‘স্মার্ট বর্ডার সিস্টেম’
১০ জুন ২০১২সীমানা সুরক্ষার প্রচেষ্টা
শেঙেন ভিসার কল্যাণে ইউরোপের অনেক দেশের মধ্যে অভ্যন্তরীণ সীমানায় নিয়মিত নিয়ন্ত্রণ আর নেই৷ ফলে ইউরোপের বহির্সীমানায় কড়াকড়ি অনেক বেশি৷ কিন্তু তা সত্ত্বেও সীমান্তে অপরাধের ঘটনা কমে নি৷ অবৈধ উপায়ে ইউরোপে প্রবেশ করার চেষ্টাও করে অনেকে৷ সেই চেষ্টা করতে গিয়ে অনেকের অপমৃত্যু ঘটে৷ বিশেষ করে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে এমন ঘটনা বেড়েই চলেছে৷ এমন অপ্রিয় ঘটনা এড়াতে উন্নত প্রযুক্তি কাজে লাগানো হচ্ছে৷ চালু করা হচ্ছে ইউরোপীয় সীমানা নজরদারি ব্যবস্থা – যার পোশাকি নাম ‘ইউরোপীয় বর্ডার সারভেলেন্স সিস্টেম' বা ‘ইউরোসুর'৷
ইউরোপীয় কমিশনের অভ্যন্তরীণ কমিশনার সেসিলিয়া মালস্ট্রোম গত বছর নতুন প্রযুক্তি চালু করার সময়ে বলেছিলেন, ‘‘এর জন্য আমাদের এক কার্যকর ব্যবস্থা চালু করতে হবে৷ ইউরোপীয় পার্লামেন্ট, ইউরোপীয় মন্ত্রিপরিষদ ও ইউরোপীয় তথ্য সংরক্ষণ দপ্তরের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে এবিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করতে চাই আমি৷''
প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ
জাতীয় ও ইউরোপীয় স্তরে যে ডেটাব্যাংক বা তথ্যভাণ্ডার রয়েছে, সেগুলিকে পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত করে নতুন একটা নেটওয়ার্ক তৈরি করাই আসল চ্যালেঞ্জ৷ ইউরোপের বহির্সীমানায় নজর চালানোর জন্য ড্রোন ও স্যাটেলাইট ব্যবস্থারও উন্নতি করতে হবে৷ গোটা ব্যবস্থাকে স্থায়ী রূপ দিতে ‘ইউরোসুর' একটা গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ৷ সেক্ষেত্রে ইউরোপীয় স্তরেই সীমানা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব চূড়ান্ত রূপ পাবে৷
‘ইউরোসুর'এর পাশাপাশি আরও দুটি সমান্তরাল ব্যবস্থা গড়ে তোলার পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে৷ ‘স্মার্ট বর্ডার সিস্টেম' শিরোনামের আড়ালে প্রচলিত প্রক্রিয়াকে ঢেলে সাজানোর লক্ষ্যেই এই পরিকল্পনা৷ ‘এন্ট্রি-এক্সিট সিস্টেম' বা ইএসএস'এর মাধ্যমে ইউরোপীয় ইউনিয়নে বহিরাগতদের যাতায়াত নিয়ন্ত্রণ করা হবে৷ সেইসঙ্গে ‘রেজিস্টার্ড ট্রাভেলার প্রোগ্রাম' বা ‘আরটিপি'র মাধ্যমে সেই সব বিদেশিদের ইউরোপে দ্রুত প্রবেশের অধিকারের গ্যারেন্টি দেওয়া হবে, যারা স্বেচ্ছায় নিজেদের বিষয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য পরীক্ষার অনুমতি দিতে প্রস্তুত৷ ইউরোপীয় কমিশনের দাবি, ‘স্মার্ট বর্ডার সিস্টেম'এর আওতায় এমন সব পদক্ষেপের মাধ্যমে একদিকে ইউরোপের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা আরও মজবুত করা সম্ভব হবে, অন্যদিকে বহিরাগতদের যাতায়াতের উপর কড়া নজর রাখা যাবে৷
পরিকল্পনায় ত্রুটি
আপাতদৃষ্টিতে এই পরিকল্পনাকে অত্যন্ত ইতিবাচক মনে হওয়াটা স্বাভাবিক৷ কিন্তু জার্মানির সবুজ দলের ঘনিষ্ঠ ফাউন্ডেশন এই পরিকল্পনার খুঁটিনাটি দিকগুলি খতিয়ে দেখেছে৷ তাদের হয়ে ব্রিটেনের নাগরিক অধিকার সংগঠন ‘স্টেটওয়াচ' এবিষয়ে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, যার নাম ‘বর্ডারলাইন'৷
রিপোর্টের অন্যতম লেখক বেন হেস ‘স্মার্ট বর্ডার সিস্টেম'এর বেশ কিছু দুর্বলতা খুঁজে পেয়েছেন৷ যেমন ভূমধ্যসাগরে অবৈধ শরণার্থীদের সুরক্ষার কথা বলা হয়েছে৷ তবে বাস্তবে কি তা হবে? তিনি বললেন, ‘‘কীভাবে শরণার্থীদের উদ্ধার করা হবে, এই পরিকল্পনায় কোথাও তার উল্লেখ নেই৷ উদ্ধার করতে পারলেও তারপর তাদের নিয়ে কী করা হবে, তাও স্পষ্ট নয়৷ এর বদলে তাদের ফেরত পাঠানোর অভিযানের উল্লেখ করা হয়েছে৷ ইউরোপের সীমানা থেকে সব শরণার্থীদের দূরে রাখাই যেন মূল উদ্দেশ্য৷ আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাজনৈতিক আশ্রয় সংক্রান্ত নীতির সঙ্গে এই প্রক্রিয়ার কোনো সামঞ্জস্য নেই৷''
সামগ্রিক সমাধানসূত্রের প্রচেষ্টা
বায়োমেট্রিক নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ‘স্মার্ট বর্ডার সিস্টেম' সেই সব বহিরাগতদেরও চিহ্নিত করতে পারবে, যারা বৈধ পথে ইউরোপে প্রবেশ করলেও ভিসার মেয়াদ পেরিয়ে যাওয়ার পরেও ফিরে যায় নি৷ ‘বর্ডারলাইন' রিপোর্ট অনুযায়ী, এটা করতে গেলে যে বিশাল তথ্যভাণ্ডার ও আয়োজনের প্রয়োজন, তা বাস্তবে চালু রাখা কঠিন৷ প্রতি বছর প্রায় ১০ কোটি মানুষ ইইউ দেশগুলিতে প্রবেশ করে৷ তাদের প্রত্যেকের হদিশ রাখা দুরূহ কাজ৷ তার উপর ইউরোপের বিশাল বহির্সীমানায় প্রতিটি ডিঙি নৌকা চিহ্নিত করতে যে প্রযুক্তি, লোকবল ও আয়োজনের প্রয়োজন, তার বিশাল ব্যয়ভার কে বহন করবে, পরিকল্পনায় তার কোনো উল্লেখ নেই৷
এই ব্যবস্থায় ইউরোপে ব্যক্তিগত তথ্য সংরক্ষণের উঁচু মানও বজায় রাখা কঠিন হবে৷ ‘স্টেটওয়াচ'এর সমালোচনার মূল ভিত্তি হলো, বেসরকারি সংস্থাগুলি মোটা মুনাফার লোভে বড় প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তার জন্য তদ্বির করে চলেছে৷ ফলে ইউরোপের বহির্সীমানার সুরক্ষার নামে বিশাল ব্যয়ভার চাপতে চলেছে বাজেটের উপর৷ তবে বিষয়টি চলতি বছরে ইউরোপীয় পার্লামেন্টে উত্থাপিত হলে তখন দুর্বলতাগুলি সবার চোখে পড়বে বলে আশা করা হচ্ছে৷
প্রতিবেদন: রেচেল গেসাট / সঞ্জীব বর্মন
সম্পাদনা: জাহিদুল হক