এবার বিচার হতে হবে এবং হবে: পংকজ নাথ
২২ অক্টোবর ২০২১‘‘আগে যে ঘটনাগুলো ঘটেছে সেগুলোতে নানা দোষারোপের রাজনীতি হয়েছে৷ কিন্তু এবারের ঘটনা স্পষ্ট৷ এটা বিএনপি বা জামাত এবং বাংলাদেশ বিরোধী অপশক্তি আওয়ামী লীগের ভাবমুর্তি বিনষ্ট করার জন্য এটি ঘটিয়েছে৷ এবার এদের বিচার হতে হবে এবং হবে৷’’ সম্প্রতি দেশে সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনায় ডয়চে ভেলের সঙ্গে আলাপকালে এমন মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য পংকজ নাথ৷
ডয়চে ভেলে : পূজার সময় তো পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়, তারপরও কীভাবে এই হামলা হলো?
পংকজ নাথ : নিরাপত্তা দিয়ে তো আর পূজা হয় না, এটা তো একটা উৎসব৷ যারা হামলাকারী, দূর্বৃত্ত তারা অনেক বেশি রাজনৈতিকভাবে প্রতিক্রিয়াশীল৷ তারা পুলিশ পাহারা বা নিরাপত্তা এসবকে থোড়াই কেয়ার করে৷ এটা আসলে স্পর্শকাতর একটা ইস্যু৷ দীর্ঘদিনের ঠান্ডা মাথার এটা পরিকল্পনা৷ হিন্দুদের মন্দিরে কোরআর শরীফ রাখা, এটা সত্য যে বাংলাদেশের মানুষ অনেক বেশি ধর্মবিশ্বাসী৷ এই মানুষগুলোর মধ্যে তথ্য প্রযুক্তির অপব্যবহার করে বিদ্বেষ ছড়ানো হল৷ বাংলাদেশের ধর্মবিশ্বাসী কোন মুসলমান তার পবিত্র ধর্মগ্রন্থ মন্দিরে রাখবে না৷ আবার এটাও সত্য যে, ধর্মবিশ্বাসী কোন হিন্দু ওই পবিত্র কোরআন শরীফ স্পর্শ করবে না, মন্দিরে নেবে না৷ যে এটা করেছে সে আমাদের স্বাধীনতার যে মূল ভিত্তি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের মূলে আঘাতটা করেছে৷ সেটিকে কেন্দ্র করে নাশকতার সুযোগটা তৈরি করা হল৷ আমরা দেখেছি, বিএনপি এমনকি জাতীয় পার্টির আমলেও স্বাধীনতা বিরোধী জামাত-শিবিরকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে৷ সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে৷ তারাই সময়ে সময়ে এই অপব্যবহারগুলো করেছে৷ আমরা মনে করি, বিএনপি এবং জামাতের ছত্রছায়ায় এই দুর্বৃত্তরা এই দুঃসাহস দেখিয়েছে৷
পূজার সময় হামলার ঘটনার পর তো প্রশাসন অনেক বেশি সতর্ক ছিল, গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও তো এসব ব্যাপারে খোঁজ খবর রাখে৷ তারপরও কীভাবে রংপুরে হামলার ঘটনা ঘটল?
রংপুরের ঘটনাটি একেবারেই ভিন্ন৷ এটা অনেকটা, সুনামগঞ্জ-নাসিরনগরের মতো৷ পূজার সময় তো কোরআন শরীফের ধুঁয়া তুলে এটা করা হয়েছে, আর রংপুরের ঘটনা কাবা শরীফকে অবমাননা করা হয়েছে এটা সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়ে৷ রামুতে যে হামলা হয়েছিল, সেটা তো পাশ্ববর্তী উপজেলা থেকে বিএনপি-জামাতের লোকজন গিয়ে করেছিল৷ রংপুরেও তাই হয়েছে৷ পীরগঞ্জে যারা আক্রান্ত হয়েছে তারা একেবারেই সাধারণ খেটে খাওয়া জেলে৷ তারা হতদরিদ্র মানুষ৷ তারা আক্রমনের লক্ষ্যবস্তু হওয়ার কথাও না৷ সেখানে মন্দিরও নেই৷ শুধুমাত্র সরকারকে বিব্রত করার জন্য আর বর্হিবিশ্বে সরকারের ভাবমুর্তি ক্ষুন্ন করার জন্য এটা করা হয়েছে৷ এই ধরনের ঘটনা কিন্তু আগেও কয়েকবার হয়েছে৷ ফলে এখন এই অপশক্তিকে নতুনভাবে চিহ্নিত করতে হবে৷ আমরা তো বিএনপিকে চিনি, জামাতকে চিনি, হেফাজতকেও চিনি৷ এই দুর্বৃত্তরা সাধারণ মানুষের সরল বিশ্বাসকে পুজি করে গুজব ছড়িয়ে এটা করছে৷ দেশ এবং বিদেশ থেকেও এই গুজব ছড়ানো হচ্ছে৷ এই গ্রুপগুলোর এখন মূল উৎপাটন করা দরকার৷
রাষ্ট্রযন্ত্র বা প্রশাসনের উদাসীনতা বা আশ্রয়-প্রশ্রয় ছাড়া কী সাম্প্রদায়িক হামলা সম্ভব?
রাষ্ট্রযন্ত্রের আশ্রয়-প্রশ্রয় না, কোন অঘটন ঘটলে সরকারের দিকেই দায়টা যায়৷ সে কারণে সরকার কোন ঘটনা ঘটাবে না৷ বা সরকার খুব বেশি উদাসীন থাকবে সে সুযোগ নেই৷ এই ধরনের ঘটনা তো কখনও পূজোর সময় ঘটেনি৷ নোয়াখালি, কুমিল্লা, ফেনী ঘুরে আমি এখন পথে, ঢাকায় ফিরছি৷ কুমিল্লার ওই স্পটটিতে আমি গিয়েছিলাম৷ ওটা হিন্দু অধ্যুষিত একটা নিভৃত গ্রাম৷ ছোট্ট একটা মন্দির৷ গরীব মানুষ৷ সেখানে ওরা টিনের ঘরগুলো কুপিয়েছে৷ একটা ছেলের চোখে কোপ দিয়েছে৷ সে আদৌ বাঁচবে কি-না জানি না৷ ওরা টার্গেট করে হামলা করেছে৷ প্রধানমন্ত্রী তার সর্বশেষ বক্তৃতায় বলেছেন, হিন্দুরা আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়৷ এটা সর্বজন স্বীকৃত৷ এই ভোটারদের নিরবে বা সরবে দেশ ছাড়তে বাধ্য করার যে সুগভীর চক্রান্ত সেটা বিএনপি জামাত করছে বলেই আমার মনে হয়েছে৷ এই আঘাতগুলো করা হয়েছে যাতে হিন্দুরা নিরবে দেশত্যাগ করে৷
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাবে আমরা দেখলাম, গত ৯ বছরে সাড়ে তিন হাজারেরও বেশি হিন্দুদের বাড়ি-মন্দিরে হামলা হয়েছে৷ এখন পর্যন্ত কী কোন ঘটনার বিচার হয়েছে?
এই হিসাবটা আমিও দেখেছি৷ সংখ্যায় আমি যাচ্ছি না৷ ঘটনা যে ঘটেনি, তা নয়৷ ঘটনা ঘটেছে৷ দুর্বৃত্তদের পৃষ্ঠপোষকতা দেয় বিএনপি-জামাত৷ আওয়ামী লীগ চেষ্টা করছে মাইনরিটিদের প্রটেকশন দেওয়ার৷ মাইনরিটিরা আওয়ামী লীগের ভোট ব্যাংক৷ সে কারণে আওয়ামী লীগ কখনই মাইনরিটিদের নির্যাতন করে না৷ সংখ্যালঘুদের দেশ ছাড়া করা এটা বিএনপি-জামাতের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত৷ আগেও তারা করেছে৷
বিএনপি তো দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় নেই৷ এখন তো আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়৷ এখন কী বিএনপির সেই সামর্থ্য আছে যে, এভাবে পরিকল্পিতভাবে হিন্দুদের বাড়ি-মন্দিরে হামলা করবে? তারা তো রাজপথেই আন্দোলন করতে পারছে না, ফলে এই ধরনের কাজের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সুযোগ আছে কি-না বিএনপির?
রাজপথে আন্দোলন করার শক্তি নেই বলেই তো তারা এই ধরনের ষড়যন্ত্রের পথ বেছে নিয়েছে৷ রামু থেকে শুরু করে সবগুলো ঘটনাতে যদি আপনি যান, তাহলে দেখবেন সমাজের যে প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী তারাই বিএনপি জামাত৷ সবাই তো মনে করে হুজুররা এটা করছে, আসলে হুজুররা যে সব করছে তা নয়৷ এখন কিন্তু বিএনপি জামাতের প্রকাশ্য রাজনৈতিক চর্চা নেই৷ কিন্তু তারা যে থেমে আছে সেটা ভাবার তো কোন কারণ নেই৷ এখানে তো মাদ্রাসা শিক্ষার একটা লেভেল ধরে রীতিমতো জামাতের কর্মী প্রোডাকশন হচ্ছে৷ জামাত-শিবির অধ্যুষিত মাদ্রাসাগুলো থেকে লোকজন এনে ওরা এই হামলাগুলো করাচ্ছে৷ ফেনীর বড় মসজিদ-বড় মন্দির একেবারে পাশাপাশি৷ যুগ যুগ ধরে এটা চলে আসছে৷ কোনদিন কিছু হয়নি৷ কিন্তু ওইদিন সিঁড়িতে দুই-তিনশ’ লোক বসা ছিল৷ এরা কারা কেউ খেয়াল করতে পারিনি৷ তাই ওই লোকগুলো গিয়ে মন্দিরে হামলা করল৷ নোয়াখালিতেও স্থানীয় কোন লোক এই হামলায় অংশগ্রহন করেনি৷ পীরগঞ্জেও লাল হেলমেট পরা লোকগুলো বাইরে থেকে এসেছে৷ ওরা এভাবেই হামলাগুলো করে৷ ওদের পরিকল্পনা হিন্দুদের মনটা ভেঙে দেওয়া৷
বিএনপি-জামাত যদি হামলাকারী হয়, তাহলে এতদিনে আপনারা কাউকে কেন বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পারেননি?
আগে যে ঘটনাগুলো ঘটেছে সেগুলোতে নানা দোষারোপের রাজনীতি হয়েছে৷ কিন্তু আমরা আশাবাদি এবারের ঘটনা স্পষ্ট৷ এটা বিএনপি বা জামাত এবং বাংলাদেশ বিরোধী অপশক্তি আওয়ামী লীগের ভাবমুর্তি বিনস্ট করার জন্য এটি ঘটিয়েছে৷ প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে কিন্তু সেটা ফুটে উঠেছে৷ তিনি খুব স্পষ্ট বলেছেন, এমন শাস্তি দেবো যাতে জীবনে আর এটা করার সাহস না পায়৷ প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের মধ্যে পরিস্কার বিষয়টি তিনি সিরিয়াসলি নিয়েছেন৷ আমাদের বুঝতে হবে, যে কোন অস্বাভাবিক ঘটনাই হলো ষড়যন্ত্র৷
আমরা দেখছি, এই ঘটনাগুলোতে প্রশাসন অপরাধীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পারছে না৷ কিন্তু দল হিসেবে আওয়ামী লীগ এসব হামলার ঘটনায় কী পদক্ষেপ নিচ্ছে?
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর ২১ বছর কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল না৷ বিএনপি-জাতীয় পার্টি দেশ চালিয়েছে৷ বাংলাদেশে কিন্তু এখন রাজনৈতিক-সংস্কৃতিক আন্দোলনের বাইরে গিয়ে হঠাৎ করে একটা ধারা তৈরি হয়ে গেল, সেটা হল হেফাজত ধারা৷ এই হেফাজতি ধারা কিন্তু গণতন্ত্রের জন্য কল্যাণকর না৷ আমরা যখন বঙ্গবন্ধুর খুনিদের, যুদ্ধপরাধীদের বিচারের জন্য ব্যস্ত ওই সুযোগে হেফাজতি ধারা তৈরী হয়েছে৷ এই হেফাজতকে কেন্দ্র করে নানামুখী প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী গড়ে উঠল৷ বিএনপি জামাতের কিছু লোকও হেফাজতের কাঁধে ভর করে নাশকতা করল৷ এখন তো আমরা তাদের চিনেছি৷ এখন প্রশাসন ও সরকারের যে কমিটমেন্ট সেটা এদের মূল উৎপাটন করা৷ এবার সেটা হবে৷
কওমী মাদ্রাসার স্বীকৃতি দিয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার৷ আপনি তো বিএনপির সঙ্গে এদের সখ্যের কথা বলছেন, কিন্তু আমরা তো হেফাজতের সাবেক আমীর মাওলানা আহমেদ শফীর সঙ্গে আওয়ামী লীগের সখ্যও দেখেছি?
আপনারা যে হেফাজতের সঙ্গে সরকারের বা আওয়ামী লীগের সখ্যের কথা বলছেন, সেখানে কিন্তু মানবিক বিবেচনার বিষয় ছিল৷ সরকারের অভিভাবক হিসেবে এবং দায়িত্বশীল নেতা হিসেবে প্রধানমন্ত্রী যেটা করেছেন, যারা কওমী মাদ্রাসায় পড়ত তাদের একাডেমিক কোন স্বীকৃতি ছিল না৷ সরকারি চাকরি হতো না৷ ইমাম, মুয়াজ্জেম আর মাদ্রাসার শিক্ষকতা ছাড়া আর কিছুই করতে পারত না৷ এদের এখন একটা সিস্টেমে আনার মধ্য দিয়ে জবাবদিহির জায়গাটা নিশ্চিত করা যাবে৷ সেক্ষেত্রে আপনারা সখ্য মনে করতে পারেন৷
বিচার না হওয়ায় হামলাকারীরা কী আরও বেশি সাহসী হয়ে উঠছে না?
আমরা তো মনে করি, এবার বিচার হতে হবে এবং বিচার হবে৷
সাম্প্রদায়িক হামলার সঙ্গে জড়িত কেউ কেউ তো স্থানীয় সরকার নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাচ্ছেন? যদিও পরে বাদ দেওয়া হয়েছে৷ কিন্তু তারা মনোনয়ন পায় কীভাবে? আওয়ামী লীগের মতো এত বড় রাজনৈতিক দলে এগুলো কী বিচার বিশ্লেষণ করার কোন প্রক্রিয়া নেই?
বিচার বিশ্লেষণ করা হয়েছে বলেই তো তারা বাদ পড়েছে৷ আওয়ামী লীগ কোন দূর্বৃত্তকে প্রশ্রয় দেবে না৷ যখনই এটা জানা গেছে, তখনই তাদের বাদ দেওয়া হয়েছে৷
মিডিয়াতে আসার পরে তো আপনারা বাদ দিলেন৷ কিন্তু এরা মনোনয়ন পেল কীভাবে?
আওয়ামী লীগ যে গণতান্ত্রিক চর্চাটা করে, সেখানে একজনের নাম একেবারে ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা থেকে মনোনয়ন আসবে৷ আমাদের সাধারণ সম্পাদক কিন্তু বলেছেন, যারা এগুলো জেনে বা না জেনে এটা করেছেন সেগুলো সংশোধন করা হবে৷ কেউ যদি জেনে শুনে অন্যায় করে থাকে তাহলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে৷
যারা জেনেশুনে এই ধরনের অন্যায় করে তাদের বিরুদ্ধে কী আপনারা কখনও ব্যবস্থা নিয়েছেন?
অবশ্যই৷ আওয়ামী লীগ থেকে বহু কর্মী সাময়িক বহিষ্কার, পরে স্থায়ী বহিষ্কার হয়েছে৷ যারা অপরাধ করেছে তাদের অনেকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে৷