ইন্টারনেটে আড়িপাতার যুগ
১৫ আগস্ট ২০১৩কথায় বলে, পুরনো চাল ভাতে বাড়ে৷ না হলে রাশিয়ার গুপ্তচররা হঠাৎ নতুন করে টাইপরাইটারের মাহাত্ম্য আবিষ্কার করতো না৷ আর টাইপরাইটারই যদি হয়, তাহলে স্বভাবতই মেড ইন জার্মানি৷
এনএসএ কেলেঙ্কারির পর দুনিয়ার গুপ্তচর বিভাগগুলির টনক নড়েছে: ইলেক্ট্রনিক যোগাযোগের আর সব কিছু ভালো হতে পারে, কিন্তু সেখানে প্রতিপক্ষের আড়ি পাতা রোখার বস্তুত কোনো পন্থা নেই৷ অথচ যা গোপন, গোপনতর, চরম গোপনীয়, তা তো গুপ্ত রাখতে হবেই৷
ব্যাপারটা যদি সে ভাবে দেখা যায়, তবে গুপ্তচরবৃত্তি কিংবা আড়ি পাতা তো আর এ যুগের আবিষ্কার নয়, তা চিরকালই চলেছে৷ যেমন পুরনো সাদা-কালো ছবি দেখলেই বোঝা যাবে, টাইপরাইটারের বোতাম খটখটিয়ে গোপন তথ্য লিপিবদ্ধ করা সম্ভব৷ সেই কাগজটা হাতে না এলে – আর তার কোড জানা না থাকলে – গোপন তথ্য অন্য কারো পক্ষে জানা সম্ভব নয়৷ টাইপরাইটারের আওয়াজে আড়ি পেতে কী লেখা হচ্ছে না হচ্ছে, তার পাঠোদ্ধার করবে কে?
রাশিয়ার ফেডারাল রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিভাগ, যার নাম এফএসও৷ তাদের মাথায় আসে, জার্মানিতে একবার খোঁজখবর করে দেখা যাক, সেখানে কোনো কোম্পানি এখনও টাইপরাইটার তৈরি করে কিনা৷ এই ধরা যাক হাটিঙেন-এর অলিম্পিয়া বিজনেস সিস্টেমস৷ তারা নাকি আজও টাইপরাইটার তৈরি করে থাকে৷ আরো বড় কথা, তাদের কাছে সম্প্রতি সারা পৃথিবী থেকে খোঁজখবর আসছে: কোথায় টাইপরাইটার কিনতে পাওয়া যায় বলতে পারেন? যেন অবাক জলপান!
চাহিদা শুধু স্পাই ভার্সেস স্পাই-এর কারণে নয়
অলিম্পিয়া এযাবৎ বছরে প্রায় তিন হাজার টাইপরাইটার বিক্রি করে আসছিল – বিক্রি বলতে সারা দুনিয়ায়৷ কিন্তু এখন যা চাহিদা, তাতে হাজার হাজার তৈরি করলেও তা বিক্রি হয়ে যেতো, বলে ম্যানেজার আন্দ্রেয়াস ফস্টিরোপুলোস-এর ধারণা৷ তার সবটাই যে গুপ্তচর বিভাগগুলোর কল্যাণে, এমন নয়৷ যে সব উত্থানশীল দেশে বিদ্যুতের সরবরাহ নিয়ে অনিশ্চয়তা আছে, সেখানেও বহু কোম্পানি টাইপরাইটারকে নির্ঝঞ্ঝাট বিকল্প বলে ভাবতে শুরু করেছে৷ কিন্তু তারপর অলিম্পিয়া হস্তচালিত টাইপরাইটার তৈরি পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়৷
বাকি থাকে ইলেকট্রনিক টাইপরাইটার – কিন্তু সেটা সারা বিশ্বে ভালোই চলেছে৷ অলিম্পিয়ার মধ্যপ্রাচ্যে খরিদ্দার আছে, যারা আরবি ভাষায় টাইপরাইটার চান৷ আরবি কেন, চীনে ভাষায় অথবা রুশ ভাষার মতো সিরিলিক হরফেও টাইপরাইটার তৈরি ও সরবরাহ করতে সক্ষম হাটিঙেন-এর অলিম্পিয়া সংস্থা, যাদের কর্মীসংখ্যা সাকুল্যে ৬০ জন৷
অলিম্পিয়া মোবাইল ফোন ইত্যাদিও তৈরি করে থাকে৷ ছোট কোম্পানি, বিশ্বব্যাপী ৩৩ কোটি ইউরো পরিমাণ বিক্রি ও তার মধ্যে মাত্র দুই শতাংশ ইলেকট্রিক টাইপরাইটারের কল্যাণে৷ এবার রুশ গুপ্তচর বিভাগ টাইপরাইটারের মাহাত্ম্য পুনরাবিষ্কার করার পর যে হঠাৎ লাখ লাখ টাইপরাইটারের অর্ডার আসতে শুরু করবে, ফস্টিরোপুলোস নিজেও সেটা বিশ্বাস করেন না৷ ‘‘এফএসও-র আগ্রহের ফলে টাইপরাইটার হঠাৎ জাতে উঠে বসেছে, এবং টাইপরাইটার নিঃসন্দেহে আরো কিছুদিন থাকবে৷ কিন্তু তা থেকে এ ভেবে বসা উচিত নয় যে, টাইপরাইটার হল ভবিষ্যতের প্রযুক্তি৷''
টাইপ করার আপদ-বিপদ
অলিম্পিয়ার ইলেকট্রনিক টাইপরাইটারের মাথায় যে ধাতব গোলকটিতে সব অক্ষর খোদাই করা থাকে, সেটিই গিয়ে কাপড়ের ব্যান্ড কিংবা ক্যাসেটে রাখা কার্বন ব্যান্ডের উপর আঘাত করে কাগজের অক্ষরগুলি ফুটিয়ে তোলো৷ কার্বন ব্যান্ডের সমস্যা হল এই, সেটা একবার কারো হাতে গিয়ে পড়লে পুরো লেখাটাই উদ্ধার করা সম্ভব, কাপড়ের ব্যান্ডে লেখার উপর লেখা পড়ায় যেটা সম্ভব নয়৷ কাজেই এফএসও দৃশ্যত বেশ কয়েকশো কাপড়ের ব্যান্ডেরও অর্ডার দিয়েছে৷
হাতে চালানো কিংবা ইলেকট্রিক, টাইপরাইটারের মূল সুবিধা হল, তার ইন্টারনেটের সঙ্গে কোনো সংযোগ নেই, কাজেই ইলেকট্রনিক প্রক্রিয়ায় তার থেকে তথ্য চুরি করা সম্ভব নয়৷ অন্যদিকে এফএসও যে অর্ডার দিয়েছে, অলিম্পিয়া'র তা সরবরাহ করতে মাস চারেক সময় লেগে যাবে৷ এছাড়া অলিম্পিয়া স্বয়ং আর এই সব টাইপরাইটার জার্মানির হাটিঙেন-এ তৈরি না করে, চীনে তৈরি করায় – বিশ্বায়নের সেটাও একটা অঙ্গ৷
আর যা নিয়ে এতো হইচই, সেই অর্ডার থেকে অলিম্পিয়ার বিশেষ মুনাফা করারও কোনো সম্ভাবনা নেই, কেননা রুশ অর্ডারের মোট মূল্য হল সাকুল্যে সাড়ে এগারো হাজার ইউরো৷