1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

করোনার ঢেউ কি আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারতাম?

আব্দুন নূর তুষার
১৬ জুলাই ২০২১

আমরা কি এখন বাংলাদেশে যে কোভিডের তৃতীয় ঢেউ চলছে সেটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারতাম? এই প্রশ্নটি যত সহজ উত্তর তত সহজ নয়। তাই উত্তরটি দেবার আগে জেনে নেয়া দরকার যে, কোভিড মহামারি নিয়ন্ত্রণের জন্য কী কী করা দরকার।

https://p.dw.com/p/3wahY
Bangladesch AstraZeneca Impfung
ছবি: Mortuza Rashed/DW

১. রোগটির জনসংক্রমণ বা কমিউনিটি ট্রান্সমিশন কমিয়ে রাখা৷

২. যারা আক্রান্ত হবেন তাদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা তথা স্বাস্থ্যব্যবস্থার সক্ষমতা বৃদ্ধি৷

৩. যারা আক্রান্ত হন নাই তাদের গুরুত্ব অনুযায়ী টিকাদান করা৷ এই গুরুত্ব ক্ষমতা নয় বরং বয়স, কাজ ও প্রয়োজনের নিরিখে হতে হবে৷ যেমন ডাক্তার নার্স , বেশি বয়সী, পুলিশ, ব্যাংকার, সুইপার থেকে শুরু করে নানা রকম আবশ্যিক পেশার লোকজন ইত্যাদি৷

৪. দীর্ঘমেয়াদী আচরণ পরিবর্তনের লক্ষ্যে ক্রমাগত সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালু রাখা

৫. অতিদরিদ্র ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য সামাজিক সুরক্ষা বলয় তৈরি করা৷

আমরা কি করেছি।

১. আমরা জনসংক্রমণ কমিয়ে রাখার কথা মুখে বললেও যখন ভারতে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের আক্রমণ ভয়াবহ অবস্থায় তখনো বেশ কিছুদিন সীমান্ত খোলা রেখে খানিকটা দেরিতে সীমান্ত বন্ধ করেছি৷ সময়মতো লকডাউন দেই নাই৷ এমনকি লকডাউন দিয়েও সেটা অর্থবছরের শেষে বলে আবার পিছিয়েছি কয়েকদিন৷

২. গত বছরের শেষ থেকেই আমরা দেশের অভ্যন্তরীণ ভ্রমণ ও বিভিন্ন অবকাশযাপন কেন্দ্র খোলা রেখেছি৷ নতুন ক্রুজ শিপ চালু করে একসাথে কয়েকশ যাত্রীকে ভ্রমণ করতে দিয়েছি৷ করোনার সংক্রমণ যখন বাড়ছিল তখন এপ্রিল মাসে লক্ষাধিক ছাত্রছাত্রীর মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা নিয়েছি৷ রমজান মাসে কেনাকাটা অব্যাহত রেখেছি ও ঈদে বাড়ি যাওয়ার জন্য মানুষকে ফেরি ও রেলগাড়িতে গাদাগাদি করে উঠতে দিয়েছি৷

আপনারা জানেন যে, করোনার সুপ্তাবস্থা ১৫ দিন ধরে নিয়ে যে হিসাব সেই হিসাবে মে মাসের ১৫ তারিখ থেকে ধরলে জুনের ১ তারিখ থেকে সংক্রমণ বাড়ার কথা৷ মে মাসের ১৫তে মোট নতুন কেস ছিল ২৬১, জুনের ১ তারিখে হয়েছে ১৭৬৫, জুনের ১৫ তারিখে হয়েছে ৩,৩১৯ আর জুনের ৩০ তারিখে ৮,৮২২ এবং জুলাইয়ের ১৪ তারিখে ১২,৩৮৩৷ অর্থাৎ মোট ছয় সপ্তাহে রোগী বেড়েছে ৪০ গুণ৷ মানে ৪০০০% ও মোট দু’মাসে ৬০ গুণ বা ৬০০০%৷ এতে করে পরিষ্কার প্রমানিত হয়েছে যে, রমজান মাস ও ঈদকে ঘিরে আমাদের শহর থেকে গণপ্রস্থান করোনার এই অবস্থা সৃষ্টি করেছে৷

৩. আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থার সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য কেবল আইসিইউ বেড বাড়ানোর যে চেষ্টা সেটা ভুল৷ অনেকগুলি স্থানে আইসিইউ বসানো হলেও সব চালু হয় নাই৷ অতিরিক্ত অক্সিজেন চাহিদা সৃষ্টি হলে সেটা মেটানোর জন্য যে ব্যবস্থা সেটা নিয়ে এখনো যথেষ্ট সন্দিহান থাকার অবকাশ আছে৷ স্বাস্থ্যব্যবস্থায় বিরাট সংখ্যক পদখালি থাকলেও তা পূরণ করার প্রক্রিয়া দীর্ঘসূত্রিতার মধ্যে আছে৷

৪. টিকা দিয়ে এই রোগটিকে নিয়ন্ত্রণের যে প্রক্রিয়া সেটি ভারত থেকে অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা না পাওয়াতে বিঘ্নিত হয়েছে৷ মাত্র ৭০ লাখ টিকা ভারত থেকে পাওয়া গেছে৷ বাকিটা এসেছে উপহার হিসেবে৷ এর ফলে জুনের মধ্যে যেখানে অন্তত তিন কোটি ডোজ টিকা পাওয়ার কথা সেখানে আমরা পেয়েছি ১ কোটির কিছু বেশি৷ ১৩ লাখের মতো মানুষ ২য় ডোজের অপেক্ষায় থেকেছে৷ যদি আমরা সময়মতো টিকা পেতাম তাহলে অন্তত তিন কোটি লোক এখন ঝুঁকিমুক্ত থাকতেন৷ এখন কোভ্যাক্সের কাছ থেকে যে টিকা আসছে তার সবটুকু দিয়ে তার সুফল পেতে আরো তিন মাস থেকে ছয় মাস লেগে যাবে

৫. সচেতনতা ব্যর্থ হয়েছে সমন্বয়হীনতার কারণে। একদিকে আমরা কঠোর লকডাউনের কথা বলেছি অন্য দিকে সীমিতভাবে পরদিন থেকেই তা শিথিল করেছি৷ বারবার সিদ্ধান্ত সংশোধন ও বদল করেছি। মহামারি নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি ‘অল অর নান’ ল ফলো করে। করলে আপনাকে নিয়ম মেনে পুরোটা করতে হবে৷ এর সামান্য ব্যতিক্রম করলেই কাজের সুফল পাওয়া যাবে না৷ সীমিত আকারে শপিংমল খুলে দেয়া, গণপরিবহনে সীমিত যাত্রী পরিবহন, এসবের কারণে নিয়ন্ত্রণের বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো হয়ে গেছে এবং কাঙ্খিত ফল পাওয়া যায় নাই৷

ডা. আব্দুন নূর তুষার, উপদেষ্টা, ফাউন্ডেশন ফর ডক্টরস সেফটি অ্যান্ড রাইটস
ডা. আব্দুন নূর তুষার, উপদেষ্টা, ফাউন্ডেশন ফর ডক্টরস সেফটি অ্যান্ড রাইটসছবি: Facebook/N. Tushar

৬.অতিদরিদ্র ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর প্রতি মনোযোগী থাকলেও সমস্যা হয়েছে অন্যত্র।মহামারি যতো দীর্ঘায়িত হয় ততোই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর টিকে থাকার ক্ষমতা বিলুপ্ত হতে থাকে৷ তাই বারবার বন্ধ খোলা, বন্ধ খোলা না করে দু’মাস কঠোর শাসনের মধ্যে মহামারি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলে দু’মাসের জন্য খাদ্য ও আর্থিক সহায়তা বা বিকল্প কর্মসংস্থান করা যেতে পারতো৷ এখন এই জনগোষ্ঠী কোনভাবেই লকডাউন বা শাটডাউন মানতে চাইছে না৷ কারণ তারা না পাচ্ছে এর কোনো সুফল আর না পাচ্ছে জীবিকার নিশ্চয়তা৷

৭. সারাদেশে স্বেচ্ছাসেবার মাধ্যমে যে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার ছিলো সেটা আমরা করি নাই৷ রাজনৈতিক নেতা, সুশীল সমাজ, বসে থাকা তরুণ সমাজের একাংশকে টিকা দিয়ে তাদের করোনা ভলান্টিয়ার হিসেবে নিয়োগ দিয়ে তাদের দিয়ে সচেতনতা, দরিদ্রদের সহায়তা এসব নানা কাজ করানো যেতো৷ যেটা আমরা ৮৮ বা ৯৮ এর বন্যায় দেখেছি, সেটা এই ২০২০-২০২১ এ দেখি না৷ আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয়েরও অভাব ছিল৷

৮. আর ছিলো সর্বগ্রাসী দুর্নীতি৷ এরই মধ্যে বারবার স্বাস্থ্যব্যবস্থার অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি সকল কাজকে বাধাগ্রস্ত করেছে৷ শাহেদ, সাবরিনা, জাদিদ, অটোমোবাইলের মাস্ক কেলেংকারি ইত্যাকার নানা কাহিনী মানুষকে বিব্রত ও হতাশ করেছে৷

৯, রেডিও টেলিভিশনে সমন্বিত কোন বিজ্ঞাপনী সচেতনতা বা দেশব্যাপী আলাদাভাবে করোনা সচেতনতার অভাবের পাশাপাশি, করোনা তথ্য সঠিকভাবে ইন্টারনেটে প্রচারে দুর্বলতা ছিলো৷ পাঁচ কোটি টাকার অ্যাপ আর ১০ কোটি টাকার ওয়েবসাইট মানুষের কোন উপকারে আসে নাই৷

উপসংহার – সময়মতো উপরের বিষয়গুলি সঠিকভাবে করতে পারলে করোনার সংক্রমণ হয়ত বাড়ত কিন্তু এভাবে বাড়ত না৷ কিছু হলেই অমুক দেশ পারে নাই , তমুক দেশ পারে নাই বলাটা বুদ্ধিমানের কাজ না৷ যে কারণে তারা পারে নাই সেই একই কারণে আমরাও না পারার মানে হলো আমরা নিজেদের থেকেও শিখি না, অন্যদের দেখেও শিখি না৷

এখনো যদি সমন্বিতভাবে ১০০ দিনের ক্রাশ কর্মসূচি হাতে নেয়া হয় তবে ২০২১ সালের মধ্যে করোনা সংক্রমনকে ২% এর নিচে নামিয়ে সকল অর্থনৈতিক ও সামাজিক কর্মকান্ডকে দ্বিগুণ বেগে চালু করে ক্ষতি পোষানো সম্ভব৷

তবে সব কথার শেষ কথা হলো…বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধবে কে? ঘন্টা কেনার আগ্রহ যতোখানি , ঘন্টা বাঁধার আগ্রহ ততটা দেখা যাচ্ছে না।