জার্মান মিডিয়ায় উদ্বাস্তুদের অপরাধ
২ আগস্ট ২০১৭জার্মানিতে বসবাসকারী বিদেশিদের উপর আক্রমণের ঘটনা বেড়েছে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ – যা কিনা লক্ষণীয়৷ অপরদিকে অপরাধের দায়ে সন্দেহভাজন অ-জার্মান ব্যক্তিদের সংখ্যাও বেড়েছে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ৷ কিন্তু ২০১৭ সালে মিডিয়ার রিপোর্টিংয়ে এ দু'টি তথ্য সম্যকভাবে পেশ করা হয়নি – বলছে একটি নতুন জার্মান জরিপ৷
মিডিয়ায় অ-জার্মান বিদেশি-বহিরাগত, বিশেষ করে উদ্বাস্তুদের কৃত অপরাধের ঘটনাকেই বেশি করে তুলে ধরা হয়েছে, বলে মন্তব্য করেছেন ‘ম্যাক্রোমিডিয়া মিডিয়া স্কুল’-এ সাংবাদিকতার অধ্যাপক ও জরিপটির প্রধান পরিচালক টোমাস হেস্টারমান৷ জার্মান মিডিয়ার ‘‘বিদেশ থেকে আসা সহিংস অপরাধীদের দিকে বেশি নজর দেওয়ার প্রবণতা’’ লক্ষ্য করেছেন তিনি৷
প্রফেসর হেস্টারমান ডয়চে ভেলেকে বলেন যে, তিনি ও তাঁর দলের গবেষকরা জার্মানির চারটি নেতৃস্থানীয় জাতীয় পর্যায়ের পত্রিকার ২৮৩টি প্রবন্ধ ও ২০১৭ সালের প্রথম চার মাসে সম্প্রচারিত ২১টি টেলিভিশন নিউজ রিপোর্ট বিশ্লেষণ করে দেখেছেন৷
তাঁরা দেখেন যে, ২০১৫/২০১৬ সালের নিউ ইয়ার্স ইভে কোলনে মহিলাদের ব্যাপক যৌন হয়রানির পর থেকে উদ্বাস্তুদের প্রতি মিডিয়ার মনোভাব পুরোপুরি বদলে যায়৷ ২০১৫ সালে জার্মানিতে বিপুল সংখ্যক উদ্বাস্তুর আগমনই কোলোনের ঘটনার জন্য দায়ী, জনমানসে এই ধারণা বদ্ধমূল হয়ে যায়৷
মিডিয়া যা দেখে ও দেখায়
বর্তমানে জার্মান মিডিয়া উদ্বাস্তু পরিস্থিতি সম্পর্কে অনেক বেশি নেতিবাচক মনোভাব প্রদর্শন করছে, বলে হেস্টারমানের ধারণা৷
সর্বাধুনিক যে ঘটনাটি আপাতত মিডিয়ায় আলোড়ন তুলেছে, সেটি হল হামবুর্গের একটি সুপারমার্কেটে ছুরিকাঘাতের ঘটনা৷ ঘটনায় এক ২৬ বছর বয়সি ফিলিস্তিনি রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী ও সম্ভাব্য ইসলামপন্থি এলোপাথাড়ি ছুরি চালিয়ে একজন ব্যক্তিকে হত্যা ও আরো কয়েকজনকে আহত করে৷ ফেডারাল কৌঁসুলি ঘটনার তদন্তের দায়িত্ব নিয়েছেন৷
ম্যাক্রোমিডিয়ার জরিপে দেখা যায় যে, এ বছর জার্মান সংবাদ অনুষ্ঠানগুলিতে অ-জার্মান ব্যক্তিদের সম্ভাব্য অপরাধ সম্পর্কে ২০১৪ সালের তুলনায় চারগুণ বেশি রিপোর্ট প্রচারিত হয়েছে – যদিও অ-জার্মানদের কৃত সম্ভাব্য অপরাধের ঘটনা বেড়েছে মাত্র এক-তৃতীয়াংশ৷
‘উদ্বাস্তু মানেই সহিংস’
দশ বছর আগে, অর্থাৎ ২০০৭ সালেও অ-জার্মান অপরাধ ও অপরাধীদের সম্পর্কে মিডিয়ায় আগ্রহ খুব কম ছিল না; তবে ২০১৭ সালে তা চরমে পৌঁছেছে, বলে দীর্ঘমেয়াদি জরিপটিতে প্রকাশ পেয়েছে৷
জরিপে অপরদিকে দেখা যায় যে, অ-জার্মানরা সহিংসতার শিকার হওয়ার ব্যাপারে জার্মান মিডিয়ায় রিপোর্টের সংখ্যা ৫০ শতাংশ কমে গেছে – যদিও নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষ যথারীতি উদ্বাস্তু নিবাসের উপর আক্রমণের ঘটনার পরিসংখ্যান রেখে চলেছেন৷ জার্মানির সর্বাধিক প্রচারিত ট্যাবলয়েড ‘বিল্ড’ পত্রিকায় বিদেশি-বহিরাগতদের নিয়ে রিপোর্টের ৬৪ শতাংশ ছিল বিদেশিদের কৃত সম্ভাব্য অপরাধকে কেন্দ্র করে৷
এই ধরনের একপেশে ও একতরফা রিপোর্টিংয়ের ফলে জনসাধারণ বিষয়টি সম্পর্কে একটি বিকৃত ধারণা করতে পারেন ও বিদেশিদের প্রতি বিরূপ মনোভাব উস্কানি পেতে পারে, বলে হেস্টারমান সাবধান করে দিয়েছেন: ‘‘লোকে মনে করতে পারেন যে, বিদেশিদের সমাজে অন্তর্ভুক্তির প্রচেষ্টা একটি বিশাল প্রমাদ ছাড়া আর কিছু নয়৷’’
ফেডারাল দায়রা তদন্ত কার্যালয় বা বিকেএ সবে মাত্র ২০১৩ সাল থেকে অপরাধের যারা শিকার হচ্ছেন, তাদের নাগরিকত্বের হিসাব রাখতে শুরু করেছে৷ বিকেএ-র পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে যে, জার্মানদের চেয়ে অ-জার্মানই বেশি সহিংস অপরাধের শিকার হয়ে থাকেন৷
‘দু'টি দিকই দেখাও'
উদ্বাস্তু বা বিদেশি-বহিরাগতদের কাহিনির ভালো-মন্দ দু'টি দিকই দেখানো মিডিয়ার কর্তব্য, বলে হেস্টারমান মনে করেন – একদিকে যেমন অসাফল্য ও হতাশার কাহিনি, অন্যদিকে তেমন সফলতা ও আশাবাদিতার কাহিনি৷
জরিপে আরো দেখা যায় যে, গবেষণায় যে সব মিডিয়া বিশ্লেষণ করা হয়েছে, তারা সাধারণত উদ্বাস্তুদের সরাসরি সাক্ষাৎকার নেয় না অথবা তাদের বক্তব্য পেশ করে না৷ অবশ্য এটা একটা ভাষাগত সমস্যা হতে পারে, বলে হেস্টারমান স্বীকার করেছেন৷ তবুও এ ব্যাপারে জার্মান সাংবাদিকদের নিরাসক্তি তাঁকে আশ্চর্য করেছে৷
২০১৫-য় আর ২০১৬ সালের গোড়ার দিকে যখন প্রায় দশ লাখ উদ্বাস্তু জার্মানিতে আসেন, সেই সময় জার্মান মিডিয়া বিষয়টি সম্পর্কে কিরকম রিপোর্ট করেছি্ল, তা নিয়ে অটো ব্রেনার ইনস্টিটিউটের একটি প্রামাণ্য জরিপে অভিযোগ করা হয়েছে যে, জার্মানির মুখ্য দৈনিকগুলির রিপোর্টিং একপেশে ছিল ও সরকারি নীতির বাস্তবসম্মত বিশ্লেষণ করেনি৷
মেইনস্ট্রিম মিডিয়া তখন জার্মান জনগণ ও সরকারের উদ্বাস্তুদের স্বাগত জানানোর নীতিকে অকুণ্ঠ সমর্থন দেয় ও উদ্বাস্তুদের নিয়ে নানা মর্মস্পর্শী কাহিনি পেশ করে৷ বহু জার্মান যে এই ‘উদ্বাস্তু স্রোত’ সম্পর্কে অস্বস্তি বোধ করছেন, সে কথাটি পুরোপুরি ঢাকা পড়ে যায়, বলে জরিপের অভিযোগ৷
অটো ব্রেনার ইনস্টিটিউটের জরিপের জন্য জার্মান পত্র-পত্রিকার ৩০,০০০ রিপোর্ট যাচাই করে দেখা হয়৷ গবেষকরা দেখেন, জার্মান মিডিয়া ‘উইলকমেন্সকুল্টুর’ বা ‘স্বাগতিক সংস্কৃতি’-র দোহাই দিয়ে জনসাধারণের উপর উদ্বাস্তুদের সাহায্য করার জন্য চাপ সৃষ্টি করতে দ্বিধা করেনি৷ জরিপটির মতে, মেইনস্ট্রিম মিডিয়া যে তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে, এ ধরনের রিপোর্টিং তার আরো একটি কারণ৷
ডাগমার ব্রাইটেনবাখ/এসি