শিক্ষকদের দাবি আদায়
১০ জানুয়ারি ২০১৩আমিনুর রহমানের কর্মজীবন শুরু ২২ বছর আগে৷ সেই থেকে মানুষ গড়ার কাজে নিয়োজিত তিনি৷ ২২ বছরে বেতন ছয় হাজার টাকাও হয়নি৷ এখনও যে রাতারাতি দিন ফিরে যাবে তা-ও নয়৷ কতই বা বেতন বাড়বে? পাঁচ হাজার? তা-ও নয়! নিলফামারির ডিংলা উপজেলার শালংগ্রাম পূর্ব পাড়া রেজি. বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তবু খুব খুশি৷ এই দাবিটুকু আদায়ের জন্য জীবন উৎসর্গ করতেও রাজি ছিলেন তিনি৷ বিখ্যাত কেউ নয়, এক সাধারণ শিক্ষকের সঙ্গেই কথা হলো৷ আর সেই কথপোকথনেই বেরিয়ে এলো কায়ক্লেশে জীবন নির্বাহ করতে অভ্যস্ত এক সরল মানুষের অল্পতেই তুষ্ট হবার অসাধারণ ক্ষমতা৷
মো. আমিনুর রহমান যখন শিক্ষকতা শুরু করেন, তখন বাংলাদেশ স্বৈরশাসন থেকে মুক্তি পাওয়ার পথে৷ তারপর থেকে দেশে শুরু হয়েছে সংসদীয় গণতন্ত্র৷ তাতে জনগণ কী পেয়েছে বা কী কী পায়নি সে আলোচনা অপ্রাসঙ্গিক৷ তবে মো. আমিনুর রহমানের বেলায় তা পুরোপুরি প্রাসঙ্গিক৷ প্রচলিত অর্থে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের যাত্রা শুরুর সময় থেকেই শিক্ষক হিসেবে জীবনসংগ্রাম শুরু তাঁর৷ বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকের তখন থেকেই স্বপ্ন বেতনটা বাড়বে, একটু স্বচ্ছলতা আসবে সংসারে৷ বুধবার প্রধানমন্ত্রীর মুখে স্বপ্ন পূরণের ঘোষণা শুনে তাই তিনি ভীষণ আনন্দিত৷
কিন্তু আমিনুর রহমান নিজেই যে হিসেবটা দিলেন তাতে বেতন চার হাজার টাকাও বাড়বে না৷ বৃদ্ধা মা, স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে নিয়ে দশ জনের সংসার৷ নতুন ঘোষণায় বেতন বড় জোর হবে আট হাজার টাকা৷ ডয়চে ভেলেকে দেয়া সাক্ষাৎকারে নিলফামারির এ শিক্ষক নিঃসংকোচে বলে গেলেন ওইটুকুতেই তাঁর, তাঁর আপনজনদের খুশি হবার কথা৷
এ সময় দাবি আদায়ের আন্দোলনে কতটা মরিয়া ছিলেন সে কথাও জানিয়েছেন নিলফামারির ডিংলা উপজেলার শালংগ্রাম পূর্ব পাড়া রেজি. বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক৷ গত ২১ বছরের আন্দোলনের ইতিহাস না জানলে একজন মানুষের জীবনে ওই তিন-চার হাজার টাকাও যে কত অর্থপূর্ণ, সেটা বোঝা অসম্ভব৷
বুধবার বেসরকারি প্রাথমিক শিক্ষকদের এক মহাসমাবেশে ২৬ হাজার ২০০ বিদ্যালয়ের এক লক্ষ চার হাজার বেসরকারি শিক্ষকের চাকরি জাতীয়করণের ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা৷ তাঁর এ ঘোষণা শিক্ষকদের এক দীর্ঘ আন্দোলনের ফলশ্রুতি৷ বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা চাকরি জাতীয়করণের দাবিতে আন্দোলন করে আসছেন ১৯৯১ সাল থেকে৷ ১৯৯৭ সালে ঢাকার ওসমানী উদ্যানে আমরণ অনশন কর্মসূচিও পালন করেছিলেন তাঁরা৷ কর্মসূচির নবম দিনে শিক্ষকদের দাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করার কথা জানিয়ে তাঁদের অনশন ভাঙান তখনকার প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া৷
২০০০ সালে সেই ওসমানী উদ্যানেই শিক্ষকরা মহাসমাবেশ করেন একই দাবিতে৷ তখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন শেখ হাসিনা৷ তিনি তখন শিক্ষকদের দাবি দলের নির্বাচনী ইশতেহারে রাখার ঘোষণা দেন, যার অর্থ, আবারো ক্ষমতায় এলে ব্যবস্থা নেয়া হবে৷ কিন্তু তারপরও কাজ হয়নি৷ তাই আন্দোলন চলতে থাকে৷ বর্তমান সরকারের আমলে ২০১১ সালের ২১ থেকে ২৭শে ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অবস্থান ধর্মঘট, অনশনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষকরা৷ তারপরও দাবি আদায় না হওয়ায়, ২০১২ সালের জানুয়ারি মাসে দেশের সব বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তালা ঝুলিয়ে ধর্মঘট পালন করা হয়৷ ১৭ থেকে ১৯শে জানুয়ারি পর্যন্ত চলে কর্ম বিরতি৷ সরকারের তরফ থেকে তারপরও কোনো সাড়া না পেয়ে শিক্ষকরা ১৩ থেকে ১৮ই মে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অবস্থান কর্মসূচি, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় অভিমূখে পদযাত্রা, স্মারকলিপি প্রদানসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেন৷ এসব কর্মসূচি পালনের সময় পুলিশের পিটুনিতে আহত এক শিক্ষক পরে মারাও গিয়েছিলেন৷
এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আশ্বাস দিয়েছিলেন, শিগগিরই শিক্ষক মহাসমাবেশ থেকে বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জাতীয়করণের ঘোষণা দেওয়া হবে৷ অবশেষে বুধবার এলো সেই ঘোষণা৷ নিলফামারি থেকে পকেটের টাকা খরচ করে এসে ঘোষণাটা নিজের কানে শুনে আমিনুর রহমান আপ্লুত৷ জানালেন, এই দাবি আদায়ের জন্য কাফনের কাপড় পরেছেন, ভেবে রেখেছিলেন আমৃত্যু চালিয়ে যাবেন দাবি আদায়ের এ আন্দোলন৷ অবশেষে সেই দাবি যে আদায় হয়েছে আমিনুর রহমানের কাছে এটাই সবচেয়ে বড় স্বস্তির৷ দ্রব্যের অগ্নিমূল্যের এ বাজারে মাসিক বেতন আট হাজার টাকা হলেই তাঁর চলে যাবে – ডয়চে ভেলেকে দেয়া সাক্ষাৎকারে এ কথা নিশ্চিন্তে বলে দিলেন আমিনুর রহমান!