কঠোর সমালোচনার মুখে জার্মানির পররাষ্ট্রনীতি
১২ এপ্রিল ২০২২২০০৮ সালে ম্যার্কেল ও ফ্রান্সের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট নিকোলা সার্কোজি ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্য করার প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছিলেন৷ এটাকে রাশিয়া উসকানি হিসেবে দেখতে পারে, বলে মনে করেছিলেন তারা৷
ম্যার্কেল ও সার্কোজির এই সিদ্ধান্তকে সম্প্রতি ‘ভুল হিসাব' বলে আখ্যায়িত করেছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি৷ তিনি বলেন, ঐ সিদ্ধান্তের কারণে ইউক্রেন ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর যুদ্ধে জীবন বাঁচাতে লড়ছে'৷
কিয়েভের কাছে বুচা শহরে বেসামরিক নাগরিকদের মৃতদেহ আবিষ্কারের পর ম্যার্কেলকে সেটা নিজ চোখে দেখে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন জেলেনস্কি৷
২০০৮ সালে ম্যার্কেল ও সার্কোজি ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্য করার বিরোধিতা করলেও ঐ সময় ভবিষ্যতে ইউক্রেন ও জর্জিয়াকে সদস্য করতে একমত হয়েছিলেন ন্যাটো নেতৃবৃন্দ৷ যদিও এই কাজের জন্য নির্দিষ্ট কোনো সময় নির্ধারণ করা হয়নি৷
২০১৪ সালে রাশিয়া ইউক্রেনের ক্রাইমিয়াদখলের পর ম্যার্কেলের সরকার ইউক্রেনে অস্ত্র পাঠায়নি৷ অথচ একই সময়ে ইউক্রেনকে পাশ কাটিয়ে রাশিয়া থেকে গ্যাস আনতে বাল্টিক সাগরের নীচ দিয়ে পাইপলাইন বসানোর প্রকল্প অনুমোদন করেছিল জার্মানি, যেটা ‘নর্ড স্ট্রিম ২' নামে পরিচিত৷ এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বর্তমানে রাশিয়া থেকে ইউরোপে গ্যাস রপ্তানি করতে ইউক্রেনের ভূখণ্ড ব্যবহার হওয়ায় ইউক্রেন যে টাকা পেত, সেটা ভবিষ্যতে পেতো না৷
নর্ড স্ট্রিম ২ প্রকল্পের কাজ ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে৷ তবে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর জার্মানি সেটা চালুর অনুমোদন স্থগিত রেখেছে৷
ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর সাবেক চ্যান্সেলর ম্যার্কেলের নীরবতার সমালোচনা করেছিলেন পোল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী মাটেউশ মোরাভিয়েৎস্কি৷ তিনি বলেন, ‘‘মিসেস ম্যার্কেল, যুদ্ধ শুরুর পর আপনি কিছু বলেননি৷'' গত ১০, ১৫ বছরে জার্মানির নীতি বর্তমানের রাশিয়াকে শক্তি জুগিয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি৷
ম্যার্কেলের পর চ্যান্সেলর হওয়া ওলাফ শলৎসও রাশিয়ার বিরুদ্ধে দিতে যাওয়া ইইউর কিছু গুরুত্বপূর্ণ নিষেধাজ্ঞা আরোপে বাধা দিয়েছেন বলে জানান পোল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী৷
জার্মানির বর্তমান প্রেসিডেন্ট ফ্রাংক ভাল্টার স্টাইনমায়ারও সমলোচনার হাত থেকে রেহাই পাননি৷ ২০০৫ থেকে ২০০৯ এবং ২০১৩ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন৷ এই সময় তিনি রাশিয়ার সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন বলে অভিযোগ করেছেন বার্লিনে ইউক্রেনের রাষ্ট্রদূত আন্দ্রি মেলনিক৷ তাই যুদ্ধ শুরুর পর স্টাইনমায়ারের উদ্যোগে আয়োজিত পিস কনসার্ট বর্জন করেছিলেন মেলনিক৷
এছাড়া জার্মানির দৈনিক টাগেসস্পিগেলে তিনি লিখেছেন, ‘‘সম্পর্কটা (রাশিয়ার সঙ্গে স্টাইনমায়ারের) অপরিহার্য ছিল, এমনকি পবিত্র, যা কিছুই ঘটুক না কেন৷'' ইউক্রেনের রাষ্ট্রদূত আরও লিখেছিলেন, ‘‘এমনকি উসকানি ছাড়া যু্দ্ধ শুরু করলেও এতে কোনো পার্থক্য হয়নি৷''
জার্মানির কোনো নেতা সম্পর্কে একজন রাষ্ট্রদূতের করা এটিই সবচেয়ে কঠোর সমালোচনা৷ জার্মানির রেগেন্সবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী স্টেফান বিয়ারলিং ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘পুটিন প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর জার্মানির প্রতিটি সরকার এই সংকেত দিয়েছে যে ইউক্রেনের ভাগ্যের চেয়ে রাশিয়ার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখা বেশি গুরুত্বপূর্ণ৷ এটা ক্রেমলিনকে উৎসাহ জুগিয়েছে৷''
ভুল স্বীকার
স্টাইনমায়ার স্বীকার করেছেন যে, জার্মানির রাশিয়া নীতি ‘দুর্বল মূল্যায়ন' ছিল৷ এছাড়া ‘নর্ড স্ট্রিম ২' প্রকল্প চালিয়ে যাওয়ার কারণে জার্মানি বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে বলেও স্বীকার করেন তিনি৷ তবে পুটিন কী করবেন তা জানা অসম্ভব ছিল বলেও জানান জার্মান প্রেসিডেন্ট৷
এদিকে, ম্যার্কেল এক বিবৃতিতে ২০০৮ সালে ইউক্রেনের ন্যাটোর সদস্য হওয়ার পথ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত ঠিক ছিল বলে জানান৷তবে জার্মানির সমালোচনা করলেও পুটিনের সঙ্গে আলোচনায়জার্মানির কূটনৈতিক ভূমিকা পালনের গুরুত্ব আছে বলে স্বীকার করেন জার্মানিতে ইউক্রেনের রাষ্ট্রদূত মেলনিক৷ তিনি বলেন, পুটিনের সঙ্গে আলোচনায় ‘‘আমাদের ওলাফ শলৎসের ব্যক্তিগত নেতৃত্ব প্রয়োজন৷'' জার্মানির নতুন পররাষ্ট্রনীতির জন্য এটি একটি লিটমাস টেস্ট হবে বলেও মন্তব্য করেন মেলনিক৷
ম্যার্কেলের সময় ফ্রান্স, জার্মানি, ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে শুরু হওয়া শান্তি উদ্যোগ ‘নরম্যাণ্ডি ফরম্যাট'-এর প্রতিও সমর্থন জানান ইউক্রেনের রাষ্ট্রদূত৷ তবে এই আলোচনায় ইউক্রেন যুক্তরাষ্ট্রকে যুক্ত করতে চাইলেও জার্মানি ও ফ্রান্স এখনও তাতে রাজি হয়নি৷
ক্রিস্টোফ হাসেলবাখ/জেডএইচ