এক মিটিংয়েই মান ভাঙবে শুভেন্দুর?
২ ডিসেম্বর ২০২০ঘুঁটে পোড়ে গোবর হাসে। বহুদিনের প্রবাদ। সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে সে ঘটনাই ঘটছে। যে শুভেন্দু অধিকারীকে দিনের পর দিন ধরে দলে একঘরে করার চেষ্টা করছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, সেই শুভেন্দুরই হাত জড়িয়ে ধরতে হলো তাঁকে। বলতে হলো, দলের স্বার্থে নির্বাচনের আগে তিনি যেন তৃণমূল না ছাড়েন। ঘটনাস্থলে উপস্থিত তৃণমূলের প্রবীণ অন্য দুই নেতা বলেছেন, দীর্ঘ বৈঠকের ফলাফল ইতিবাচক। শুভেন্দু দল ছাড়ছেন না। কিন্তু শুভেন্দু কী বলছেন? এখনো স্পষ্ট নয়। এত দ্রুত স্পষ্ট হওয়ার কথাও নয়।
দিন দু'য়েক আগে মমতার সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীপদ ছেড়েছিলেন শুভেন্দু। জল্পনা শুরু হয়েছিল, তা হলে কি এ বার দল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেবেন তিনি? শুভেন্দুর সঙ্গে বিজেপির যে আলোচনা চলছে, সে খবর নতুন নয়। বস্তুত, লোকসভা নির্বাচনের আগে থেকেই দুই তরফ একাধিকবার বৈঠক করেছে বলে দুর্জনেরা দাবি করেন। শুভেন্দু বা বিজেপি প্রকাশ্যে সে কথা স্বীকার না করলেও ব্যক্তিগত স্তরে নেতারা তা মেনে নেন। বিজেপির গুরুত্বপূর্ণ নেতারা এমন দাবিও করেছেন যে, সময় এবং সুযোগ বুঝে শুভেন্দু বিজেপিতে যোগ দেবেন। সেই পরিস্থিতিই তৈরি হয়েছিল। বিধানসভা নির্বাচনের আগে শুভেন্দু মন্ত্রিত্ব ছাড়া মানে বিজেপিতে যোগ দেয়া-- সহজ পাটিগণিত অনেকেই কষে ফেলেছিলেন। কিন্তু শুভেন্দু পাটিগণিত নয়, রাজনীতির অঙ্ক কষছেন। ফলে বিজেপিতে যাননি। চুপচাপ বসে জল মাপছেন। সে সময়েরই সদ্ব্যবহার ঘটানোর চেষ্টা করেছেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। মঙ্গলবার রাতে শ্যামবাজারের একটি বাড়িতে শুভেন্দুর সঙ্গে বৈঠকে হাত ধরে দলে থেকে যাওয়ার অনুরোধ করেন তিনি। সেখানে উপস্থিত ছিলেন তৃণমূলের দুই বর্ষীয়ান নেতা সৌগত রায় এবং সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। ছিলেন, তৃণমূলের রাজনৈতিক সহায়ক প্রশান্ত কিশোর। বৈঠক শেষে সৌগতবাবু সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, আলোচনা ফলপ্রসূ হয়েছে। মানঅভিমান কেটে গিয়েছে।
সত্যিই কি কেটেছে? কাটা আদৌ কি সম্ভব? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে শুভেন্দুর ঘনিষ্ঠতা নন্দীগ্রাম পর্বে। নন্দীগ্রাম আন্দোলনে শুভেন্দুকে ভরসা করেছিলেন তৃণমূলনেত্রী। শুভেন্দু সেই ভরসার ষোলোআনা মর্যাদা দিয়েছেন। ক্রমশ মেদিনীপুরের একমেবদ্বিতীয়ম নায়ক হয়ে উঠেছেন তিনি এবং অধিকারী পরিবার। তৃণমূলেও ক্রমশ তাঁর গুরুত্ব বেড়েছে। দলের যুব সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ কাজ সামলেছেন তিনি। কিন্তু পরবর্তীকালে ওই যুব সংগঠন ঘিরেই তাঁর সঙ্গে সংঘাত শুরু হয় মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপো অভিষেকের। ক্রমশ সেই সংঘাত বেড়েছে। মমতা চাইলে আগেই তার সমাধান করতে পারতেন। অভিষেকের সঙ্গে শুভেন্দুর রফা করাতে পারতেন। শুভেন্দুকে বুঝিয়ে দিতে পারতেন, দলে তাঁর গুরুত্ব আগের মতোই আছে। কিন্তু মমতা কিংবা তৃণমূল নেতৃত্ব সে কাজ করেনি। বরং কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো নেতা প্রকাশ্যে শুভেন্দুর সমালোচনা করেছেন।
দুর্জনেরা বলেন, লোকসভা নির্বাচনে মালদা, হুগলি, পশ্চিম মেদিনীপুরে তৃণমূলের খারাপ ফলের পিছনে শুভেন্দুর কলকাঠি ছিল। যদিও শুভেন্দু তা বরাবরই অস্বীকার করেছেন। ওই অঞ্চলগুলিতে শুভেন্দুর ব্যাপক সমর্থন রয়েছে। বিধানসভা নির্বাচনের আগে তিনি দল ছেড়ে বেড়িয়ে গেলে পঞ্চাশেরও বেশি আসনে তৃণমূল বিড়ম্বনায় পড়বে। এ কথা শুভেন্দুর থেকেও ভালো জানেন তৃণমূল নেতৃত্ব। ফলে শেষবেলায় মানভঞ্জনের চেষ্টা চলছে। শুভেন্দুকে যাঁরা ব্যক্তিগত স্তরে চেনেন, তাঁরা জানেন, শুভেন্দু রাজনীতি মাখেন, রাজনীতি খান, রাজনীতিতে ঘুমোন। রাজনীতির জন্য দামি ঘড়ি পরার শখ মুহূর্তে ছেড়ে দিতে পারেন। ব্যক্তিগত শখ-আহ্লাদ বিসর্জন দিতে পারেন। সেই শুভেন্দু এক বৈঠকে গলে জল হয়ে যাবেন, এমন ভাবার কারণ নেই। ঠিক যেমন ভাবার কারণ নেই যে, তিনি বিজেপিতে যোগ দেবেন। শুভেন্দু ঘনিষ্ঠ কেউ কেউ এখনো মনে করেন, ভোটের ঠিক আগে শুভেন্দু আলাদা দল তৈরি করতে পারেন। তৃণমূল ভাঙা যে দল পুরনো তৃণমূলের বার্তা নিয়ে পৌঁছবে মানুষের কাছে। ভোটের পরে তারা কাকে সমর্থন করবে, সেই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
হতেই পারে, মঙ্গলবারের বৈঠকের পর শুভেন্দু দলে থেকে গেলেন। বৈঠকে অভিষেকের ফোন থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গেও তাঁর কথা হয়েছে বলে কোনো কোনো সূত্র জানাচ্ছে। হতে পারে 'দিদি'র কথা ফেলতে পারবেন না শুভেন্দু। কিন্তু বিষয়টি যে খুব সহজ নয়, তা সকলেই বুঝতে পারঠছেন। ভোট যত এগোবে, খেলা তত জমবে, এমনই মনে করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের একটি বড় অংশ।