করোনার প্রভাবে বাড়ছে আত্মহত্যার প্রবণতা
১৫ অক্টোবর ২০২১''আমি কি পাগল যে মনোবিদের সঙ্গে কথা বলতে যাবো?''-- অতি সম্প্রতি এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর বাবার সঙ্গে কথা বলার সময় এই মন্তব্য শুনতে হলো। বছর সত্তরের ভদ্রলোক দুই বছর আগেও দিল্লি এসে আমার বাড়িতে দিনকয়েক কাটিয়ে গেছেন। চমৎকার রান্না করেন। বেড়াতে ভালোবাসেন। এককথায় হুল্লোড়ে। সেই তিনি-ই গত দেড়বছরে একদিন মাত্র বাড়ির বাইরে পা রেখেছেন। করোনার ভয়ে। বাড়িতে কাউকে আসতে দেন না। অন লাইনে অর্ডার এলে সবকিছু বারান্দায় রোদের মধ্যে ফেলে রাখেন অন্তত দুই দিন। সবজি-পাতি শুকিয়ে কালো হয়ে গেলে রান্না ঘরে ঢুকতে দেন। গত দেড় বছর ধরে প্রতিদিন ভিটামিন, জিঙ্ক সহ একাধিক ওষুধ খেয়ে চলেছেন করোনা রুখতে। হাইপার টেনশন ভয়াবহ জায়গায় পৌঁছেছে। কিন্তু ডাক্তার দেখাতে যাচ্ছেন না। করোনায় মৃত্যুর আশঙ্কা ছাড়া অন্য কোনো বিষয়ে কার্যত কোনো কথা বলছেন না।
করোনাকালে এমন ঘটনা একটি নয়। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে এমন ঘটনার গাদা গাদা উদাহরণ আছে। করোনা নয়, হাইপার টেনশন থেকে স্ট্রোক হয়েছে এবং তার জেরে মৃত্যু, গত একবছরে এমন ঘটনাও ঘটেছে অনেক। তবে তার কোনো নির্দিষ্ট ডেটা বা নথি নেই।
চিকিৎসক সাত্যকি হালদারের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা হচ্ছিল কিছুদিন আগে। সম্পূর্ণ সুস্থ মানুষ হঠাৎ করে হাইপার টেনশনের রোগীতে পরিণত হয়েছেন, এর সংখ্যা গত একবছরে চোখে পড়ার মতো বেড়েছে বলে জানাচ্ছিলেন তিনি। তার কারণ যে করোনাকাল এ নিয়ে সাত্যকির মনে কোনো সন্দেহ নেই।
একই অভিমত মন-সমাজবিদ মোহিত রণদীপের। তার বক্তব্য, শুধু বয়স্ক মানুষ নয়, তরুণ এবং যুবকদের মধ্যেও গত একবছরে মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি চোখে পড়ার মতো। বয়স্করা যখন মৃত্যুর আশঙ্কায় হতাশায় ভুগছেন। স্বাভাবিক জীবন পাল্টে ফেলে ডিপ্রেশনে চলে যাচ্ছেন, তেমনই তরুণ এবং যুবকরা অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে হাতাশায় ভুগছে।
মোহিতের কথায়, ''গত দেড় বছরে প্রায় ১২ কোটি মানুষের চাকরি গেছে। এর মধ্যে আট কোটি মানুষ বাড়ির একমাত্র রোজগেরে। লকডাউন ওঠার পরেও এদের অধিকাংশ কাজ পাননি। এখনো চাকরি যাচ্ছে অনেকের। তারমধ্যে মূল্যবৃদ্ধির হার চড়া। সংসার চলবে কী করে, এই আশঙ্কায় আত্মহত্যা করেছেন, এমন মানুষের সংখ্যা কম নয়।'' সম্প্রতি এমনই এত হতাশায় ডুবে যাওয়া যুবকের চিকিৎসা শুরু করেছেন মোহিত। কাউন্সেলিংয়ের পাশাপাশি তার ক্লিনিক্যাল চিকিৎসাও চলছে। অর্থাৎ, ওষুধ খেতে হচ্ছে। মোহিতের বক্তব্য, ওই যুবক এক বন্ধুর মারফত চিকিৎসকের কাছে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন। না এলে আত্মহত্যার মতো ঘটনাও তিনি ঘটিয়ে ফেলতে পারতেন। মোহিতের বক্তব্য, খুব কম মানুষই মনোবিদ বা মনচিকিৎসক পর্যন্ত পৌঁছাতে পারছেন। কারণ, সমাজে এখনো ট্যাবু আছে। মনোবিদ বা মনের চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার অর্থ তিনি পাগল।
ফিরে আসি ওই কাকুর কথায়। বন্ধুর বাবা। ফোনে একাধিকবার কাকুকে বোঝানোর চেষ্টা হচ্ছিল কোনো মনোবিদের সঙ্গে কথা বলার। তিনি রাজি নন। কারণ, তিনি বিশ্বাস করেন, একমাত্র পাগলরাই মনোচিকিৎসকের কাছে যান। তার যে মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি হয়েছে, সেই বিষয়টিও তিনি বুঝতে চাইছেন না। কিন্তু মানসিক স্বাস্থ্যের কারণে তার শারীরিক স্বাস্থ্যও যে ক্রমশ ভেঙে পড়ছে, তা স্পষ্ট। দেড় বছর আগেও যিনি প্রতিদিন পার্কে গিয়ে ব্যায়াম করতেন, তিনি এখন দিনের অধিকাংশ সময়ই টিভি চালিয়ে শুয়ে থাকেন।
২০২০ সালের শেষের দিকে মেডিক্যাল কাউন্সিলের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, করোনাকালে সব মিলিয়ে প্রায় ৪৩ শতাংশ ভারতীয় কোনো না কোনোভাবে মানসিক সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন। লকডাউনের সময় এর পরিমাণ ছিল সবচেয়ে বেশি। লকডাউনের পর শতাংশের হার কমলেও জটিল মানসিক রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে।
ছাত্রদের উপরেও এর বিপুল প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বলে জানাচ্ছেন চিকিৎসকরা। কলকাতার একটি নামি স্কুলের সঙ্গে জড়িত মনোবিদ বলছিলেন, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে দিশাহারা বহু ছাত্রছাত্রী। বিশেষ করে যারা পড়াশোনায় একটু ভালো, উঁচু ক্লাসের ছাত্রছাত্রী, বিদেশে পড়তে যাওয়ার কথা ভেবেছে, এদের মধ্যে উদ্বেগ সবচেয়ে বেশি। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক ওই নারীর বক্তব্য, উদ্বেগ এখন ডিপ্রেশনের জায়গায় গিয়ে পৌঁছেছে। তার কথায়, ''তবু তো শহরের স্কুলের ছেলেমেয়েরা অনলাইন পড়াশোনা করতে পেরেছে। গ্রামের দিকে গত দেড় বছরে কার্যত কোনো পড়াশোনা হয়নি। ওদের উদ্বেগ অন্যরকম।’’
মোহিত এবং সাত্যকি দুইজনেরই মত, অদূর ভবিষ্যতে ভারতীয়দের মধ্যে মানসিক রোগের পরিমাণ আরো বাড়বে। তার মূল কারণ, এই পরিস্থিতিতে সরকার এবং বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সাধারণ মানুষের পাশে যেভাবে দাঁড়ানো দরকার ছিল, তা তারা করছে না। বরং উল্টোটাই ঘটছে। মূল্যবৃদ্ধির হার ভয়াবহ। পেট্রোলের দাম একশ পেরিয়ে গেছে। ডিজেলও একশ ছুঁইছুঁই। রান্নার গ্যাসের দাম প্রায় প্রতিমাসে বাড়ছে। ভোজ্য তেলের দাম তিন মাসে দ্বিগুণ হয়েছে। সাধারণ খাবারের দাম আকাশছোঁয়া। তারই মধ্যে করোনার তৃতীয় ঢেউয়ের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। ফলে হতাশা বাড়ছে। এর থেকে পরিত্রাণ নেই।