উপজেলা নির্বাচনে না গিয়ে কি ভুল করছে বিএনপি?
২৫ জানুয়ারি ২০১৯তাঁদের কেউ কেউ মনে করেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে অজস্র মামলা হয়েছে, এখন নতুন করে এই নির্বাচনে গেলে হয়ত আরো অনেক মামলা হবে৷ পাশাপাশি এই সরকারের অধীনে যে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়, সেটাও ৩০ ডিসেম্বরের ভোটের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে৷ রাজপথে আন্দোলনের মাধ্যমে এই সরকারের পতন ঘটিয়ে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার দাবিও করেছেন তাঁরা৷
তবে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘দেখুন, বিএনপি তো জাতীয় সংসদেও নেই৷ গত ১০ বছর ধরে তারা যে স্থানীয় সরকারে ছিল, সেখানেও তারা কোনো কাজ করতে পারেনি৷ আমার মনে হয়, রাজনৈতিক প্রতিবাদের মতো করে তারা উইনটা করল৷ বাস্তব পরিস্থিতি হলো– এই অবস্থায় নির্বাচন করার মতো পরিস্থিতিতে বিএনপি আছে বলে আমি মনে করি না৷ সেটা তাদের নিজেদের কারণেই হোক আর সরকারের কারণেই হোক৷ সে কারণেই এই সিদ্ধান্ত তারা নিয়েছেন৷ তাছাড়া দেশে শাসনতান্ত্রিক কোনো সংকট নেই৷ তবে রাজনৈতিক সংকট প্রকট৷ নিয়মরক্ষার নির্বাচন বলেন আর যেভাবেই বলেন, একটা নির্বাচিত সরকার তো আমাদের দেশে আছে৷ স্থানীয় সরকারগুলোতেও হয়ত নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের বসানো হবে৷ সেক্ষেত্রে কোনো সংকট থাকবে না৷ তবে রাজনৈতিক সংকটটা খুবই৷ এখানে তো কোনো রাজনীতি নেই৷ না বিরোধীদের মধ্যে, না সরকারি দলের মধ্যে৷ তাও তো সরকারি দলের লোকজন সরকারে থাকার সুবাদে টেন্ডারবাজি, বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ থেকে শুরু করে কিছু কাজ করছে৷ তারা মনে করছে, তাদের দল যেহেতু ক্ষমতায়, অতত্রব, সব করার অধিকারও তাদের৷ এখন এগুলোকে রাজনীতি বলবেন কিনা সেটা ভেবে দেখার বিষয়৷ তবে ঢাকা শহরে কিছুটা রাজনীতি আছে, সেটা টেলিভিশনের টকশোতে, কিছু সভা সেমিনারে৷ এর বাইরে দেশের কোথাও কোনো রাজনীতি নেই৷ তবে দেশে রাজনীতিতে একটা বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে৷ বিরোধীদলহীন একটা গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে নতুনভাবে আমরা আত্মপ্রকাশ করেছি৷ এটা আপনি যেভাবেই দেখেন৷’’
শুধু উপজেলা নির্বাচন নয়, আসন্ন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে উপনির্বাচনেও অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি৷ দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘গত ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনে কি হয়েছে তা তো দেশের মানুষ দেখেছেন৷ এমনকি বিশ্ববাসীও দেখেছেন৷ এখন তো দেশে নির্বাচনই নেই৷ তাহলে আর নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করে লাভ কী৷ তিনি বলেন, বর্তমান সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে না– এটা তো প্রমাণিত৷ তাই আমাদের এই সিদ্ধান্ত৷’’
নির্দলীয় সরকারের অধীনে না হওয়ায় ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত দশম সংসদ নির্বাচন বর্জন করেছিল বিএনপি৷ তবে তারপর স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচনে তারা অংশ নিয়েছিল৷ কিছু নির্বাচনে তারা জয়লাভও করে৷ একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে নানা দাবি তুলে তাতে সাড়া না পেলেও দলীয় প্রধান খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখেই অংশ নিয়েছিল তারা, সেজন্য গড়ে তুলেছিল নতুন জোট ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট'৷ নির্বাচনের ফলাফলে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ জয়ের বিপরীতে ধানের শীষের ভরাডুবির পর ‘ভোট ডাকাতি'র অভিযোগ তুলে পরবর্তী নির্বাচনগুলোতে অংশ না নেওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছিলেন বিএনপির নেতারা৷
বিএনপির এই সিদ্ধান্তকে কিভাবে দেখছেন তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা? মাগুরা জেলার শালিখা উপজেলার বর্তমান চেয়ারম্যান ও জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি মোজাফফর হোসেন টুকু ডয়চে ভেলেকে বললেন, ‘‘দলের এই সিদ্ধান্ত খুবই সঠিক৷ আমরা মনে করি, এই সরকারের অধীনে আর কোনো নির্বাচনে না যাওয়া (উচিত)৷’’ জানতে চাওয়া হয়, তিনি নিজেই আওয়ামী লীগ সরকারের সময় নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন, তারপরও কেন এ কথা কেন বলছেন? জবাবে জনাব টুকু বলেন, ‘‘তখন ভোট ডাকাতি হয়েছে৷ কিন্তু ভোটের ব্যাবধান এত বেশি ছিল যে, ডাকাতি করেও তারা পাস করতে পারেনি৷’’ এই সিদ্ধান্তে তৃণমূলে বিএনপি ক্ষতিগ্রস্থ হবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘কোনোভাবেই বিএনপি ক্ষতিগ্রস্থ হবে না৷ বরং বিএনপি এখন আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী৷ তৃণমূলের নেতা-কর্মীও এখন অনেক বেশি সংগঠিত৷ তাই দলের সিদ্ধান্তই সঠিক৷’’
আগামী ফেব্রুয়ারিতেই অনুষ্ঠিত হবে উপজেলা নির্বাচন ও ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন৷ তৃণমূলের আরেক বিএনপি নেতা বরিশাল জেলার উত্তরের সাধারণ সম্পাদক আকন কুদ্দুসুর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এই সিদ্ধান্ত দলের হাইকমান্ডের না৷ আমরা যে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নেব না, সেটা তৃণমূল থেকেই হাইকমান্ডকে জানানো হয়েছে৷ সেই প্রেক্ষিতেই সিদ্ধান্ত হয়েছে, যা খুবই যৌক্তিক ও সঠিক হয়েছে বলেই আমি মনে করি৷ শেখ হাসিনা ও তাঁর আজ্ঞাবহ প্রধান নির্বাচন কমিশনারের অধীনে যে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে না, সেটা আবারও প্রমাণ হয়েছে৷ আমরা আগেই বুঝেছিলাম যে, সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়৷ কিন্তু আপনাদের মতো সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীরা বলে আসছিল নির্বাচনে যাওয়া উচিত৷ সে কারণেই বিএনপি নির্বাচনে গিয়ে প্রমান করল যে, এই সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়৷ একে তো নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না, তার ওপর নির্বাচনে গেলে নেতা-কর্মীদের নামে এমনিতেই শত শত মামলা আছে, আরো শত শত মামলা যোগ হবে৷ আমি মনে করি, রাজপথে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে এই সরকারকে হটিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে৷’’
এদিকে তথ্যমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক হাছান মাহমুদ বলেছেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর উপজেলা নির্বাচনেও পরাজয়ের আশঙ্কায় বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সাহস পাচ্ছে না৷ শুক্রবার দুপুরে ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে প্রচার উপকমিটির সভা শেষে হাছান মাহমুদ এ মন্তব্য করেন৷ তথ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘কে নির্বাচনে অংশ নেবে, কে নেবে না, এটা তার একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার৷ ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপির অংশ না নেওয়া প্রকৃতপক্ষে তাদের আত্মহননের মতো সিদ্ধান্ত ছিল৷ আগামী উপজেলা নির্বাচনেও যদি বিএনপি অংশ না নেয়, তাহলে সেটিও আত্মহননের মতো সিদ্ধান্ত হবে৷ নির্বাচন কারো জন্য থেমে থাকবে না৷ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নিলেও সেই নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে সরকার গঠিত হয়েছিল৷ সরকার পাঁচ বছর দেশ পরিচালনা করেছে৷ উপজেলা নির্বাচনেও যদি বিএনপি না যায়, সে ক্ষেত্রেও নির্বাচন থেমে থাকবে না৷’’