‘এবার হলে গ্রামের অধিকাংশ মানুষই চলে যাবে’
১৩ নভেম্বর ২০১৮ডয়চে ভেলে: আপনি কী করেন?
বিশ্বজিৎ কুমার সরকার: আমি টেইলারের কাজ করি৷
কোথায় থাকেন আপনি?
আমি যশোরের অভয়নগরের চাপাতলা মালোপাড়ায় থাকি৷
এখানে কত বছর ধরে আছেন?
আমার বয়স ৫০ বছর৷ আমি আমার জন্ম থেকেই এখানে আছি৷ আমার বাপ-দাদারা অনেক আগে থেকে এখানে আছেন৷ একাত্তরের আগে থেকে আমরা এখানে বসবাস করি৷
সামনে তো নির্বাচন আসছেন? কী ভাবছেন? ভোট দেবেন?
অবশ্যই৷ আমরা বাংলাদেশের নাগরিক৷ আমাদের ভোট দেয়া তো কর্তব্য৷ গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যে সহিংসতা ঘটেছিল, সে কারণে মানুষের মধ্যে কিন্তু আতঙ্ক রয়ে গেছে৷
ভোটের আগে, ভোটের সময় বা ভোটের পরে আপনাদের কোনো সমস্যা হয়?
ভোটের আগে একটু সমস্যা হয়৷ আমরা সংখ্যালঘু৷ আমাদের উপর আক্রমণ হয়েই থাকে৷ নির্বাচনের সময় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এ ধরনের আক্রমণ আমাদের উপর হয়৷
কখনো কি আপনাদের উপর আক্রমণ হয়েছে?
গত নির্বাচনের সময় আমাদের উপর আক্রমণ হয়েছিল৷ সেটা সারা বিশ্ববাসী জানে৷ এর আগে আমাদের এখানে কিন্তু এমন ঘটনা ঘটেনি৷ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি জামাত-শিবির ও বিএনপির ভোট বানচাল কমিটি তখন আমাদের ওপর হামলা করে৷
কী ঘটেছিল তখন?
আমাদের আগে থেকেই বলছিল, ভোট দিতে যাবা না৷ তখন আমরা তাদের বলেছিলাম, আমরা বাংলাদেশের নাগরিক, কেন ভোট দিতে যাব না? ভোট দেয়া তো আমাদের অধিকার৷ আমরা কি সেই অধিকার দেখাতে পারব না?
কী ধরনের হামলা হয়েছিল আপনাদের উপর?
আমি আমার পাড়ার সবাইকে নিয়ে ভোট কেন্দ্রে যাচ্ছিলাম৷ প্রথমে ১৫/১৬ জন আমাদের পথের মধ্যে আটকায়৷ এবং আমার উপর আক্রমণ চালায়৷ তখন আমার সাথে থাকা আমার গ্রামের লোকজন তাদের প্রতিহত করে৷ এরপর বেলা ২টার দিকে তারা আবার আমাদের গ্রামের দুই দিক দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করার চেষ্টা করে৷ তখনও আমাদের গ্রামের লোকজন তাদের প্রতিহত করে৷ ঠিক সন্ধ্যার একটু আগে ‘নারায়ে তাকবির, আল্লাহু আকবার' বলতে বলতে নসিমন ভরে ভরে বিপুল সংখ্যক লোক হাতে লাঠি-সোঁটা, আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে আমাদের পাড়ায় প্রবেশ করে৷ তাদের হাতে বোমা এবং ককটেলও ছিল৷ এটা অনেকেই দেখেছে৷ তখন আমাদের পাড়ার লোকজন সব বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে আমাদের পাশেই ভৈরব নদী, সেই শীতের রাতেই ভৈরব নদী সাঁতরে পার হয়ে ওপারে গিয়ে আশ্রয় নেয়৷ এই দৃশ্য বর্ণনা করতে গেলে চোখে জল এসে যায়৷
কারা হামলা করে আপনাদের ওপর?
আমাদের উপর (যারা) হামলা করেছিল (তাদের মধ্যে) জামাতের লোক ছিল বেশি৷ তখন আমাদের গ্রামের পাশেই জামাতের লোকজন পিকেটিং করছিল৷ তখন তো ওদের অনির্দিষ্টকালের হরতাল চলছিল৷ ওই হরতাল নিয়ে তারা পিকেটিং করছিল৷ জামাতের লোকজন তখন নসিমন ভরে ভরে আমাদের বাড়ি-ঘরে ঢুকে জ্বালিয়ে দেয় পুরো গ্রাম৷ মাছ ধরার জালগুলো পর্যন্ত পুড়িয়ে দেয়৷ ভাতের হাড়ি পর্যন্ত নষ্ট করে ফেলে৷ স্কুল-কলেজের বাচ্চাদের সার্টিফিকেট পর্যন্ত পেট্রোল দিয়ে আগুন ধরিয়ে পুড়িয়ে দেয়৷ তখন তারা আশপাশের গ্রামেও গুজব ছড়িয়ে দেয় যে, আমরা তাদের দু'জন লোককে মেরে ফেলেছি৷ এই খবর শুনে আশপাশের প্রচুর মানুষ এখানে চলে আসে এবং আমাদের উপর হামলা চালায়৷
আপনার বাড়িতে হামলা হয়েছে?
আমার বাড়িতে ওই দিনই হামলা হয়েছিল৷ আমার বৃদ্ধ বাবা ও মা বাড়িতে ছিলেন৷ তাঁদেরও মারধর করেছে৷ আমার বাবা তাদের পা জড়িয়ে ধরে অনুরোধ করেছিলেন৷ তারা আমার ঘরের মধ্যে ঢুকে আমার টিভিটা নষ্ট করে দেয়৷ শুধু টিভি না, ঘরের সবকিছু নষ্ট করে দেয়৷ অনেক কিছুই নিয়ে যায়৷
তাদের কি কেউ বাধা দেয়নি?
আমরা যেখানে বসবাস করি, সেখানে কিন্তু জামাত-বিএনপির লোকই বেশি৷ তাদের প্রভাবও বেশি৷ এখানে মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ বেশি৷ আমরা শুধুমাত্র ১১০/১৫ ঘর হিন্দু মানুষ বসবাস করি৷ তখন তাদের ঠেকাতে কেউ আসেনি৷ আশপাশে অনেক মুরুব্বি আছেন৷ মেম্বার আছেন, চেয়ারম্যান আছেন, কিন্তু তাঁরা কেউ আমাদের রক্ষা করতে এগিয়ে আসেননি৷ কেউ তাদের বাধা দেয়নি৷ কেউ বলেনি যে, তোমরা হামলা করো না৷ হয়তো মুরুব্বিরা কেউ এগিয়ে এসে তাদের বাধা দিলে এত বড় হামলার হতো না৷
পুলিশের ভূমিকা তখন কী ছিল?
আমি ওসি সাহেবকে ২২ বার ফোন করেছিলাম৷ তখন অভয়নগর থানার ওসি ছিলেন এমদাদ সাহেব৷ তাকে ২২ বার ফোন দেয়ার পরেও তিনি ফোনটাই ধরেননি৷ আমি চেয়ারম্যানকে অনেকবার ফোন দিয়েছি, তিনিও আমার কোনো ফোনই ধরেননি৷
ঘটনার পর কি আপনারা কোনো মামলা করেছেন?
হামলার পরপরই মামলা হয়েছিল৷ তখন আমি হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম৷ আমার গলা দিয়ে রক্ত বের হচ্ছিল৷ আমি প্রচুর আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছিলাম৷ আমি একেবারে সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছায় বেঁচে আছি৷
যে মামলা হয়েছিল সেই মামলায় কি কেউ গ্রেপ্তার হয়েছে বা কোনো হামলাকারীর শাস্তি হয়েছে?
মামলাগুলো এখনো চলছে৷ পুলিশ তখন কয়েকজনকে ধরেছিল, তাদের কেউ কেউ জামিনে ছাড়া পেয়েছে৷ তারা এখনো ঘোরাফেরা করছে৷
সামনে নির্বাচন নিয়ে আপনাদের ভাবনা কী?
আমি যে গ্রামে বসবাস করি, এই গ্রামের সবাই এবার একমত যে, যদি পরিবেশ ভালো থাকে, তাহলে ভোট দিতে যাবো৷ আর যদি পরিবেশ খারাপ থাকে, তাহলে কেউ ভোট দিতে যাবো না৷ আবার ভোট দিতে গেলে যদি একই ধরনের হয়? মা-বোনদের ইজ্জত নিয়ে টানাটানি শুরু করে? সেটা তো আর মানা যাবে না৷
আপনাদের গ্রামে কতঘর সংখ্যালঘু পরিবার আছে?
আমাদের যে গ্রাম, সেটা হলো মালোপাড়া৷ আমরা সবাই জেলে৷ আমাদের এখানে ১১৫টি পরিবার আছে৷
আগে কতগুলো পরিবার ছিল?
আগে একটু কম ছিল৷ ৬০-৭০ ঘর ছিল, এখন পরিবার বেড়েছে৷ বেড়ে গেছে মানে, একই পরিবার থেকে ঘর ভেঙে অন্য পরিবার হয়েছে৷ আবার বাইরের কিছু লোকজন এখানে এসে আমাদের গ্রামে জায়গা কিনে ঘর করেছে৷ তারাও সবাই আমাদের সম্প্রদায়ের মানুষ৷
এখান থেকে কি কেউ দেশ ছেড়েছে?
হ্যাঁ৷ দেশ ছেড়েছে৷
তাঁরা কোথায় গেছেন?
ভারতে গেছে৷
কেন গেছেন তাঁরা?
কী বলে আপনাকে বোঝাবো? যারা গেছে, তারা হয়ত ভেবেছে যে, এদেশে বসবাস করার মতন অবস্থা নাই, এখানে আমরা সম্মান নিয়ে বাঁচতে পারবো না৷ কিছু পরিবার আগে থেকেই চলে গেছে৷ কিছু পরিবার থাকার চেষ্টা করেছে, কিন্তু থাকতে পারেনি৷ অনেকেই তো এখনো যাচ্ছে৷ প্রতিদিনই কিন্তু শত শত মানুষ চলে যাচ্ছে ভারতে৷ কেন যাচ্ছে? বিগত দিনগুলো আসলে আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে যে, নির্বাচন সামনে, নির্বাচন হলে তো আমরা আঘাতপ্রাপ্ত হই৷
এবার কি নির্বাচন নিয়ে আশঙ্কায় কেউ দেশ ছেড়েছে?
আমাদের এখান থেকে এখনো কেউ যায়নি৷ শুধু একটা পরিবার গেছে৷ তারা এখনো জায়গা জমি বিক্রি করেনি৷ তাদের যে বসত-ভিটা ছিল সে বাড়ি ফেলে রেখেই তারা চলে গেছেন৷ তারা কিন্তু এবারের এই নির্বাচনকে নিয়েই আতঙ্কে চলে গেছেন৷ কারণ, তারা নির্বাচন নিয়ে আতঙ্কে পড়েছিলেন৷ কারণ আবার নির্বাচন এসেছে, কী হবে কেউ জানে না৷
এখন যারা আছে, তাদের মধ্যে আতঙ্কটা কী ধরনের?
একটা ভালো প্রশ্ন করেছেন৷ এবার যদি নির্বাচনে আবার সহিংসতা হয়, আমার পাড়ার অধিকাংশ লোক ভারতে চলে যাবে৷ কেউ ঠেকাতে পারবে না৷ বিগত নির্বাচনের সময় যে ঘটনাটা ঘটেছে, সেটা একটা ন্যক্কারজনক ঘটনা৷ এমন ঘটনা ১৯৭১ সালেও ঘটেনি৷ পুরো গ্রামটাকেই নদী পার করে অন্য জায়গায় পাঠিয়ে দেয়৷ এইটা কিন্তু সারা বিশ্বের মানুষ দেখেছে৷ সেই নির্বাচন আবার সামনে৷ এই নির্বাচনে যদি ওরকম ঘটনা ঘটে, তাহলে আমার পাড়ার বারো আনা মানুষ দেশ ছেড়ে চলে যাবে৷
সরকার বা দায়িত্বশীলদের কাছে আপনার চাওয়া কী?
প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটাই চাওয়া, সেটা হলো একটা অসাম্প্রদায়িক দেশ৷ আমরা এখানে সম্মান নিয়ে বাঁচতে চাই৷ আমি প্রধানমন্ত্রীকে বলব, এবার নির্বাচনে উনি যাঁদের মনোনয়ন দেবেন, তাঁরা যেন নির্যাতিত, নিপীড়িত সংখ্যালঘু পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়ান, তাঁদের দেখভাল করেন৷ অন্তত এই বিষয়টা যেন প্রধানমন্ত্রী দেখেন৷
প্রিয় পাঠক, আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷