কবি সুফিয়া কামালের উত্তরসূরি মুক্তিযোদ্ধা সুলতানা
২৬ অক্টোবর ২০১১১৯৫০ সালের ২২ জানুয়ারি ঢাকায় সংগ্রামী পরিবারে জন্ম সুলতানা কামালের৷ মা দেশবরেণ্য নারী নেত্রী এবং কবি বেগম সুফিয়া কামাল৷ বাবা কামাল উদ্দীন আহমদ খান৷ হিসাবরক্ষক পেশায় থাকলেও সুলতানার বাবাও ছিলেন একজন সাহিত্যিক৷ মুক্তিযোদ্ধা সুলতানা কামালের শিক্ষাজীবন শুরু নারী শিক্ষা মন্দির থেকে৷ পরে আজিমপুর বালিকা বিদ্যালয় এবং হলিক্রস কলেজে পড়েছেন তিনি৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে বিএ সম্মান এবং মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন৷ শিক্ষা জীবন থেকেই বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত ছিলেন সুলতানা কামাল৷
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত থেকে পাক বাহিনীর হত্যা নির্যাতন শুরু হলে সুলতানা কামাল মূলত এসব নারকীয় ঘটনার তথ্য দেশের বাইরে পাঠানোর মাধ্যমে এর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সমর্থন ও অবস্থান গড়ে তোলার কাজ শুরু করেন৷ এছাড়া মা বেগম সুফিয়া কামালের সংগ্রামী কর্মকাণ্ডের কারণে ঢাকায় তাঁদের বাড়িটি মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়েছিল৷ ফলে সেখানে অস্ত্র-শস্ত্র কিংবা মুক্তিযোদ্ধাদের লুকিয়ে রাখা, আশ্রয় দেওয়া, অর্থ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ, মুক্তিযোদ্ধাদের সীমান্ত পারাপার কিংবা নিরাপদ জায়গায় পৌঁছে দেওয়ার কাজগুলোও সেই বাড়ি থেকেই করা হচ্ছিল৷
জুন মাসে ঢাকায় অবস্থানরত পাকিস্তানি বিমান বাহিনীর স্কোয়াড্রন লিডার হামিদুল্লাহকে সীমান্ত পার করতে সহায়তা করেন তাঁরা৷ কিন্তু এরপরই হামিদুল্লাহর বাসার কাজের ছেলেকে ধরে নিয়ে যায় পাক সেনারা৷ ফলে তার কাছ থেকে সব তথ্য ফাঁস হয়ে পড়ার আশঙ্কায় সুলতানা কামাল এবং তাঁর বোন সাঈদা কামাল ভারত পাড়ি দেন৷ আগরতলায় পৌঁছে স্বেচ্ছাসেবী নার্স হিসেবে চিকিৎসা সেবায় সহায়তা করেছেন দুই বোন সুলতানা এবং সাঈদা কামাল৷ পরে ধীরে ধীরে হাসপাতালের পরিধি বাড়ে এবং আরো অনেক নারী চিকিৎসক এবং নার্স এসে সেখানে যোগ দেন৷ এসময় বিশ্রামগঞ্জের হাসপাতালে মেডিকেল এবং সার্জিক্যাল ওয়ার্ড করা হয়৷ তখন সুলতানা এবং সাঈদা কামাল সেখানে তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব পালন করেন৷
ডয়চে ভেলের সাথে আলাপচারিতায় স্বাধীনতা যুদ্ধে নিজেদের কাজের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘‘আমি এবং আমার বোন সাইদা কামাল আগরতলা গিয়ে চিকিৎসা সেবায় যোগ দেওয়ার পর থেকে আরো অনেক মেয়েরা এসে যুক্ত হলো৷ ফলে মেয়েদের জন্য মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার আরেকটা পথ খুলে গেল৷ তবে এখন যখন আমরা পেছন ফিরে তাকাই, তখন মাঝেমাঝে দুঃখ হয় যে, একই প্রথাগত চিন্তা করা হয়েছে অর্থাৎ মেয়েরা চিকিৎসা সেবায় ভালো করতে পারে৷ ফলে আমরা সরাসরি অস্ত্রহাতে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার সেরকম সুযোগ পাইনি৷ কারণ আমাদের কাজে সবাই এতোটাই তৃপ্ত ছিল যে, আমরা সে কাজটা বেশ ভালোভাবে করছি এবং সেটাই আমাদের করা উচিত বলে সবাই মনে করেছে৷ তবে এতে আমরা দুঃখও করি না কারণ আমরা মনে করি যে সেটাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ ছিল৷ সেকারণে সেখানে আমরা মন দিয়েই সেই কাজটা করেছি৷''
মুক্তিযুদ্ধের ৪০ বছর পরও যে ঘটনাগুলো বিশেষভাবে মনে পড়ে এবং এখনও তাঁকে নাড়া দেয় এমনই একটি ঘটনা তুলে ধরলেন সুলতানা কামাল৷ তিনি বলেন, ‘‘একটি ছেলে বন্দুক পরিষ্কার করতে গিয়ে নিজের গুলিতেই তার পায়ে আঘাত লাগে৷ ছেলেটির বয়স ছিল মাত্র ১৫ থেকে ১৬ বছর৷ সামরিক পরিভাষায় সেদিনই তার ইনডাকশনের কথা ছিল৷ কিন্তু তার পায়ে গুলি লাগার কারণে সে আর ইন্ডাক্টেড হতে পারল না৷ এ কারণে সে একেবারে চিৎকার করে কেঁদে উঠল যে, সে যুদ্ধ করতে যেতে পারছে না৷ এতো অল্প বয়সের একটি ছেলে, অথচ তার মধ্যে যুদ্ধে যাওয়ার এবং দেশটাকে স্বাধীন করার যে চেতনার বিকাশ ঘটেছিল এটা আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়৷ এছাড়া বিভিন্ন সময় মারাত্মকভাবে আহত ও শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যখন কথা বলেছি তখন দেখেছি যে, তারা হয়তো কখনও আর কাজ করতেই পারবে না কিংবা উঠে দাঁড়াতে পারবে না এমন অবস্থা৷ অথচ তারা নিজেদের এসব ক্ষতির কথা না ভেবে সারাক্ষণই বলতো, দেশটা স্বাধীন হয়ে যাক, শেখ মুজিব ফিরে আসুক এটাই আমরা চাই৷ এছাড়া আর কিছুই চাই না৷ তাদের এমন অভিব্যক্তি আমাদের ভীষণভাবে আলোড়িত করে যে, দেশটা স্বাধীন হোক, মানুষের ভালো হোক, মানুষ মানুষের মর্যাদা পাক - কীভাবে তারা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল৷ নিজেদের সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছিল৷ অথচ নিজেদের কষ্টের কথা মনে না করে সবসময় দেশ ও জাতির কথাই ভাবতো?''
প্রতিবেদন: হোসাইন আব্দুল হাই
সম্পাদনা: সঞ্জীব বর্মন