করোনা রুখতে মোদীর নয়া দাওয়াই
৩ এপ্রিল ২০২০দেশের লোকের কাছ থেকে এ বার নয় মিনিট সময় চাইলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তাঁর আবেদন, আগামী রোববার রাত নয়টার সময় ঘরের সব বাতি বন্ধ করে, নিজের বাড়ির বারান্দা বা ঘরের দরজায় এসে মোমবাতি বা প্রদীপ অথবা মোবাইলের টর্চ জ্বালিয়ে নয় মিনিট থাকতে হবে। মোদী বলেছেন, ''এতে দেশের ১৩০ কোটি লোকের সামগ্রিক শক্তির প্রকাশ ঘটবে। লোকে নিজেকে একা ভাববেন না। বরং সকলে ভরসা পাবেন। করোনার বিরুদ্ধে লড়াই জোরালো হবে। সেই সঙ্গে অন্ধকার কেটে গিয়ে আলোর বার্তা দেওয়া যাবে।'' সংস্কৃত শ্লোক উদ্ধৃত করে মোদী বলেছেন, ''উৎসাহের চেয়ে বড় কোনও শক্তি বিশ্বে নেই।'' তবে তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ''সকলে যেন সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখেন। বাড়ির বাইরে পা না দেন। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখেই করোনার বিরুদ্ধে লড়া সম্ভব।''
মোদী যখন এই কথা বলছেন, তখন ভারতে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ৮৮। ৫৬ জন মারা গিয়েছেন। চিকিৎসা করতে গিয়ে ডাক্তাররা করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন। এইমস, সফদরজঙ্গ সহ বহু হাসপাতালে তাঁরা করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। আক্রান্ত এক গর্ভবতী চিকিৎসক। এশিয়ার বৃহত্তম বস্তি মুম্বইয়ের ধারাভিতে করোনা পৌঁছে গিয়েছে। একজন মারা গিয়েছেন, দুই জন আক্রান্ত হয়েছেন। করোনা পরীক্ষার কিট অপর্যাপ্ত। বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার কেন্দ্রের কাছে পাঁচ লাখ কিট চেয়েছিলেন, পেয়েছেন মাত্র চার হাজার। স্যানিটাইজার, মাস্ক পাওয়া যাচ্ছে না। সব চেয়ে বড় কথা, চিকিৎসকদের সুরক্ষার জন্য যে ধরনের পোশাক দরকার, তাও পাওয়া যাচ্ছে না। প্রয়োজনের তুলনায় ভেন্টিলেটার অনেক কম। বেশি লোক করোনায় আক্রান্ত হলে তাঁদের রেখে চিকিৎসা করার মতো জায়গা তৈরি হয়নি। তাবলিগের জমায়েত থেকে করোনা দ্রুত ছড়িয়েছে। গরিব এলাকায় তা প্রবেশ করছে। এমনিতেই গরিব লোকের অবস্থা শোচনীয়। দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে যাঁরা কাজ করেন, তাঁরা অবর্ণনীয় কষ্টের মধ্যে পড়েছেন। কাজ নেই বলে টাকা নেই। তাঁরা সরকারি বা বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সাহায্যের ওপর ভরসা করে বসে আছেন। তারা খাবার দিলে খেতে পাচ্ছেন। সমানে লোকের চাকরি যাচ্ছে, বেতন কমে যাচ্ছে। সেই অবস্থায় বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির, বিশেষজ্ঞদের প্রত্যাশা ছিল, প্রধানমন্ত্রী এই সব সমস্যা সমাধানের উপায় নিয়ে বলবেন। তিনি দেশের লোককে ভরসা দেবেন।
এর আগে জনতা কার্ফুর মধ্যে লোককে হাততালি দিতে, থালা-বাটি বাজাতে বলেছিলেন মোদী। তাঁর কথা মেনে অধিকাংশ লোকই হাততালি দিয়েছিলেন বা ঘন্টা বাজিয়েছিলেন অথবা থালা-বাটি বাজিয়েছিলেন। তবে সেটা ছিল করোনাকে রুখতে যাঁরা কাজ করছেন, চিকিৎসা করছেন, জরুরি পরিষেবা চালু রেখেছেন তাঁদের ধন্যবাদ দেওয়ার জন্য। তা সত্ত্বেও তখন প্রশ্ন উঠেছিল, এ ভাবে করোনার বিরুদ্ধে লড়াইকে কি লঘু করে দেওয়া হচ্ছে না? তৃমমূল সাংসদ সুখেন্দু শেখর রায় ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছিলেন, থালা-বাটি বাজানোর কথা বলে করোনা বিরোধী লড়াইয়ের গুরুত্ব লঘু করে দেওয়া হয়েছিল।
বিরোধীরীা প্রশ্ন তুলেছেন, এই ভয়বাহ পরিস্থিতির মধ্যে লোককে নয় মিনিট ধরে আলো জ্বালিয়ে রাখার নির্দেশ দেওয়া কি সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়? যার জন্য জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিতে হয়! তৃণমূলের সাংসদ, দলের মুখপাত্র ও পেশায় চিকিৎসক কাকলি ঘোষ দস্তিদার ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ''এটা পুরোপুরি লোকের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘোরানোর চেষ্টা। আমাদের দেশে এমনিতেই ডাক্তারের সংখ্যা কম। যাঁরা আছেন তাঁদেরও করোনার বিরুদ্ধে সুরক্ষা দেওয়ার উপযোগী পোশাক দেওয়া যাচ্ছে না। দরকার হল লোকেদের ব্যাপকভাবে পরীক্ষা করা। সেটা হচ্ছে না। অত থালা,বাটি,গ্লাস বাজাবার পরেও তো ডাক্তাররা পরীক্ষা করতে গেলে তাঁদের পেটানো হচ্ছে। আসল সমস্যার দিকে নজর না দিয়ে, অন্য দিকে দৃষ্টি ঘোরাতেই মোদী এই ঘোষণা করলেন বলে আমি মনে করি।''
কংগ্রেস নেতা ও পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভায় বিরোধী দলনেতা আব্দুল মান্নানের মতে, প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণায় গোটা বিশ্ব হাসবে। ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেছেন, ''করোনা রুখতে সারা বিশ্ব হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে। আর প্রধানমন্ত্রী সেখানে উন্মাদের মতো কথা বলছেন। লোককে সাহায্য করার কথা না বলে এই ধরনের দাওয়াই অর্থহীন।''
সিপিএম পলিটব্যুরোর সদস্য মহম্মদ সেলিমের মতে, প্রধানমন্ত্রী আবার একটা ইভেন্ট পালনের ডাক দিলেন। ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেছেন, ''আজকেও উনি গরিব মানুষের কথা ভুলে গিয়েছেন। এই সময়ে যখন সকলকে এক হয়ে লড়তে হবে, তখন তাঁর লোকেরা ও এক শ্রেণির মিডিয়া বিভাজনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তার বিরুদ্ধেও প্রধানমন্ত্রীর বলা উচিত ছিল। তাঁর সব সময় একটা মেগা ইভেন্ট দরকার। কাদের নিয়ে ইভেন্ট হবে? উচ্চবিত্ত, উচ্চ মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্তদের নিয়ে। তার বাইরের ভারতকে উনি দেখতে পাচ্ছেন না। নিচুতলার মানুষের জন্য মন কাঁদছে না। অথচ, তাঁদের জন্য তাঁর কাজ করা উচিত ছিল। গরিব লোকেরা খেতে পাচ্ছেন না, এটা উনি দেখতে পাচ্ছেন না।''
প্রধানমন্ত্রী মোদী সম্পর্কে হামেশা বলা হয়, তিনি দলের কর্মীদের কোনও না কোনও কর্মসূচি নিয়ে ব্যস্ত রাখেন। প্রবীণ সাংবাদিক শরদ গুপ্তা ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ''মোদী এ বার দেশের লোককেও ব্যস্ত রাখতে চাইছেন। এভাবে অন্তত নিজের জনপ্রিয়তা বজায় রাখার পাশাপাশি তিনি যে কিছু করছেন, তা বোঝাতে চাইছেন।'' সেলিমের মতে, যা মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত পর্যন্ত লোকেদের সন্তুষ্ট রাখার চেষ্টা ছাড়া আর কিছু নয়।
জিএইচ/এসজি(পিটিআই, এএনআই)