চ্যালেঞ্জ অর্থনীতির ভিত মজবুত করা
১৭ মার্চ ২০১৮এই স্বীকৃতিপত্র পাওয়ার মাধ্যমে জাতিসংঘের বিবেচনায় উন্নয়নশীল দেশের পথে বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হলো৷ জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের (ইকোসক) উন্নয়ন নীতিবিষয়ক কমিটি (সিডিপি) শুক্রবার বাংলাদেশের এ যোগ্যতা নিশ্চিত করেছে৷
জাতিসংঘের ওয়েবসাইটে স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উত্তরণ বিষয়ে এক ঘোষণায় বাংলাদেশের এ যোগ্যতা অর্জনের তথ্য দেয়া হয়েছে৷ সবকিছু ঠিক থাকলে ২০২৪ সালে উন্নয়নশীল দেশ হবে বাংলাদেশ৷
তবে নতুন এই অর্জন বাংলাদেশের জন্য অনেক চ্যালেঞ্জ বয়ে আনবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা৷ কেননা স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাণিজ্য ও বৈদেশিক ঋণে যেসব বাড়তি সুযোগ রয়েছে, সেগুলোর সবকিছু থাকবে না৷ অর্থনীতিবিদরা বলছেন, যথাযথ পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তার বাস্তবায়ন হলে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে মানুষের জীবনমানের ক্রমাগত উন্নতি করা সম্ভব৷
বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন জানান, ২০২১ সালে দ্বিতীয় পর্যালোচনা করবে সিডিপি৷ ২০২৪ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ এ উত্তরণকে অনুমোদন দেবে৷ বাংলাদেশের অগ্রগতি এখন যেভাবে আছে, তার কোনো বড় ধরনের ব্যত্যয় না ঘটলে ২০২৪ সালে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের কাতারে পৌঁছাবে৷
উন্নয়নশীল দেশ হলে বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ কি হবে, জানতে চাইলে জাহিদ হোসেন বলেন, ‘‘উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি একটা মর্যাদার বিষয়৷ বাংলাদেশকে সবাই তখন আলাদাভাবে বিচার করবে৷ এর আগে বহু দেশ স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশের যোগ্য বলে স্বীকৃতি পেয়েছে৷ কিন্তু মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা- এ তিনটি সূচকেই যোগ্যতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ, যা এর আগে অন্য কোনো দেশের ক্ষেত্রে ঘটেনি৷ তবে উন্নয়নশীল দেশ হলে বাংলাদেশ এলডিসি হিসেবে বাণিজ্যে যে অগ্রাধিকার পায় তার সবটুকু পাবে না৷ আবার বৈদেশিক অনুদান, কম সুদের ঋণও কমে আসবে৷’’
তিনি বলেন, ‘‘এলডিসি হিসেবে বাংলাদেশ আঞ্চলিক বা দ্বিপাকি চুক্তির অধীনে বিভিন্ন দেশে জিএসপি বা শুল্কমুক্ত পণ্য রপ্তানি সুবিধা পায়৷ এর সঙ্গে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার (ডাব্লিউটিও) আওতায় নেওয়া সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে অনেক দেশ আমাদের শুল্কমুক্ত সুবিধা দিয়েছে৷ আবার এলডিসি হিসেবে ওষুধ রফতানির ক্ষেত্রে মেধাস্বত্ব সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক বিধিবিধান থেকে আমাদের অব্যাহতি রয়েছে৷ উন্নয়ন সহযোগীরা বাংলাদেশকে কম সুদে ও সহজ শর্তে ঋণ দিয়ে থাকে৷ এলডিসি না থাকলে তখন সুবিধাগুলো পাওয়া যাবে কি সেটা একটা প্রশ্ন৷ যেমন- ইউরোপীয় ইউনিয়ন এখন যে জিএসপি দেয়, তা ২০২৭ সাল পর্যন্ত থাকবে৷ এরপর জিএসপি প্লাস পাওয়ার কথা রয়েছে৷’’
ড. জাহিদ হোসেন জানান, বাংলাদেশ ২০১৫ সালের জুলাই মাসে নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়৷ মাথাপিছু আয়ের বিবেচনায় এ শ্রেণিকরণ করে বিশ্বব্যাংক৷ জাতিসংঘ তার সদস্য দেশগুলোকে স্বল্পোন্নত (এলডিসি), উন্নয়নশীল এবং উন্নত- এ তিন শ্রেণিতে বিভক্ত করে৷ বাংলাদেশ ১৯৭৫ সাল থেকে এলডিসি পর্যায়ে রয়েছে৷
জাতিসংঘের উন্নয়ন নীতি কমিটি (সিডিপি) গত ১২ থেকে ১৬ মার্চ এলডিসি দেশগুলোর ওপর ত্রিবার্ষিক পর্যালোচনা বৈঠকে বসে৷ মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ এবং অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা- এ তিনটি সূচকের দু’টিতে উত্তীর্ণ হলে কোনো দেশ এলডিসি থেকে উত্তরণের যোগ্য বলে বিবেচিত হয়৷ তবে শুধু মাথাপিছু আয়ের ভিত্তিতেও কোনো দেশ যোগ্য হতে পারে৷ সে ক্ষেত্রে মাথাপিছু আয়ের যে মানদণ্ড রয়েছে ওই দেশের মাথাপিছু আয় তার দ্বিগুণ হতে হবে৷
২০১৮ সালের পর্যালোচনায় এলডিসি থেকে উত্তরণের যোগ্যতা হিসেবে মাথাপিছু আয়ের মানদণ্ড হতে হয় ১২৩০ মার্কিন ডলার৷ বিশ্বব্যাংক প্রণীত অ্যাটলাস পদ্ধতির হিসাবে গত তিন বছরের গড় মাথাপিছু আয় ওই পরিমাণ হতে হবে৷ ওই পদ্ধতিতে গত তিন বছরে বাংলাদেশের গড় মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে ১২৭৪ মার্কিন ডলার৷ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে মাথাপিছু আয় আরও বেশি, তাদের হিসাবে গত অর্থবছরে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ১৬০৫ ডলার৷
পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘‘উত্তরণের সব পর্যায়েই কিছু চ্যালেঞ্জ থাকে৷ এগুলো মোকাবেলার প্রস্তুতি নিতে হবে৷ এলডিসি থেকে উত্তরণ ঘটার তিন বছর পর থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়নে বর্তমান জিএসপি সুবিধা থাকবে না৷ উন্নয়নশীল দেশগুলো ইইউতে জিএসপি প্লাস সুবিধা পায়৷ বাংলাদেশকে তার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে৷ এলডিসি না থাকলে বাংলাদেশ অন্যান্য দেশেও অনেক ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে না৷ এজন্য বিমসটেক, বিবিআইএনের মতো আঞ্চলিক উদ্যোগের সুবিধা কীভাবে কার্যকরভাবে নেওয়া যায় তার প্রস্তুতি থাকতে হবে৷ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, প্রতিযোগিতা সমতা আরও বাড়াতে হবে৷ কেননা শুল্কমুক্ত সুবিধা না থাকলে প্রতিযোগিতা বেড়ে যাবে৷ পাশাপাশি আমাদের যেসব ইনস্টিটিউশন এখনো দুর্বল, সেগুলোকে আরো উন্নত করতে হবে৷ সেটা অর্থনৈতিক ইনস্টিটিউশনই হোক আর রাজনৈতিক ইনস্টিটিউশনই হোক৷’’
বাংলাদেশ ২০২৪ সালে এলডিসি থেকে বেরিয়ে গেলে ২০২৭ সাল পর্যন্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের ‘এভরিথিং বাট আর্মস’ উদ্যোগের আওতায় পণ্য রফতানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে৷ বাংলাদেশ মানবাধিকার ও শ্রম অধিকার, পরিবেশ ও সুশাসন বিষয়ে ইইউর নিয়ম-কানুনের শর্ত পূরণ করলে জিএসপি প্লাস নামে অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সুবিধা পাবে বলে জানান ড. আহসান এইচ মনসুর৷
আপনার মতামত লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে৷