কম দুর্নীতি পশ্চিমবঙ্গে, সমীক্ষা নিয়ে প্রশ্ন
১৪ ডিসেম্বর ২০১৯আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশানাল দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরতে যে সমীক্ষা করেছে, তাতে পশ্চিমবঙ্গ রয়েছে বেশ ভালো জায়গায়৷ এই সমীক্ষা অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গ দেশের অন্যতম কম দুর্নীতিগ্রস্ত রাজ্য৷ এই সমীক্ষাকে হাতিয়ার করে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ভারত দুর্নীতি সমীক্ষা ২০১৯ -এ ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশানাল ইন্ডিয়া এবং লোকাল সার্কেল তুলে ধরেছে, পশ্চিমবঙ্গে দুর্নীতি সবচেয়ে কম৷ আন্তর্জাতিক দুর্নীতি দমন দিবসে এ জন্য রাজ্যবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে টুইট করেছেন মুখ্যমন্ত্রী৷ তিনি বলেছেন, ২৪৮টি জেলায় এক লক্ষ ৯০ হাজার মানুষের মধ্যে সমীক্ষায় পশ্চিমবঙ্গ ভালো জায়গায় রয়েছে৷ এই সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গের পাশাপাশি দিল্লি, হরিয়ানা, গুজরাট, কেরল, গোয়া এবং ওড়িশায় দুর্নীতি অপেক্ষাকৃত কম৷ রাজস্থাল, বিহার, ঝাড়খণ্ড, উত্তরপ্রদেশ, পাঞ্জাব, কর্নাটক, তামিলনাড়ু ও তেলেঙ্গানায় দুর্নীতি বেশি৷
গত কয়েক বছরে একের পর এক দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে পশ্চিমবঙ্গের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে৷ বহুকোটি টাকার চিটফান্ড কেলঙ্কারি যেমন রয়েছে, তেমনই আলোড়ন তুলেছিল নারদ স্টিং অপারেশনে উঠে আসা দুর্নীতি৷ এই দুটি বিষয়ই এখন আদালতের বিচারাধীন৷ এর উপর লোকসভা নির্বাচনের পর কাটমানি বিতর্ক মাথাচাড়া দিয়েছিল৷ সব মিলিয়ে দুর্নীতির প্রশ্নে কোণঠাসা তৃণমূলের কাছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশানালের রিপোর্ট অক্সিজেন হয়ে উঠেছে৷ শাসক দলের নেতারা বলছেন, সারদা-নারদ বিরোধীদের চক্রান্ত ছাড়া কিছু নয়৷ আন্তর্জাতিক সমীক্ষায় সেটাই প্রমাণিত হয়েছে৷ যদিও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মধ্যে এ নিয়ে মিশ্র্ প্রতিক্রিয়া রয়েছে৷
পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক স্তরে দুর্নীতি বেশি, এ কথা স্বীকার করেও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক বিমলশঙ্কর নন্দ বলেন, ‘‘এই সমীক্ষা শুধু রাজনৈতিক নেতাদের দিকে তাকিয়ে হয়নি৷ রাজ্যের সাধারণ জনজীবনে দুর্নীতি সত্যিই কম৷ দুর্নীতি সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা বিরূপ ধারণা আছে, যেটা অন্য রাজ্যে ততটা নেই৷ তবে যত উঁচু স্তরে ওঠা যাবে, বেশি দুর্নীতি পাওয়া যাবে৷ এটাও মানতে হবে, আমাদের রাজ্যে আর্থিক লেনদেন কম, সে জন্যে দুর্নীতিটাও কম৷ চাকরির পরীক্ষা থেকে সরকারি প্রকল্প সব ক্ষেত্রেই টাকা নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে৷ নির্বাচনে হিংসাও এক ধরনের দুর্নীতি৷ যে কোনো ভাবে ক্ষমতা ধরে রাখার চেষ্টা৷
তৃণমূল কংগ্রেসের কট্টর সমালোচক, কংগ্রেস নেতা অরুণাভ ঘোষও সমীক্ষাকে উড়িয়ে দিতে রাজি নন৷ তাঁর মতে, ‘‘ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল সেই দুর্নীতির কথা বলেছে, যার মুখোমুখি মানুষকে প্রতিদিন হতে হচ্ছে৷ অর্থাৎ, যে কোনো কাজ করাতে বা পরিষেবা নিতে গেলে টাকা লাগে৷ অন্য রাজ্যে যতটা লাগে, পশ্চিমবঙ্গে তার তুলনায় কম৷ রাজনৈতিক নেতৃত্বের দুর্নীতি নিশ্চই সাধারণ মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করেছে, কিন্তু এই সমীক্ষায় প্রতিদিনের অভিজ্ঞতার কথা বলা হয়েছে৷’’
যদিও এই দুজনের ব্যাখ্যার সঙ্গে অনেকে একমত নন৷ তাঁদের বক্তব্য, পশ্চিমবঙ্গে দুর্নীতি প্রতিদিনের অভিজ্ঞতাতেই রয়েছে৷ সারদা-সহ বিভিন্ন চিটফান্ড কেলেঙ্কারির পর নারদ স্টিং-এ তৃণমূল নেতাদের টাকা নেওয়ার ছবি (ভিডিওর সত্যতা ডয়চে ভেলে যাচাই করেনি) ধরা পড়েছিল৷ রাজনীতির শীর্ষ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ সীমাবদ্ধ ছিল৷ সাম্প্রতিক কালে কাটমানি বিতর্কে তা প্রসারিত হয়েছে শাসকদলের তৃণমূল স্তর পর্যন্ত৷ যে কোনো সরকারি প্রকল্পের টাকা পেতে গরিব মানুষদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন তৃণমূলের নিচুতলার নেতারা, এই অভিযোগ তুলে তা ফেরত পেতে একের পর এক বিক্ষোভ হয়েছে জেলায় জেলায়৷
এমন সব প্রসঙ্গ টেনে মানবাধিকার কর্মী অম্বিকেশ মহাপাত্র বলেন, ‘‘ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের সমীক্ষা মানি না৷ এতে রাশিবিজ্ঞানের কারিকুরি রয়েছে৷ রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি রয়েছে এই রাজ্যে৷ প্রতিটা ক্ষেত্রে কাজ করতে গেলে টাকা দিতে হয়, রাজনৈতিক নেতাদের দুর্নীতি তো রয়েইছে৷ চাকরিতে নিয়োগ থেকে ১০০ দিনের কাজ কিংবা আবাস যোজনা, সব ক্ষেত্রে টাকা দিতে হয়৷ সরকার সেটাকে বৈধতা দিয়েছে৷ কাটমানি বিতর্ক সবটাই সামনে এনে দিয়েছে৷ তারপর কি আর বলা চলে সাধারণ মানুষ দুর্নীতির মুখোমুখি হন না?’’