করোনার ঢেউ কি আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারতাম?
১৬ জুলাই ২০২১১. রোগটির জনসংক্রমণ বা কমিউনিটি ট্রান্সমিশন কমিয়ে রাখা৷
২. যারা আক্রান্ত হবেন তাদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা তথা স্বাস্থ্যব্যবস্থার সক্ষমতা বৃদ্ধি৷
৩. যারা আক্রান্ত হন নাই তাদের গুরুত্ব অনুযায়ী টিকাদান করা৷ এই গুরুত্ব ক্ষমতা নয় বরং বয়স, কাজ ও প্রয়োজনের নিরিখে হতে হবে৷ যেমন ডাক্তার নার্স , বেশি বয়সী, পুলিশ, ব্যাংকার, সুইপার থেকে শুরু করে নানা রকম আবশ্যিক পেশার লোকজন ইত্যাদি৷
৪. দীর্ঘমেয়াদী আচরণ পরিবর্তনের লক্ষ্যে ক্রমাগত সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালু রাখা
৫. অতিদরিদ্র ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য সামাজিক সুরক্ষা বলয় তৈরি করা৷
১. আমরা জনসংক্রমণ কমিয়ে রাখার কথা মুখে বললেও যখন ভারতে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের আক্রমণ ভয়াবহ অবস্থায় তখনো বেশ কিছুদিন সীমান্ত খোলা রেখে খানিকটা দেরিতে সীমান্ত বন্ধ করেছি৷ সময়মতো লকডাউন দেই নাই৷ এমনকি লকডাউন দিয়েও সেটা অর্থবছরের শেষে বলে আবার পিছিয়েছি কয়েকদিন৷
২. গত বছরের শেষ থেকেই আমরা দেশের অভ্যন্তরীণ ভ্রমণ ও বিভিন্ন অবকাশযাপন কেন্দ্র খোলা রেখেছি৷ নতুন ক্রুজ শিপ চালু করে একসাথে কয়েকশ যাত্রীকে ভ্রমণ করতে দিয়েছি৷ করোনার সংক্রমণ যখন বাড়ছিল তখন এপ্রিল মাসে লক্ষাধিক ছাত্রছাত্রীর মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা নিয়েছি৷ রমজান মাসে কেনাকাটা অব্যাহত রেখেছি ও ঈদে বাড়ি যাওয়ার জন্য মানুষকে ফেরি ও রেলগাড়িতে গাদাগাদি করে উঠতে দিয়েছি৷
আপনারা জানেন যে, করোনার সুপ্তাবস্থা ১৫ দিন ধরে নিয়ে যে হিসাব সেই হিসাবে মে মাসের ১৫ তারিখ থেকে ধরলে জুনের ১ তারিখ থেকে সংক্রমণ বাড়ার কথা৷ মে মাসের ১৫তে মোট নতুন কেস ছিল ২৬১, জুনের ১ তারিখে হয়েছে ১৭৬৫, জুনের ১৫ তারিখে হয়েছে ৩,৩১৯ আর জুনের ৩০ তারিখে ৮,৮২২ এবং জুলাইয়ের ১৪ তারিখে ১২,৩৮৩৷ অর্থাৎ মোট ছয় সপ্তাহে রোগী বেড়েছে ৪০ গুণ৷ মানে ৪০০০% ও মোট দু’মাসে ৬০ গুণ বা ৬০০০%৷ এতে করে পরিষ্কার প্রমানিত হয়েছে যে, রমজান মাস ও ঈদকে ঘিরে আমাদের শহর থেকে গণপ্রস্থান করোনার এই অবস্থা সৃষ্টি করেছে৷
৩. আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থার সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য কেবল আইসিইউ বেড বাড়ানোর যে চেষ্টা সেটা ভুল৷ অনেকগুলি স্থানে আইসিইউ বসানো হলেও সব চালু হয় নাই৷ অতিরিক্ত অক্সিজেন চাহিদা সৃষ্টি হলে সেটা মেটানোর জন্য যে ব্যবস্থা সেটা নিয়ে এখনো যথেষ্ট সন্দিহান থাকার অবকাশ আছে৷ স্বাস্থ্যব্যবস্থায় বিরাট সংখ্যক পদখালি থাকলেও তা পূরণ করার প্রক্রিয়া দীর্ঘসূত্রিতার মধ্যে আছে৷
৪. টিকা দিয়ে এই রোগটিকে নিয়ন্ত্রণের যে প্রক্রিয়া সেটি ভারত থেকে অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা না পাওয়াতে বিঘ্নিত হয়েছে৷ মাত্র ৭০ লাখ টিকা ভারত থেকে পাওয়া গেছে৷ বাকিটা এসেছে উপহার হিসেবে৷ এর ফলে জুনের মধ্যে যেখানে অন্তত তিন কোটি ডোজ টিকা পাওয়ার কথা সেখানে আমরা পেয়েছি ১ কোটির কিছু বেশি৷ ১৩ লাখের মতো মানুষ ২য় ডোজের অপেক্ষায় থেকেছে৷ যদি আমরা সময়মতো টিকা পেতাম তাহলে অন্তত তিন কোটি লোক এখন ঝুঁকিমুক্ত থাকতেন৷ এখন কোভ্যাক্সের কাছ থেকে যে টিকা আসছে তার সবটুকু দিয়ে তার সুফল পেতে আরো তিন মাস থেকে ছয় মাস লেগে যাবে৷
৫. সচেতনতা ব্যর্থ হয়েছে সমন্বয়হীনতার কারণে। একদিকে আমরা কঠোর লকডাউনের কথা বলেছি অন্য দিকে সীমিতভাবে পরদিন থেকেই তা শিথিল করেছি৷ বারবার সিদ্ধান্ত সংশোধন ও বদল করেছি। মহামারি নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি ‘অল অর নান’ ল ফলো করে। করলে আপনাকে নিয়ম মেনে পুরোটা করতে হবে৷ এর সামান্য ব্যতিক্রম করলেই কাজের সুফল পাওয়া যাবে না৷ সীমিত আকারে শপিংমল খুলে দেয়া, গণপরিবহনে সীমিত যাত্রী পরিবহন, এসবের কারণে নিয়ন্ত্রণের বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো হয়ে গেছে এবং কাঙ্খিত ফল পাওয়া যায় নাই৷
৬.অতিদরিদ্র ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর প্রতি মনোযোগী থাকলেও সমস্যা হয়েছে অন্যত্র।মহামারি যতো দীর্ঘায়িত হয় ততোই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর টিকে থাকার ক্ষমতা বিলুপ্ত হতে থাকে৷ তাই বারবার বন্ধ খোলা, বন্ধ খোলা না করে দু’মাস কঠোর শাসনের মধ্যে মহামারি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলে দু’মাসের জন্য খাদ্য ও আর্থিক সহায়তা বা বিকল্প কর্মসংস্থান করা যেতে পারতো৷ এখন এই জনগোষ্ঠী কোনভাবেই লকডাউন বা শাটডাউন মানতে চাইছে না৷ কারণ তারা না পাচ্ছে এর কোনো সুফল আর না পাচ্ছে জীবিকার নিশ্চয়তা৷
৭. সারাদেশে স্বেচ্ছাসেবার মাধ্যমে যে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার ছিলো সেটা আমরা করি নাই৷ রাজনৈতিক নেতা, সুশীল সমাজ, বসে থাকা তরুণ সমাজের একাংশকে টিকা দিয়ে তাদের করোনা ভলান্টিয়ার হিসেবে নিয়োগ দিয়ে তাদের দিয়ে সচেতনতা, দরিদ্রদের সহায়তা এসব নানা কাজ করানো যেতো৷ যেটা আমরা ৮৮ বা ৯৮ এর বন্যায় দেখেছি, সেটা এই ২০২০-২০২১ এ দেখি না৷ আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয়েরও অভাব ছিল৷
৮. আর ছিলো সর্বগ্রাসী দুর্নীতি৷ এরই মধ্যে বারবার স্বাস্থ্যব্যবস্থার অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি সকল কাজকে বাধাগ্রস্ত করেছে৷ শাহেদ, সাবরিনা, জাদিদ, অটোমোবাইলের মাস্ক কেলেংকারি ইত্যাকার নানা কাহিনী মানুষকে বিব্রত ও হতাশ করেছে৷
৯, রেডিও টেলিভিশনে সমন্বিত কোন বিজ্ঞাপনী সচেতনতা বা দেশব্যাপী আলাদাভাবে করোনা সচেতনতার অভাবের পাশাপাশি, করোনা তথ্য সঠিকভাবে ইন্টারনেটে প্রচারে দুর্বলতা ছিলো৷ পাঁচ কোটি টাকার অ্যাপ আর ১০ কোটি টাকার ওয়েবসাইট মানুষের কোন উপকারে আসে নাই৷
উপসংহার – সময়মতো উপরের বিষয়গুলি সঠিকভাবে করতে পারলে করোনার সংক্রমণ হয়ত বাড়ত কিন্তু এভাবে বাড়ত না৷ কিছু হলেই অমুক দেশ পারে নাই , তমুক দেশ পারে নাই বলাটা বুদ্ধিমানের কাজ না৷ যে কারণে তারা পারে নাই সেই একই কারণে আমরাও না পারার মানে হলো আমরা নিজেদের থেকেও শিখি না, অন্যদের দেখেও শিখি না৷
এখনো যদি সমন্বিতভাবে ১০০ দিনের ক্রাশ কর্মসূচি হাতে নেয়া হয় তবে ২০২১ সালের মধ্যে করোনা সংক্রমনকে ২% এর নিচে নামিয়ে সকল অর্থনৈতিক ও সামাজিক কর্মকান্ডকে দ্বিগুণ বেগে চালু করে ক্ষতি পোষানো সম্ভব৷
তবে সব কথার শেষ কথা হলো…বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধবে কে? ঘন্টা কেনার আগ্রহ যতোখানি , ঘন্টা বাঁধার আগ্রহ ততটা দেখা যাচ্ছে না।