ইয়েতি নয়, নিশ্চিত
৬ মে ২০১৯ভারতীয় সেনাবাহিনীর পর্বতারোহীদের সাম্প্রতিক মাকালু শৃঙ্গ অভিযানে সফরসঙ্গী ছিলেন নেপালি সেনাবাহিনীর পর্বতারোহী সদস্যরা এবং স্থানীয় শেরপারা৷ মূলত পথ নির্দেশক এবং মালবাহক হিসেবে কাজ করা, হিমালয়ের ‘ভূমিপুত্র' শেরপারা গোটা অঞ্চলটি নিজেদের হাতের তালুর মতো চেনেন৷ ভারতীয় সেনার খুঁজে পাওয়া পায়ের ছাপ খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে তাঁরা রায় দিয়েছেন, এই পদচিহ্ন সম্ভবত হিমালয়ের বাদামি ভল্লুকের, যা আকারে সাধারণ ভল্লুকের থেকে অনেক বড় হয়৷ কিন্তু নিশ্চিতভাবেই এই পায়ের ছাপ ইয়েতির নয়৷ প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে যে, সিকিম, নেপাল এবং তিব্বতের অনেক গুম্ফাতেই ইয়েতির হাত এবং পা হিসেবে মমিকৃত কিছু দেহাংশ সংরক্ষিত আছে৷ সেগুলি আপাতদৃষ্টিতে বানর জাতীয় প্রাণীর দেহাংশ বলেই মনে হয়৷ কিন্তু বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার পর নিশ্চিত প্রমাণিত হয়েছে, ওগুলি বানর নয়, বরং ভল্লুকের৷ বস্তুত এই গবেষণা করতে গিয়ে ২৩টি নতুন প্রজাতির ভল্লুকের সন্ধান পেয়েছেন জীববিজ্ঞানীরা৷ এই তথ্য ডয়চে ভেলেকে জানালেন আন্তর্জাতিক স্তরে খ্যাতিমান বানর বিশেষজ্ঞ অনিন্দ্য সিনহা৷ ভারতে জীববিজ্ঞান গবেষণার সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত অনিন্দ্যবাবু নিজেই অরুণাচলে এক বিরল প্রজাতির বানর আবিষ্কর্তা হিসেবে খ্যাত৷ হিমালয়ের বরফের ওপর পাওয়া পায়ের ছাপ ছবিতে দেখে তাঁরও মনে হয়েছে, এটা ইয়েতি, অর্থাৎ বানর-মানুষ গোত্রের কোনো প্রাণী নয়, বরং ভল্লুক হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি৷ ভল্লুক অনেক সময়ই খাড়া হয়ে দু পায়ে হাঁটে৷ সেক্ষেত্রে ওরকম একটি করে পায়ের ছাপ পড়তে পারে৷
যদিও যাঁরা বৈজ্ঞানিক নিরীক্ষার তোয়াক্কা করেন না, সেই আমজনতা যথারীতি বিষয়টা নিয়ে সোশাল মিডিয়ায় হাসি মস্করা করছেন৷ যেহেতু একটিমাত্র পায়ের ছাপ অনেকদূর পর্যন্ত চলে গেছে, রসিকতা করা হচ্ছে যে, ইয়েতি সম্ভবত হিমালয়ে কোনো ফ্যাশন শোয়ের র্যাম্পে মডেল-সুন্দরীদের মতো ‘ক্যাট ওয়াক' করেছে৷ ভারতে যেহেতু এখন সাধারণ নির্বাচন চলছে, টিপ্পনি কাটা হচ্ছে যে, ইয়েতি নির্ঘাত ভোট দিতে এসেছে৷ আর ভোটের আগে পুলওয়ামায় জঙ্গি হানা এবং তার জবাবে পাকিস্তানের বালাকোটে ভারতের বিমান হামলার সারবত্তা নিয়ে যেহেতু রাজনৈতিক জলঘোলা হয়েছে এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও তাঁর দল বিজেপি সেনাবাহিনীকেও নিজেদের ভোটের প্রচারে ব্যবহার করার চেষ্টা করেছেন— এমনও শোনা যাচ্ছে যে ইয়েতির পায়ের ছাপ খুঁজে পাওয়া আসলে সেনাবাহিনীকে জনমানসে জাগ্রত রাখার এক সুচতুর কৌশল৷
কিন্তু বিজ্ঞানীরা ব্যাপারটা আদৌ এত সহজে উড়িয়ে দিচ্ছেন না৷ জীববিজ্ঞানী অনিন্দ্য সিনহা যেমন ডয়চে ভেলেকে নির্দ্বিধায় বললেন, ‘‘বেশিরভাগ বৈজ্ঞানিকই আমার মনে হয় সেইভাবেই নিশ্চিত যে, ইয়েতি বলে কিছু নেই৷ এমনকি সাধারণ মানুষ, যাঁরা নিতান্তভাবে বৈজ্ঞানিক নন, আমার বন্ধুবান্ধবেরা যেমন বলছিলেন, ইয়েতি তো নেই! কিন্তু খুব ব্যক্তিগতভাবে বলতে গেলে, I am an Agnostic (সংশয়বাদী)৷ সুতরাং আমি যতদিন বাঁচব, আমার হাত পা (সচল) থাকলে, যদি কোনোদিন সেই সম্ভাবনা হয়, যদি তার প্রমাণ পাওয়া যায়, তা হলে একদিন ইয়েতি আবিষ্কৃত হবে!'' অনিন্দ্য সিনহা জানাচ্ছেন, ইয়েতির খোঁজ পাওয়াটা একেবারে অসম্ভব নয়৷ কারণ, যে অঞ্চলে ওই পায়ের ছাপ দেখা গেছে, সেই তুষারাবৃত অঞ্চলে থাকে, এমন একাধিক প্রজাতির বানরের খোঁজ বিজ্ঞানীরা এর আগে পেয়েছেন৷ তা হলে ইয়েতি থাকতেই বা অসুবিধে কোথায়!
কিন্তু যতদিন না সেই খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে, ইয়েতি বা তুষার-বানর লোককাহিনি এবং উপকথাতেই থেকে যাবে এক অদ্ভুত প্রাণী হিসেবে৷ ‘মহাভারত'-এর আধুনিক ভাষ্যকার হিসেবে ভারত জুড়ে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন উপকথা নিয়ে গবেষণা করেছেন লেখক শুদ্ধসত্ত্ব ঘোষ৷ তিনি একটি আগ্রহজনক তথ্য ডয়চে ভেলেকে জানালেন যে, ১৯২০-২১ সাল নাগাদ দার্জিলিং অঞ্চলে বিস্তারিত এক সমীক্ষা হয়৷ এবং কলকাতারই স্টেট্সম্যান কাগজে প্রথম ‘ইয়েতি' নামে এক প্রাণী সম্পর্কে লেখা হয়৷ ‘কিং' ছদ্মনামে লিখতেন হেনরি নিউম্যান, তিনিই প্রথম ইয়েতি নিয়ে লেখেন এবং ‘Abominable Snowman' শব্দবন্ধটি ব্যবহার করেন, যা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে৷ যদিও শুদ্ধসত্ত্ব জানাচ্ছেন, ‘‘‘ইয়েতি শব্দটা সেখানে ছিল কিনা, আমার মনে নেই৷ যতদূর মনে পড়ছে, ইয়েতি শব্দটা সেখানে ছিল না৷ ক্রমশ আরো নানান অভিযান হতে থাকে, এমনকি এডমুন্ড হিলারি পর্যন্ত ইয়েতি খুঁজতে বেরিয়েছিলেন৷''
কাজেই ইয়েতি বিতর্কের মীমাংসা হয়ত এখনই হচ্ছে না৷ বিজ্ঞানীদের সংশয়বাদী অনুসন্ধিৎসা এবং অভিযাত্রীদের আগ্রহ যতদিন জাগ্রত থাকবে, ইয়েতির খোঁজও চলবে৷ এবং কে বলতে পারে, একদিন পাওয়া গেলেও যেতে পারে সেই আদিম তুষার-বানরকে!