ইউক্রেনের প্রতি জার্মান সরকারের সমর্থনে সায় নেই পপুলিস্টদের
৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪এই দুই দলই ইউক্রেনে অস্ত্র সরবরাহেরবিরোধী৷ তাদের এই অবস্থান ফেডারেল রাজনীতিতে প্রভাব ফেলছে৷
জার্মান সরকারের একজন মুখপাত্র স্যাক্সনি এবং টুরিঙ্গিয়ার রাজ্য নির্বাচনের পরবলেন, ‘‘রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ইউক্রেনীয় প্রতিরোধকে আমরা সমর্থন করি৷ স্পষ্টতই, আমরা তা চালিয়ে যাব৷''
কিন্তু অল্টারনেটিভ ফর জার্মানি (এএফডি) এবং সারা ভাগেনক্নেখট অ্যালায়েন্স (বিএসডাব্লিউ)-এর নির্বাচনী সাফল্যের পর কি এটা সত্যিই ‘আবশ্যিক ছিল'? উভয় পক্ষই ইউক্রেনের জন্য সামরিক সমর্থন বন্ধ করতে এবং রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কে উন্নতি চায়৷
যদিও পররাষ্ট্র নীতির সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নেওয়া হয় না, তবে নির্বাচনী প্রচারণায় ইউক্রেনের প্রতি সমর্থন ছিল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়৷ সারা এই নির্বাচনকে যুদ্ধ এবং শান্তির ভিত্তিতে একটি নির্বাচন হিসাবে দেখেছেন৷ টুরিঙ্গিয়ার এএফডি নেতা ব্যোয়র্ন হ্যোকে বলেন, ‘‘পূর্ব জার্মানির এই নির্বাচনগুলো সিদ্ধান্ত নেবে জার্মানি যুদ্ধের পথ থেকে সরে এসেছে নাকি দেশ প্রবৃদ্ধির পথে এগোতে চায়৷''
'পূর্ব জার্মানির অনেকেই যুদ্ধ বেড়ে চলার আশঙ্কা করেন'
পরিসংখ্যানগুলো এই সমস্যাকে তুলে ধরেছে৷ চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎসের কথা অনুযায়ী, ইউক্রেনকে ‘যতদিন প্রয়োজন ততদিন' সমর্থন করতে চায় জার্মান সরকার৷ তবে, পূর্ব জার্মানিতে এই বিষয়টা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে৷
চলতি বছরের আলেনসবাখ সিকিউরিটি রিপোর্ট অনুসারে, পূর্ব জার্মানির (উত্তরদাতাদের) ৭৬ শতাংশ ভয় পাচ্ছেন যে জার্মানি সামরিক সংঘাতে জড়িয়ে পড়তে পারে৷ পশ্চিম জার্মানিতে এটা ৪৪ শতাংশ৷ পোলস্টার ইনফ্রাটেস্ট ডিম্যাপের জুলাইয়ের সমীক্ষায়, দেশব্যাপী উত্তরদাতাদের ৩৬ শতাংশ বলেছেন, ইউক্রেনে অস্ত্র সরবরাহ ‘অনেক বেশিমাত্রায়' হয়েছে৷ পূর্ব জার্মানিতে এই সংখ্যাটা ছিল ৫০ শতাংশ৷
পূর্ব জার্মানির ব্রান্ডেনবুর্গ রাজ্যের ইতিহাসবিদ কাটিয়া হোয়ের বর্তমানে যুক্তরাজ্যের বাসিন্দা৷ তার কথায়, ‘‘পূর্ব জার্মানির অনেকেই আরো অস্ত্র সরবরাহের ফলে যুদ্ধ বেড়ে চলার আশঙ্কা করছেন৷ সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলিতে, আমি বারবার এই যুক্তি শুনেছি, রাশিয়াকে কিছুতেই পরাজিত করা যাবে না, এবং ইউক্রেনের জন্য আরো সমর্থন দরকার৷ এর ফলে অপ্রয়োজনীয়ভাবে বিষয়টায় উসকানি দেয়া হচ্ছে এবং যুদ্ধ থামতে দেরি হবে৷''
ডিডাব্লিউ-কে একটি ইমেলে তিনি বলেন, ‘‘এই দৃষ্টিকোণ সোভিয়েত নিয়ন্ত্রণে পূর্ব জার্মানির অভিজ্ঞতা থেকেও তৈরি হতে পারে৷ কারণ সোভিয়েত ইউনিয়ন একসময়ে ছিল দুটি বিশ্বশক্তির একটি৷ সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্য পূর্ব জার্মানির অনেকের মনে শ্রদ্ধার জায়গা ছিল৷ সেই সোভিয়েত আজকের রাশিয়ায় স্থানান্তরিত হয়েছে৷ তবে পশ্চিম জার্মানির ক্ষেত্রে বিষয়টা এমন প্রভাব ফেলেনি৷''
তার মত, সাবেক পূর্ব জার্মানিতে সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পর্কে জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণ নেতিবাচক ছিল না৷
স্যাক্সনি রাজ্যের প্রিমিয়ার মাইকেল ক্রেৎশমের নির্বাচনী প্রচারের সময় এই অনুভূতির প্রতিধ্বনি শোনা গিয়েছিল৷ তিনি দীর্ঘদিন ধরে যুদ্ধ থামানোর আহ্বান জানিয়ে আসছেন৷ তার দল কেন্দ্র-ডান ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন (সিডিইউ) অর্থাৎ বুন্দেস্টগের বৃহত্তম বিরোধী দলে তার এই আচরণ খানিকটা আতঙ্ক তৈরি করেছিল৷ অনেকে ক্রেৎশমেরের দাবিকে ইউক্রেনের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা হিসাবে দেখেছেন৷
সিডিইউ পররাষ্ট্র নীতি বিশেষজ্ঞ রোডেরিশ কিয়েসেভেটের এএফডি এবং বিএসডাব্লিউ-র উল্লেখ করে ডয়চে ভেলেকে একটি ই-মেলে লিখেছেন, ‘‘দুর্ভাগ্যবশত সিডিইউ নিজেকে ‘‘ক্রেমলিনের দুটো শাখার দ্বারা এগিয়ে দিয়েছে৷''
‘‘যুদ্ধ পরিস্থিতি শীতল হলে অধিকৃত অঞ্চলগুলোতে ব্যাপক হারে যুদ্ধাপরাধ বাড়বে৷ পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো ফ্রন্টলাইন সুরক্ষিতকরতে সেনা মোতায়েন করবে৷''
তার কথায়, ‘‘এটা অন্যান্য আগ্রাসী দেশগুলোর কাছে ‘ব্লু প্রিন্ট' হিসাবে কাজ করবে৷ এর ফলে আরো লক্ষ লক্ষ শরণার্থী বাস্তুচ্যুত হবে৷''
তিনি বলেন, ‘‘অনেক ব্যক্তিকে জার্মানি এবং পশ্চিম ইউরোপে পালিয়ে যেতে হবে৷''
শরিক কী ভাবছে
স্যাক্সনি এবং টুরিঙ্গিয়ার আসন্ন জোট আলোচনায়, ‘ইউক্রেনের সমর্থনে আপনার অবস্থান কী', এই প্রশ্নের পরিণতি জোরালো হতে চলেছে৷ সিডিইউর পরবর্তী সরকারের নেতৃত্ব দেওয়ার ভালরকম সম্ভাবনা রয়েছে, তবে এর জন্য জোটের অংশীদারদের প্রয়োজন৷ সিডিইউ এএফডির সঙ্গে জোটের কথা অস্বীকার করলেও বিএসডাব্লিউর সঙ্গে জোট করতেও পারে৷
নির্বাচনের আগে সারা স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন, তার দলের জোটের প্রবেশ নির্ভর করবে ইউক্রেন ইস্যুর উপরে৷ তার কথায়, ‘‘আমরা শুধুমাত্র একটা রাজ্য সরকারের অংশ হব যা কূটনীতির জন্য এবং ফেডারেল স্তরে যুদ্ধের প্রস্তুতির বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান নেবে৷''
নির্বাচনের পর থেকে সারার স্বর নরম৷ তিনি বলেছেন, বিএসডাব্লিউ-এর সঙ্গে জড়িত একটি রাজ্য সরকারকে অবশ্যই প্রকাশ্যে জানাতে হবে, তারা ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের অবসান ঘটাতে ফেডারেল সরকারের কাছ থেকে আরো ‘কূটনৈতিক উদ্যোগ' দেখতে চায়৷ সরকারের ‘এই মাত্রায় কিয়েভে অস্ত্র সরবরাহকে' তারা ‘সমর্থন করে না৷'
‘বিএসডাব্লিউ ক্রেমলিনের দীর্ঘ হাত!'
ইতিহাসবিদ কাটিয়া হোয়ের বলেন, ‘‘ক্রেৎশমের প্রথম থেকেই অস্ত্র সরবরাহের বিরুদ্ধে স্পষ্টভাবে কথা বলেছিলেন৷''
তার বিশ্বাস, টুরিঙ্গিয়ার পরিস্থিতি ভিন্ন৷ সেখানে এএফডি শক্তিশালী দল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, সিডিইউ থেকে ১০ পয়েন্ট এগিয়ে আছে৷ তাই ‘বিএসডাব্লিউ সিডিইউকে চাপ দিতে পারে কারণ সেখানকার প্রায় অর্ধেক ভোটদাতা এএফডি বা বিএসডাব্লিউকে ভোট দিয়েছেন, যার অর্থ রাশিয়ার প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব আছে, এমন দলকে বেশিরভাগ মানুষ সমর্থন করেছেন৷' এমনকি সারা এটাকে বাতিল করে দিলেও, বিএসডাব্লিউ এবং এএফডি-র জোট রাজ্য পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে৷ ফলে বিএসডাব্লিউ অনেক বেশি সুবিধা পাবে৷''
অন্যদিকে বিএসডাব্লিউ-কে বিন্দুমাত্র ছাড়পত্র দেয়ার বিরোধী কিয়েসেভেটের৷ তার কথায়, ‘‘বিএসডাব্লিউ হল ক্রেমলিনের দীর্ঘ বাহু৷ সিডিইউ ও তার বাভারিয়ান সিস্টার পার্টি সিএসইউ সংগঠনের ঐতিহ্যগত মূলবোধের বিরোধী বিএসডাব্লিউ৷ এই মূল্যবোধগুলো হল, স্বাধীনতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে শান্তি, আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলা, গণতন্ত্র এবং প্রতিশ্রুতি বজায় রাথা৷ তাই বিএসডাব্লিউকে সহযোগিতা করা আত্ম-ধ্বংসের সমান হবে৷''
একটি উপায় হল, উভয় পক্ষ যদি স্বীকার করে ইউক্রেনের পরিস্থিতির জন্য রাষ্ট্রগুলো দায়ী নয়৷ তারা খানিকটা অস্পষ্টভাবে শান্তি প্রচেষ্টায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ৷ ফেডারেল স্তরে সমস্যাটা যদিও কোনোভাবেই নিষ্পত্তি হয়নি৷
ইউক্রেনের প্রতি জনসমর্থন কমে যাচ্ছে, বিশেষ করে পূর্ব জার্মানিতে৷ যুদ্ধ যত দীর্ঘ হবে, জার্মান সরকারের পক্ষে সমর্থনের নীতি চালিয়ে যাওয়া তত কঠিন হবে৷ ২০২৫ সালের ২৮ সেপ্টেম্বরের আগে ফেডারেল নির্বাচনের সময় এই বিষয়টা আবারো সামনে আসার সম্ভাবনা রয়েছে৷
ক্রিস্টফ হাসেলবাখ/আরকেসি