ করেননি,করলে তারাও জানতে পারতেন৷’’
‘‘এখানে তো বাংলাদেশের কোনো দূতাবাস নেই, একটা অনারারি কনস্যুলেট আছে৷ তবে পোল্যান্ডে বাংলাদেশের দূতাবাস থেকে রাষ্ট্রদূত সুলতানা লায়লা হোসেন নিয়মিত আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন৷ উনার সঙ্গে আমারও ব্যক্তিগতভাবে কথা হচ্ছে৷ ফার্স্ট সেক্রেটারি অনির্বাণ নিয়োগীও খুব অ্যাক্টিভ৷ তিনিও নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন৷’’
উদ্বেগের এই সময়টায় নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রাখতে একটি সোশাল নেটওয়ার্ক তৈরি করেছেন প্রবাসীরা, যাতে জরুরি খবরগুলো দ্রুত সবাইকে জানানো যায়৷ কিয়েভে পোল্যান্ডের দূতাবাসও বিদেশিদের নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে বলে জানান মাহবুব৷
‘‘পোলিশ দূতাবাস আমাদের জানিয়েছে, পোলিশ অথরিটি এরকম একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷ যদি সেরকম জরুরি পরিস্থিতি তৈরি হয়, তাহলে ইউক্রেনে যারা বিদেশি আছেন, তাদের জন্য হয়ত সহজে পোল্যান্ড চলে যাওয়ার একটা ব্যবস্থা করা হবে৷ এমন সিদ্ধান্ত তারা নিচ্ছেন বলে আমাদের জানানো হয়েছে৷’’
পোল্যান্ডে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সুলতানা লায়লা হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ইউক্রেনে বসবাসরত প্রায় পাঁচশ বাংলাদেশি তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন এবং তারা চলে যেতে চাইলে তাদের কী ধরনের সহায়তা দেওয়া যাবে, তা নিয়ে তারা ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাথে যোগাযোগ করেছেন৷ পোল্যান্ড সরকার ইউক্রেনের সাথে সীমান্ত খুলে দিয়েছে জানিয়ে তিনি বলেছেন, ‘‘পোল্যান্ড সরকার এক ব্রিফিংয়ে আমাদের জানিয়েছে, ইউক্রেনে থাকা তৃতীয় দেশের নাগরিকরা সেদেশ ছাড়তে চাইলে, পোল্যান্ড ১৫ দিনের জন্য তাদের ট্রানজিটে থাকার অনুমতি দেবে৷’’
১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যে দেশগুলো হয়েছে, তার মধ্যে আয়তনের দিক দিয়ে রাশিয়ার পরই ইউক্রেনের অবস্থান৷ ইউক্রেনের বাসিন্দাদের অনেকেরই আত্মীয়-স্বজন রাশিয়ায় থাকেন৷
‘‘রাশিয়ার সঙ্গে এরকম একটা ঘটনা, এত শত্রুতামূলক পরিস্থিতি যে তৈরি হতে পারে, এটা কিন্তু আমরা কোনোদিন কল্পনাও করিনি৷ এটা অনেকটা দুঃস্বপ্নের মত৷’’ বলেন মাহবুব আলম৷
এনএস/এসিবি (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম)