বাকি চার দফায় সম্পন্ন হবে আরও ২৫৮ লোকসভা আসনের ভোট। দুটি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী বিজেপি।
গত বছরের মাঝামাঝি যখন বিরোধীদের ‘ইন্ডিয়া' নামের জোট তৈরি হয়েছিল, তখন এমন একটা ধারণা দানা বাঁধতে শুরু করেছিল যে, নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি সব অর্থে বহু এগিয়ে থাকলেও, জোটবদ্ধ ভাবে একের বিরুদ্ধে এক প্রার্থী দিতে পারলে, সমানে সমানে না হলেও, একটা মোটের উপর লড়াই হয়তো দিতে পারবে বিরোধীরা। তারপর ধীরে ধীরে জোট থেকে বিহারে নীতিশ কুমার, উত্তর প্রদেশে জয়ান্ত চৌধারীদের বেরিয়ে যাওয়া, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রকাশ্যে জোটের থেকে দূরত্ব সৃষ্টি, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে একের পর এক বিজেপির অনুকূলে দল বদলের ঘটনা, সব দেখে মনে হতে শুরু করেছিল, এবারের ভোট বিজেপির পক্ষে হিন্দিতে যাকে বলে ‘বাঁয়ে হাতকি খেল'।
এই বছরের গোড়ায় আমরা সাংবাদিকরা অনেকেই ধরে নিয়েছিলাম, রাম মন্দির, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর জি-২০ তৎপরতা, তাঁর ‘বিশ্ব-গুরু' ভাবমূর্তি, দুনিয়ার পঞ্চম র্থনীতির ঔজ্জ্বল্য, ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই' এই সব নানাবিধ অস্ত্রে ভর করে বিজেপি বলে বলে এক ডজন গোল দেবে বিরোধীদের। তারপরই এলো নরেন্দ্র মোদীর এনডিএ-র জন্য ৪০০ আসনের লক্ষ্য ঘোষণা এবং বিজেপির জন্য ৩৭০ আসনের টার্গেট বেঁধে দেয়া।
গত এক বছরে নরেন্দ্র মোদী নিজে সংসদের ভিতরে এবং বাইরে একাধিক বার বলেছেন ঈশ্বর তাঁকে দিয়ে কিছু কাজ (যেমন রাম মন্দির) করিয়ে নিচ্ছেন। অর্থাৎ, তিনি ঈশ্বরের প্রতিনিধিত্ব করছেন। গত বছর যখন এনডিএ সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব এনেছিল বিরোধীরা, তার জবাব দিতে গিয়ে মোদী বলেছিলেন, ‘আগামী ২০২৮ সালে ১৯তম লোকাসভা ভোটের আগে, আপনাদের আবার অনাস্থা আনতে হবে আমার বিরুদ্ধে'।
নির্বাচন কমিশন ভোটের দিন-ক্ষণ ঘোষণার পরের দিন, গত ১৭ মার্চ রবিবার সকালে নরেন্দ্র মোদী মন্ত্রিসভার বৈঠক ডেকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, তারা যেন নিজের নিজের দপ্তরের সচিবদের সঙ্গে বসে ভোটের প্রচারে নামার আগে আগামী ১০০ দিনের কাজের পরিকল্পনা সেরে ফেলেন, যাতে ভোটের ফল বেরোনোর পর দ্রুত কাজ শুরু করে দেয়া যায়। তার আগে ৩ মার্চ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী মন্ত্রিসভার সদস্যদের নিয়ে বৈঠক করেছিলেন ‘ভিশন ডকুমেন্ট-২০৪৭' এবং আগামী পাঁচ বছর সরকারের কাজ-কর্ম কী হবে তা নিয়ে।
প্রথম দফা ভোটের আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর মুখে প্রায় সব সভায়ই শোনা যাচ্ছিল, তিনি ‘৪০০-পার' আসন চাইছেন দেশের উন্নয়নের জন্য, দেশবাসীর মঙ্গলের জন্য। যেমন ১৬ এপ্রিল, সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য বলছে, গয়ার সভায় মোদী বলেছেন ‘৪০০-পার' প্রয়োজন বিকশিত ভারতের স্বার্থে। পরের দিনই আসামের নলবাড়িতে মোদী বললেন, আগামী ৪ জুন গণনার দিন, সেদিন কী হবে তা এখনই সবার জানা, লোকে তাই এখন বলছে ‘জুন চার, ৪০০-পার'। এরপর তামিলনাড়ুর সালেমে ৪০০-পার শব্দ-বন্ধ-কে বিভিন্ন স্লোগানের সঙ্গে মিলিয়ে মিলিয়ে বার বার স্লোগান দিতে দেখা গেল তাকে। এভাবেই একের পর এক সভায় ‘৪০০-পার' নিয়ে রাজনৈতিক বক্তব্য রাখছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নির্বাচন শুরু হওয়ার আগে।
এমনকি ১৯ এপ্রিল, প্রথম দফা ভোটের দিনও, উত্তর প্রদেশের আমরোহা জনসভায় মোদী বললেন, অনেকের মনে প্রশ্ন, ‘৪০০-পার' কী করে হবে, অনেক রাজ্যে তো বিজেপি সব আসনই জিতে নিয়েছে ২০১৯-এ? এরপর তিনি বললেন, ‘'উন্নত সরকার কাকে বলে, আইন-শৃঙ্খলা কাকে বলে মুখ্যমন্ত্রী যোগী দেখিয়ে দিয়েছেন, ফলে ২০১৯-র রেকর্ডও ভেঙে যাবে এবার এই উত্তরপ্রদেশে, এভাবেই ৪০০-পার হবে।''
১৯ এপ্রিল প্রথম দফার ভোট। তারপরই দেখা গেল নরেন্দ্র মোদীর বক্তৃতার ধরন বদলে গেল। তিনি কী চান, তার থেকেও তার কথায় বড় হয়ে উঠতে শুরু করলো কংগ্রেস ক্ষমতায় ফিরে এলে কী কী ভয়ঙ্কর সব কাজ করবে তার বিবরণ। কংগ্রেস ক্ষমতায় ফিরলে রামমন্দিরে তালা পড়বে, কংগ্রেস ফিরে এলে হিন্দু মহিলাদের মঙ্গলসূত্র নিরাপদ নয়, কংগ্রেস ফিরে এলে সংরক্ষণের সুযোগ হারাবেন দেশের এসসি/এসটি/ ওবিসি সম্প্রদায়ের মানুষ, সেই সুযোগ দিয়ে দেয়া হবে সংখ্যালঘুদের ইত্যাদি ইত্যাদি।
কিন্তু কেন ১৯ এপ্রিল প্রথম দফা ভোটের পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ভাষণে এই পরিবর্তন? সব কারণ বাইরে থেকে দেখা যায় না। অনুমান হয়ত কিছুটা করা যায়। অনুমানের ব্যাপারটা আপাতত দূরে সরিয়ে রাখা যাক। যা দেখা যাচ্ছে সেটা হলো, প্রথম কারণ, যে ইস্যুগুলির উপর নির্ভর করে বিজেপি এই ভোট লড়তে চেয়েছিল তার কোনোটিই সেভাবে জনপরিসরে আলোচনায় নেই। ফলে বিজেপিকে ফিরে যেতে হয়েছে তাদের চিরকালীন হিন্দু-মুসলিম ইস্যুতে। প্রধানমন্ত্রীর প্রথম দফার পরের ভাষণে তার ছাপ রয়েছে। দ্বিতীয় কারণ, ভোট কম পড়ছে ২০১৯-এর তুলনায়। কেন কম পড়েছে? ১৯৫১-৫২ থেকে শুরু করে ভারতে ভোট প্রধানতই শীতকাল বা তার কাছাকাছি সময়েই হত। যদি ১৯৫২ সাল থেকে গত ১৭টি নির্বাচনের তথ্য বিশ্লেষণ করা যায় তাহলে দেখা যাবে সাধারণভাবে শীতকালের তুলনায় গরমকালে ভোট কম পড়ে। কিছু যুক্তিসঙ্গত ব্যতিক্রম রয়েছে। যেমন ১৯৭৭, মার্চ মাসের গরমে ভোট হলেও জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে ভোটদানে মানুষের বাড়তি আগ্রহ থাকায়, ১৯৭১-এর থেকে পাঁচ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছিল ১৯৭৭-এ।
২০০৪-এ অটলবিহারী বাজপেয়ী ‘শাইনিং ইন্ডিয়া' স্লোগান দিয়ে ভোট বেশ কয়েক মাস এগিয়ে এনে এপ্রিল-মে মাসে নির্বাচন করেছিলেন (হেরে গিয়েছিল বিজেপি সেই নির্বাচনে), সেই থেকে গত দু'দশক ধরে ভারতের লোকসভা ভোট গরমকালেই হচ্ছে। ২০০৪, ২০০৯-এ ভোটদানের হার ১৯৯৯-এ সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে হওয়া ভোটের থেকে বাড়েনি, কিছুটা কমেছিল। ২০০৯-এ ভোটদানের হার ছিল ৫৮.২ শতাংশ। নরেন্দ্র মোদী এসে ব্যাপারটা নাটকীয়ভাবে বদলে দিলেন। ২০১৪, ২০১৯-এ ভরা গ্রীষ্মে ভোট হলেও ভোটদানের হার পুরোনো সব রেকর্ড ছাপিয়ে গেল। ২০১৪ এবং ২০১৯-এ ভোটদানের হার ছিল যথাক্রমে ৬৬.৪৪ শতাংশ এবং ৬৭.৪০ শতাংশ। এটাকে মোদী-জাদু ছাড়া অন্য কোনো ভাবে ব্যাখ্যা করা হয়তো সম্ভব নয়।
নরেন্দ্র মোদীর থার্ড টার্ম বা তৃতীয় দফায় এসে সম্ভবত মোদী-জাদু আর আগের মতো কাজ করছে না। ফলে ১৯ এপ্রিল থেকে তিনটি দাফায় যে ২৮৩টি আসনে ভোট হয়েছে, সেখানে ভোট ২০১৯-এর তুলনায় কম পড়েছে। এটা একটা কারণ বিজেপির এই ভোট নিয়ে চিন্তিত হওয়ার। কারণ, ভোটদানের হার বাড়লে যদি বিজেপির আসন এবং ভোট দুইই বাড়ে, তাহলে ভোটদানের হার কমলে কি বিজেপির আসন এবং ভোটের শতাংশ দুইই কমবে? এই প্রশ্নের উত্তর জানতে আমাদের ৪ জুন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
যে তিন দফা ভোট ইতিমধ্যে হয়ে গিয়েছে তাতে কি কোনো বৈশিষ্ট্য রয়েছে? এর উত্তর খুব স্পষ্ট ভাবে, হ্যাঁ। এই তিন দফা ভোটে মূলত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর প্রচারে ২০১৯-এ ২০ শতাংশ ভোট এবং মাত্র ৫২টি আসন পাওয়া প্রায় টিম-টিম করতে থাকা কংগ্রেস কার্যত বিজেপির প্রধান এবং প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল। কংগ্রেস ক্ষমতায় ফিরতে পারে এমন কোনো আলোচনা ভোট ঘোষণার আগে জনপরিসরে ছিল না। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব ১৯ এপ্রিলের পর থেকে তাঁদের প্রতিটি সভায় কংগ্রেস ক্ষমতায় ফিরে এলে ভারতবাসীর কী কী বিপদ হবে এই কথা ক্রমাগত বলে বলে রাতারাতি কংগ্রেসের রাজনৈতিক গুরুত্ব কয়েকশ' গুণ বাড়িয়ে দিয়েছেন।
বিজেপির একটা রাজনৈতিক আদর্শ আছে; তা সে যতই বিতর্কিত হোক না কেন! মল্লিকার্জুন খাড়গে-রাহুল গান্ধীর কংগ্রেস তার বিপরীতে একটা বিকল্প ‘আইডিওলজি' নিয়ে মাঠে নেমেছে। এই দুই আদর্শের অবধারিত সংঘর্ষে ২০১৯-এ ৩৭ শতাংশ ভোট পাওয়া বিজেপি কি চিন্তিত? বিজেপি নেতাদের জনসভায় দেওয়া ভাষণে তেমন মনে করার কারণ রয়েছে।
যে তিন দফা ভোট হয়ে গেল তার থেকে আরেকটা বিষয় পরিষ্কার, সেটা হলো এত তীব্র ইডি-সিবিআই তৎপরতা, দুই মুখ্যমন্ত্রীর জেল সত্ত্বেও নরেন্দ্র মোদী এবারের ভোটে দুর্নীতিকে ইস্যু করতে পারলেন না। লোকনীতি-সিএসডিএস-এর প্রাক নির্বাচনি সমীক্ষায় উঠে আসা তথ্য বলছে দেশের ৫৫ শতাংশ মানুষ মনে করছেন গত পাঁচ বছরে রাজ্য এবং কেন্দ্রে দুর্নীতি বেড়েছে। ২০১৯-এ লোকনীতি-সিএসডিএস-এর সমীক্ষায়এই সংখ্যাটা ছিল ৪০ শতাংশ।
বিজেপি একটা কথা বলতে শুরু করেছিল বেশ কিছুদিন ধরে। তাদের আমলে ‘অ্যান্টি ইনকামবেন্সি ফ্যাক্টর' কাজ করছে না। ভারতের লোকসভা ভোটের ইতিহাস তেমন কথা বলে না। মনে রাখতে হবে, জওহরলাল নেহরুর কংগ্রেসেরও ১৯৬২-র ভোটে, অর্থাৎ তৃতীয় দফায় এসে আসন কমে গিয়েছিল ১৯৫৭-র চেয়ে। এখনও পর্যন্ত তিন দফার ভোট দেখে মনে হচ্ছে, এবারের ভোটেও প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা বা ‘অ্যান্টি ইনকামবেন্সি ফ্যাক্টর' সক্রিয়। তবে তা কতটা জোরালো জানা যাবে ৪ জুন।
এখনও চার দফার ভোট বাকি। এই নির্বাচনের ফল যা-ই হোক, ভারতের রাজনীতির মানচিত্রে ইতিমধ্যেই একটি পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে এই তিন দফার ভোট। সেটা হল, গণতন্ত্রের একটি আবশ্যিক শর্ত হল শক্তিশালী বিরোধী দল। গত দশ বছরে যার অস্তিত্বই ছিল প্রায় না থাকারই মতো। সেই শূন্যতা পূরণ হওয়ার ইঙ্গিত রয়েছে এবারের ভোটের গতি প্রকৃতিতে।