1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

‘এখনো যেটুকু জমি পাহাড়ের মানুষের আছে, তা যেন তাদের থাকে'

১৪ এপ্রিল ২০২৩

পার্বত্য চট্টগ্রামে রক্তপাত থামানো যাচ্ছে না কেন? সেখানে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বন্ধের উপায়? কীভাবে ফিরবে সেখানে শান্তি? এসব বিষয় নিয়ে ডয়চে ভেলের সঙ্গে কথা বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মেজবাহ কামাল।

https://p.dw.com/p/4Q5Ch
পৃথিবীর বহু দেশেই তো আদিবাসীদের জন্য নির্ধারিত সীমানা আছে
পৃথিবীর বহু দেশেই তো আদিবাসীদের জন্য নির্ধারিত সীমানা আছেছবি: DW/M. Mamun

ডয়চে ভেলে : প্রায়ই পাহাড়ে রক্ত ঝরছে, কেন বন্ধ করা যাচ্ছে না এই রক্তপাত?

অধ্যাপক মেজবাহ কামাল : পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্যই তো ১৯৯৭ সালে পার্বত্য শান্তি চুক্তি হয়েছিল। শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নে গড়িমসি পার্বত্য চট্টগ্রামে নতুন হতাশার জন্ম দিয়েছে। এছাড়া রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বিভক্তকরণ ও শাসনকরণ নীতি বাস্তবায়নের জন্য নতুন নতুন বিভক্তিকে উৎসাহিত করা হয়েছে। এর ফলে পাহাড়ে উপ-দলের সংখ্যা বেড়েছে। ২০০৭ সালের আগের সরকারগুলো এখানে সহিংসতা দমনে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়নি। এছাড়া মিয়ানমানের বিভিন্ন সশস্ত্র দলের তৎপরতা এখনও সেখানে আছে। সবকিছু মিলিয়েই পার্বত্য চট্টগ্রামে পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে, রক্ত ঝরছে।

আমরা তো দেখছি, পাহাড়িদের  দুই গ্রুপের মধ্যে এই সংঘাত। এর পেছনে কোনো ইন্ধন আছে?

আমি তো প্রথমেই বলেছি, পাহাড়ে যে সংঘাত সেখানে রাষ্ট্রের ইন্ধন আছে। এখানে পাহাড়িদের সমমর্যাদায় অভিসিক্ত করার কাজটাকে গুরুত্ব না দিয়ে তাদের বিভক্তকরণ ও শাসনকরণ নীতি অনুসরণ করা হচ্ছে। তাদের বিভক্ত করার কাজটা চলছে বলেই এখানে সংঘাতটা বাড়ছে।

পার্বত্য শান্তি চুক্তি কি তাহলে কোনো কাজে আসেনি?

শান্তি চুক্তি হয়েছে বলেই তো রাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের যে সহিংসতা, সেটা বন্ধ হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে বেশ কিছু উন্নয়নমূলক কাজ করা গেছে। সমতলের মানুষের জন্য সেখানে চলাচল অবারিত হয়েছে। সেটা তো পার্বত্য শান্তি চুক্তির কারণেই। এছাড়া এক ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে উঠেছে। যেমন, পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ, তিন পার্বত্য জেলায় জেলা পরিষদ গড়ে উঠেছে। কিন্তু এগুলোকে কার্যকর করার জন্য যে সমস্ত পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, ওই প্রতিষ্ঠানগুলোকে ক্ষমতায়নের জন্য যেসব বিধি প্রবিধি দরকার, সেগুলো ২৫ বছরেও তৈরি হয়নি। এগুলো যতটা হলে সেখানে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হতো, ততটা হয়নি। তবে কিছুটা তো অগ্রগতি হয়েছে বটেই।

সন্ত্রাসী কার্যকলাপের সঙ্গে কি সাধারণ পাহাড়িদের সংশ্লিষ্টতা আছে?

সাধারণ মানুষের সংশ্লিষ্টতা তো কখনোই থাকে না। এটা কতিপয়ের কাজ। আপনি যদি পার্বত্য এলাকাগুলোর থানায় খোঁজ নেন, তাহলে দেখবেন সারাবছর সেখানে ক'টা মামলা হয়৷ আমি নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারি, সমতলের যে কোনো থানার চেয়ে সেখানে মামলার সংখ্যা কম। কিন্তু এগুলো মূল বিষয় নয়। মূল বিষয় হলো, পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষের যে অধিকার এবং তারা যে ভিন্ন জাতিসত্ত্বার মানুষ, কিন্তু বাংলাদেশের নাগরিক তাদের সেই সমঅধিকার দিতে পারছি না।

এখন তো পাহাড়ে জঙ্গি আস্তানা বা জঙ্গিদের প্রশিক্ষণের খবরও পাওয়া যাচ্ছে৷ তাহলে কি পাহাড়ি সন্ত্রাসী ও জঙ্গিরা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে?

সাধারণভাবে এটা মিলিয়ে ফেলা যাবে না। তবে নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে তো বটেই, এই যে কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট, ওরা যখন এনজিও হিসেবে কাজ করেছে, তখন তো রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা, সমর্থন তারা পেয়েছে। একটা পর্যায়ে গিয়ে তাদের মধ্যে রেডিক্যালাইজেশন হচ্ছিল। ভারতের কিছু অংশ, মিয়ারমারের কিছু অংশ ও বাংলাদেশের কিছু অংশ নিয়ে তারা যে কুকি চিন রাষ্ট্র তৈরি করার অদ্ভুত ও অবাস্তব চিন্তা শুরু করে। এদের একটা গ্রুপ মিয়ানমারে গিয়ে প্রশিক্ষণও নিয়ে আসে। এরপর যখন তাদের চিন্তায় পরিবর্তন আসে, তখন দেখা গেল তারা মৌলবাদীদের সঙ্গে টাকার বিনিময়ে একটা চুক্তি করে ফেললো। ফলে বাধ্য হয়ে আমাদের সশস্ত্র বাহিনীকে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হচ্ছে। ফলে এখানে পর্বত্য এলাকার সবগুলো ধারার সঙ্গে মৌলবাদীদের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে সেটা বলা যাবে না। এটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা।

ভূমি সমস্যার সমাধান কেনা করা হয় না?

পার্বত্য চট্টগ্রামে আমাদের সুবিধাপ্রাপ্তির ব্যাপার তৈরি হয়েছে। ১৯০০ সালের শাসনবিধিকে লঙ্ঘন করে দীর্ঘকাল যাবত সেখানে ভূমির বন্দোবস্ত দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ব্যবসায়ীরা তো আছেনই। সেখানে সামরিক, বেসামরিক আমলারা বরাদ্দ পেয়েছেন। এমনকি শিক্ষক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবিসহ বিভিন্ন পেশার মানুষের নামে জমি বরাদ্দ হয়েছে। সেই বরাদ্দকৃত জমির কাগজ নিয়ে গিয়ে ব্যাংকে জমা দিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যাংক থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে। ওখানে যে বনজ সম্পদ ও খনিজ সম্পদ আছে, তাতেও কিন্তু ন্যায্যতার সংকট আছে। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী সেখানে স্থানীয় মানুষের সঙ্গে এটা শেয়ার করতে হবে। সেটা আমাদের রাষ্ট্রের কর্ণধাররা করতে চান না। সেই কারণে সেখানে ভূমি সমস্যার সমাধান হয় না। সমতল থেকে চার লাখ গরিব মানুষকে সেখানে পাঠিয়ে জমির বন্দোবস্ত দেওয়া হয়েছে। ফলে পরিস্থিতি আরো জটিল হয়েছে।

'২০০৭ সালের আগের সরকারগুলো সহিংসতা দমনে ব্যবস্থা নেয়নি'

পাহাড়ি-বাঙালি দ্বন্দ্ব তো বেশ পুরোনো, এটা কি ইচ্ছে করেই জিইয়ে রাখা হয়েছে?

পাহাড়ি-বাঙালি দ্বন্দ্ব অনেক পুরোনো সেটা আমি মনে করি না। বাঙালিদের তো এক সময় পাহাড়িরাই আমন্ত্রণ করে নিয়ে গেছেন, জমি চাষাবাদের প্রয়োজনে। সম্পর্কটা সুসম্পর্কই ছিল। সেখানে আদি ও স্থায়ী বাঙালি তো বরাবরই ছিল। রাজনৈতিক বিবেচনার ক্ষেত্রে তাদের সংখ্যালঘুকরণের উদ্যোগ এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে ধর্মীয় আধিপত্য প্রতিষ্ঠার তাগিদ থেকে এখানে যখন থেকে সেটেলার কার্যক্রম শুরু হলো, তখন থেকেই সংকটা ঘনীভূত হলো। ফলে আমি মনে করি, এখনো যে জমিটা পাহাড়ের মানুষের হাতে আছে, সেটা যেন তাদের হাতে থাকে এবং তাদের বেঁচে থাকার জন্য যে পরিসরটুকু দরকার সেটা যেন তাদের নিয়ন্ত্রণে ছেড়ে দেওয়া হয়। নিয়ন্ত্রণ বলতে আমি যেটা বুঝাতে চাইছি, সেখানে যেন অন্যদের প্রবেশাধিকার সীমিত করা হয়। পৃথিবীর বহু দেশেই তো আদিবাসীদের জন্য নির্ধারিত সীমানা আছে। সেখানে তো অন্যদের প্রবেশাধিকার বা জমি ক্রয়-বিক্রয় নিষেধ বা সীমিত। সেটা করে ফেললেই তো হয়। এটা হলে তো আদিবাসীদের জীবন নিরঙ্কুশ করা যায়।

পাহাড় থেকে সেনাবাহিনী প্রত্যাহারের দাবি পাহাড়িদের, পাহাড়ে সেনাবাহিনী না থাকলে কি পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারে? নাকি অবস্থার উন্নতি হবে?

পার্বত্য শান্তি চুক্তিতে কিন্তু বলা হয়েছে, সেখানে ৬টা ক্যান্টনমেন্ট থাকবে। অর্থাৎ, তিন জেলায় দু'টি করে ক্যান্টনমেন্ট হবে। এতে তো পাহাড়িদের কোনো আপত্তি নেই। সেখানে যেটা বলা ছিল, জালের মতো যে ক্যাম্পগুলো আছে, সেগুলো গুটিয়ে সেনাসদস্যদের ক্যান্টনমেন্টে ফিরিয়ে আনতে হবে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য অন্যান্য যে বাহিনীগুলো থাকে, সেগুলো থাকবে। বরং শান্তি চুক্তিতে যেটা ছিল, এই কাজে পাহাড়িদের সংযুক্ত করতে হবে। কারণ, তারা এলাকা চেনে, মানুষ চেনে। সেখানে একটা স্থানীয় পুলিশ বাহিনী গঠন করার কথা ছিল। বৃটিশ আমলে তো স্থানীয় পুলিশ বাহিনী ছিল, যেটা পাকিস্তান ১৯৪৮ সালে নিষিদ্ধ করেছে। সেটাই পুনঃপ্রবর্তন করার কথা বলা হয়েছিল। সেটা করলেও তো সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠায় তারা সহায়ক হিসেবে কাজ করতে পারে।

পাহাড়ে কীভাবে শান্তি ফিরতে পারে?

আমি মনে করি, ১৯৯৭ সালের শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন করতে হবে।যে এলাকাগুলোতে পাহাড়িরা আছে, সেখানে অন্যদের এনক্লোজমেন্ট বন্ধ করে দিতে হবে। আর পাহাড়িরা তো দাবি করে, বাঙালিদের যেখান থেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, সেখানে তাদের ফেরত পাঠাতে হবে। সেটা করা কতটা সম্ভব সেটা হয়ত দায়িত্বশীলরা দেখবেন। তবে এই দাবি তারা কেন করেন সেটা তো বুঝতে হবে। কারণ, তাদের বেঁচে থাকার অবলম্বন ক্রমাগত সংকুচিত হয়ে আসছে। সেখানে কিন্তু মাথাপিছু আবাদযোগ্য জমি সমতলের চেয়ে কম। ফলে তাদের তো বাঁচতে হবে। তাদের পেটে লাথি মেরে তো আমরা সেখানে কর্তৃত্ব করতে পারবো না। আমরা সেখানে সকল জাতিসত্ত্বার সমানাধিকার নিশ্চিত করতে পারছি না। আমরা এখনো এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র, বিকেন্দ্রীকরণ করতে পারছি না। মনোকালচারের জায়গায় যদি মাল্টিকালচারাল রাষ্ট্র করা যায়, একটা বহুজাতির রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া যায় এবং স্থানীয় মানুষের জমি, জল, জঙ্গলের উপর অধিকারকে স্বীকৃতি দিলে আমি মনে করি সম্প্রীতির অবহ গড়ে উঠবে। আমরা সবাই বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে সমমর্যাদায় বাস করতে পারবো এবং এই নিশ্চয়তাটুকু পেলেই পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে।

ডয়চে ভেলের ঢাকা প্রতিনিধি সমীর কুমার দে৷
সমীর কুমার দে ডয়চে ভেলের ঢাকা প্রতিনিধি৷