উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ, তবুও কোরবানির হাটে চড়া দাম
১৪ জুন ২০২৪২০১৪ সালে ভারতে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর গরু রপ্তানি নিষিদ্ধ করে৷ এরপরই মূলত বাংলাদেশে গরুর খামারের সংখ্যা বাড়তে থাকে৷ এখন ছোট-বড় মিলয়ে ২০ লাখের মতো খামার আছে দেশে৷
২০১৯ সালে গবাদি পশুতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে বাংলাদেশ৷ সেই থেকে আর কখনই কোরবানির সময় গরুর সংকট হয়নি৷ ভারত বা মিয়ানমার থেকে গরু আনতে হয়নি৷ তবে গত কয়েক বছর ধরে দেখা গেছে, ঈদের আগের দিনগুলোতে গরুর দাম বেড়ে যায়৷
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. মোহাম্মদ রেয়াজুল হক ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এবার কোরবানিযোগ্য পশুর সংখ্যা এক কোটি ২৯ লাখ ৮০ হাজার ৩৬৭টি৷ চাহিদার চেয়ে প্রায় ২৩ লাখ বেশি৷ এ সংখ্যা গত বছরের চেয়েও চার লাখ ৪৪ হাজার ৩৪টি বেশি৷ ফলে এবার কোরবানির পশুর কোনো সংকট হবে না৷’’
গরুর দাম কেন বেশি?
হাটে পশুর দাম বেশি হওয়ার কারণ প্রসঙ্গে ডেইরি ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ও স্বপ্নসাজ এগ্রোর স্বত্বাধিকারী শাহ ইমরান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘গত তিন থেকে চার বছরে গো খাদ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে৷ বছরজুড়ে একটা গরু পালতে যে খরচ হয়, সেই তুলনায় এখন বাংলাদেশে গরুর দাম কম৷ গরু বিক্রি করে খামারিদের খুব বেশি লাভ করার সুযোগ নেই৷’’
তিনি আরো বলেন, ‘‘সাধারণ সময়ে আপনি যে দামে মাংস কেনেন, কোরবানির সময়ও গরুর দাম একই থাকে৷ বরং কখনও কখনও আমাদের লোকসান গুণতে হয়৷ শেষ মুহূর্তে দাম না পেলেও গরু বিক্রি করে দিতে হয়৷ কারণ গরুটা কোরবানিতে বিক্রি করতে না পারলে আবারও তার পেছনে খরচ করতে হবে৷’’
গরু বিক্রি করে যদি লোকসান হয় তাহলে এত খামার কেন গড়ে উঠেছে-এমন প্রশ্নের জবাবে শাহ ইমরান বলেন, ‘‘একটা খামারে তো শুধু কোরবানির জন্য গরু পালা হয় না৷ সেখানে দুধ উৎপাদন হয়৷ এর সঙ্গে দুধের নানা জিনিস তৈরি হয়৷ এগুলো থেকেই মূলত খরচ ওঠে আসে৷ শুধু গরু পালন করে খামার বাঁচানো সম্ভব না৷ এবার আমরা আশা করছি, গরুর দাম সহনশীল থাকবে৷''
প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ডা. এস এম জাহাঙ্গীর হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা গরুর কিছু জাত নিজেদের মতো তৈরি করেছি৷ যে গরুগুলো পালতে খরচ অনেক কম হয়৷ এই গরুগুলো কম খায়৷ তাদের গ্রোথ ভালো৷ এগুলো আমরা সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়ার চিন্তা করছি৷ এই জাতের গরু পালন বাড়লে খরচ অনেক কমে আসবে৷''
রাজধানীতে ২০টি গরুর হাটের অনুমোদন দিয়েছে দুই সিটি কর্পোরেশন৷ ইতিমধ্যে এসব হাটে বিক্রি শুরু হয়েছে৷ পল্লবীর ইস্টার্ন হাউজিংয়ে গরুর হাটের ইজারা পেয়েছেন তাজু উদ্দিন৷
ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘এবার দাম খুব বেশি না৷ এখন পর্যন্ত সেভাবে বিক্রি শুরু হয়নি৷ তবে বিক্রেতারা যে দাম চাচ্ছেন সেটা খুব বেশি বলে মনে হচ্ছে না৷ আমাদের হাটে ইতিমধ্যে এক হাজারেরও বেশি গরু এসেছে৷ তবে ছোট গরুতেই মানুষের আগ্রহ বেশি বলে মনে হচ্ছে৷’’
চোরাই পথে গরু আসছে কেন?
গত কয়েক বছর ধরে কোরবানি ঈদের আগে সীমান্তে কড়াকড়ি থাকায় চোরাই পথে কোনো পশু আসেনি৷ তবে এবার সীমান্ত অনেকটাই ঢিলেঢালা৷ কক্সবাজারের টেকনাফ, উখিয়া, রামু, চকরিয়া; বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি; সিলেট, কুমিল্লা, লালমনিরহাটসহ ছয় জেলার ৩৮ সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে ভারত ও মিয়ানমার থেকে সবচেয়ে বেশি পশু ঢুকেছে বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয়রা৷ একদিকে পশুখাদ্যের উচ্চমূল্য, তীব্র তাপদাহে বাড়তি যত্নের জন্য বেশি উৎপাদন খরচ এবং ঘূর্ণিঝড় রিমালের কারণে খামারিরা অনেকটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন৷ তারওপর চোরাই পথে গরু আসতে থাকলে খামারিরা আরো ক্ষতির মুখে পড়বেন বলে শঙ্কা রয়েছে৷
ডেইরি ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. ইমরান হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘২০১৪ সালে যখন ভারত গরু রপ্তানি বন্ধ করে দিল, তখন তো আমাদের ভয়াবহ সংকট হয়েছিল৷ এরপর সরকারের সহযোগিতায় ডেইরি ফার্মগুলো গড়ে উঠেছে৷ ২০১৪ সালে আমাদের চাহিদার তুলনায় উৎপাদন ছিল ৩৫ শতাংশ৷ আর ৬৫ শতাংশই ভারত ও মিয়ানমার থেকে আসত৷''
২০১৯ সালে থেকে দেশে গরু আমদানির প্রয়োজন হয় না বলেও জানালেন তিনি৷ বলেন, ‘‘আমাদের এখন সাড়ে ৩ লাখের মতো ডেইরি ফার্ম আছে৷ তারা দুধ উৎপাদন করেন৷ আর আড়াই লাখের মতো ফার্ম আছে যারা মাংস নিয়ে কাজ করেন৷ দেশে ফার্মগুলো গড়ে উঠায় যে উপকারটা হয়েছে, সেটা হলো আমাদের বছরে এক কোটি ৫৫ লাখ মেট্রিকটন দুধের প্রয়োজন হয়৷ এর মধ্যে ১ কোটি ৪০ লাখ মেট্রিকটন দুধ আমরা উৎপাদন করতে সক্ষম৷ আমাদের ঘাটতি আছে মাত্র ১৬ শতাংশ৷’’
দেশে এখন ৮৪ লাখ মেট্রিক টন মাংসের প্রয়োজন হয় জানান ইমরান হোসেন৷ তিনি বলেন, ‘‘কিন্তু আমরা ৮৯ লাখ মেট্রিকটন মাংস উৎপাদন করছি৷ এরপরও যদি চোরাই পথে গরু আসে তাহলে খামারিরা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন৷ শুধু খামারিরা না, প্রান্তিক কৃষকও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন৷''
তবে চোরাই পথে গরু আসার কথা মানতে রাজি নন প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. মোহাম্মদ রেয়াজুল হক৷ তিনি বলেন, ‘‘যেখানে আমরাই স্বয়ংসম্পূর্ণ সেখানে এগুলো এনে কোথায় বিক্রি করবে? এটা তো আর স্বর্ণ না যে বিক্রি না হলে ঘরে রেখে দিলাম৷ গরু বিক্রি না হলে তাকে তো খাওয়াতে হবে, পালতে হবে৷ ফলে আমার মনে হয় না খুব বেশি গরু সীমান্ত দিয়ে আসছে৷ তবে টুকটাক যে আসছে না, সেটাও আমি বলব না৷’’
ভাটা পড়েছে অনলাইন পশুর হাটে
করোনা মহামারির পর সরকারের আইসিটি বিভাগ ও ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশনের উদ্যোগে ডিজিটাল গরুর হাটের কার্যক্রম শুরু হয়৷ প্রথম বছর অর্থাৎ ২০২০ সালে নানা অভিযোগের পরও অনলাইনে ৪৫ হাজার কোরবানির পশু বিক্রি হয়েছিল৷ ২০২১ সালে অনলাইনে কোরবানির পশু বিক্রি হয় ৩ লাখ ৮৭ হাজারের মতো৷ এরপর থেকে আবার কমতে শুরু করে৷ ২০২২ সালে তা কমে হয় ৬৬ হাজার৷ পরের বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালে ৪৮ হাজারেরও কম পশু অনলাইনে বিক্রি হয়েছে৷
ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক নাসিমা আক্তার নিশা ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘করোনার সময় তো মানুষ দূরত্ব মেনে চলেছেন, এ কারণে বেশি বিক্রি হয়েছে৷ আসলে কোরবানি তো আমাদের আবেগের সঙ্গে জড়িত৷ কোরবানির পশু কিনতে অনেকে ছেলে-মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে যান৷ ১০টা গরু দেখে একটা কেনেন৷ এ কারণে আসলে অনলাইনে গরু কেনাবেচায় আগ্রহ কমে যাচ্ছে৷ তারপরও বড় বড় ফার্মগুলো নিজেরাই অনলাইনে বিক্রি করছেন৷ এজন্য আমরা এবার আর ডিজিটাল হাট করিনি৷’’
সাভার ডেইরি ফার্মের স্বত্বাধিকারী মো. খালেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এখানে আস্থার একটা সংকট আছে৷ কেউ অনলাইনে একটা গরু দেখে কিনল, সেই গরু পরিবহণের সময় অনেক ক্ষেত্রে ওজন ৫-৭ কেজি কমে যায়৷ কিন্তু ক্রেতা মনে করলেন তাকে ঠকানো হয়েছে৷ এছাড়াও ঈদের আগে সড়কে চাঁদাবাজি এবং মহাসড়কে যানজট এই কাজকে আরো কঠিন করে তুলেছে৷ সবকিছু মিলিয়ে অনলাইনে মানুষের আগ্রহ কমে যাচ্ছে৷''
সাদিক এগ্রোর সহ-প্রতিষ্ঠাতা মো. ইমরান হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘গত বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালে অনলাইনে আমরা ১৭৪টি পশু বিক্রি করেছি৷ ২০২২ সালে বিক্রি হয়েছিল ১৫০টি৷ তবে ২০২১ সালে প্রায় এক হাজারের কাছাকাছি পশু অনলাইনে বিক্রি হয়েছিল৷ তবে অনলাইনে মানুষের আগ্রহ কমে যাচ্ছে৷’’