‘ইতিহাস চর্চায় সরকারের মাথা না গলানো ভালো’
১২ মার্চ ২০২১ডয়চে ভেলের ইউটিউব টক শো ‘খালেদ মুহিউদ্দীন জানতে চায়’-এ এবারের বিষয় ছিল, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রাজনীতি৷ আলোচনায় অংশ নেন সাংবাদিক অজয় দাশগুপ্ত এবং মহিউদ্দিন আহমদ৷ অনুষ্ঠানের শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক একটি বক্তব্য সম্পর্কে তাদের মতামত জানতে চাওয়া হয়৷ শেখ হাসিনা বলেছেন, ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ জিয়াউর রহমান অনেককে গুলি করে হত্যা করেন৷ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত ঐতিহাসিক ৭ মার্চের আলোচনায় সভায় তিনি বলেন, ‘‘চট্টগ্রামে যারা ব্যারিকেড দিচ্ছিল ২৫ মার্চ, তাদের ওপর যারা গুলি চালিয়েছিল, তার মধ্যে জিয়াউর রহমান একজন৷ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অফিসার হিসেবে যে বাঙালিরা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেছিল, জাতির পিতার নির্দেশে যারা সেদিন রাস্তায় ব্যারিকেড দিচ্ছিলো, তাদের অনেককে জিয়াউর রহমান গুলি করে হত্যা করে৷’’
লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ এই বিষয়ে বলেন, ‘‘এই স্টোরিটা আমার নতুন মনে হলো৷ আমি এতদিন যেই স্টোরিটা জানতাম, সেটা হচ্ছে, অসহযোগ আন্দোলনের কারণে সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাস করতে চট্টগ্রাম বন্দরের পোর্টাররা রাজি হচ্ছিল না৷ অস্ত্র খালাস তো আর মেজররা করে না৷ সেখানে শৃঙ্খলা রক্ষার জন্যে অফিসারদের ডিউটিতে পাঠানো হতো৷ ২৫ মার্চ সারাদিন ডিউটিতে ছিলেন মীর শওকত আলী৷ ...রাতের বেলা জিয়াকে সেখানে পাঠানো হয়৷ তিনি বন্দর পর্যন্ত যেতে পারেননি৷ যখন ঢাকা থেকে ক্র্যাকডাউনের খবর আসলো কর্নেল অলির কাছে (তিনি বিষয়টি অন্যদের জানানোর পর) ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান গেলেন, উনি পথের মাঝখানে জিয়াকে থামালেন, কারণ, জিয়া ব্যারিকেড সরাতে যাচ্ছিলেন৷’’ মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘‘সেখান থেকে জিয়াকে খালেকুজ্জামান ফিরিয়ে আনেন৷ এরপর তিনি পুরো ইউনিট নিয়ে বিদ্রোহ করেন৷’’ তিনি জানান, এমনটাই তিনি সংশ্লিষ্টদের সাক্ষাৎকারে জেনেছেন৷ প্রধানমন্ত্রী ৭ই মার্চে যা বলেছেন তা এর আগে শোনেননি বলেও জানান তিনি৷
অনুষ্ঠানে জিয়াউর রহমানের ২৭ মার্চ রেডিওতে দেয়া ভাষণের প্রসঙ্গও উঠে আসে৷ সাংবাদিক অজয় দাশগুপ্ত বলেন, ১৯৭৪ সালে জিয়া লিখেছেন, বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ থেকেই তিনি মুক্তিযুদ্ধের দিক নির্দেশনা পেয়েছিলেন৷ ১৯৯১ সাল পর্যন্তও বিএনপি জিয়াকে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে দাবি করেনি৷ পরে বিএনপি এটি বদলোনোর উদ্যোগ নেয়৷ তিনি বলেন, ‘‘আমি তখন সংবাদ-এ কাজ করতাম৷ প্রধানমন্ত্রীর প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার একটি লেখা নিয়ে আসলেন যে, জিয়াউর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন ২৬ মার্চ, ২৭ মার্চ নয়৷ সেখান থেকে পরিবর্তন হওয়া শুরু হলো৷’’ তার মতে, ‘‘জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা করেছে এর চেয়ে ইতিহাসের নির্লজ্জ মিথ্যাচার আর কিছু হতে পারে না৷’’
মহিউদ্দিন আহমদও বলেন, জিয়াউর রহমান নিজে কখনো দাবি করেননি তিনি ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন৷ ‘‘তিনি ২৭ মার্চের বিকাল বেলার কথাই বলেছেন৷ তার সহকর্মীরাও তাই বলেন৷ তবে কিছু কিছু অতিভক্ত আছে, তারা এগুলো করে৷ কিন্তু জিয়াউর রহমান জীবিত থাকাকালেও বিতর্কটা এমন ছিল না৷ আর ৭১ সালে তো এই বিতর্ক ছিলই না৷’’
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু এক দলীয় শাসন ব্যবস্থা কেন চালু করতে চেয়েছিলেন এ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন মহিউদ্দিন আহমদ৷ বলেন, ‘‘একটা দলের সংসদে ৩০০ আসনের মধ্যে ২৯৩ জন একটি দলের থাকার পরও একদল করতে হবে কেন? একদলীয় শাসন করতে হবে কেন? এর ব্যাখ্যা আমি আজ পর্যন্ত তাদের কাছে পাইনি৷’’
বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চা নিয়ে অজয় দাশগুপ্ত বলেন, এটি শুধু অসম্পূর্ণই নয় এমনকি প্রাথমিক কাজগুলোও করা হয়নি৷ সেটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ৷ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সাত কোটি মানুষের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশগ্রহণ করেছিল৷ এক্ষেত্রে প্রকৃত গবেষণা হওয়া উচিত৷ সেটা ইতিহাস গবেষণা যেমন হয় তেমনভাবেই হওয়া উচিত৷ তিনি বলেন ‘‘ মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস প্রয়োজন৷ প্রত্যেকটা পরিবারের কোনো না কোনো একটা দেখার, বলার রয়েছে৷ সেটা একটা বড় অংশ৷ নতুন প্রজন্ম বাংলাদেশের সঠিক ইতিহাস, রাজনৈতিক বিতর্ক পাল্টা বিতর্ক, ক্ষমতা দখলের জন্য মুক্তিযুদ্ধ যখন একটা বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে সেই সময়টা যখন অতিক্রম করে যাবে, প্রকৃত ইতিহাস আমাদের দেশে গড়ে উঠবে৷ প্রত্যাশা থাকবে তরুণ প্রজন্ম, তরুণ গবেষকরা এক্ষেত্রে এগিয়ে আসবেন৷’’
অন্যদিকে মহিউদ্দিন আহমদ মনে করেন, প্রতিটি রাজনৈতিক দলই চায় গবেষকরা তাদের হয়ে ক্রোড়পত্র লিখুক৷ ‘‘ইতিহাস চর্চার বিষয়টা সরকারের হাতে চলে গেলে আর ইতিহাস চর্চা হয় না৷ এখানে সরকারের মাথা না গলানোই ভালো,’’ বলেন এই গবেষক৷
এফএস/এসিবি