বিতর্কে কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসব
২১ নভেম্বর ২০১৬তৃণমূল নেত্রী মমতা ব্যানার্জি পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসার পর প্রথম তাঁর সরকারের ব্যবস্থাপনায় যেবার চলচ্চিত্র উৎসব হল, দীর্ঘদিন উৎসবের নির্বাচক কমিটির সঙ্গে যুক্ত একজন একটি অকপট স্বীকারোক্তি করেছিলেন একান্তে তিনি বলেছিলেন, সেই প্রথম তাঁরা নিজেরা ছবি দেখে, ভালো-মন্দ বিচার করে উৎসবের ছবি বাছাই করেছেন৷ তার আগে সে সুযোগ তাঁরা পাননি৷ তার এক গুচ্ছ ছবি আগে থেকেই বাছা থাকত, তাঁরা কেবল সেই নির্বাচনে আনুষ্ঠানিক সম্মতি জানিয়ে দায় সারতেন৷ ধরেই নিতে হতো, সেই ছবিগুলিই পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন চলচ্চিত্র অনুরাগী মুখ্যমন্ত্রীর পছন্দ করে দেওয়া এবং বিনাবাক্যব্যয়ে সেই পছন্দে সায় জানাতে হতো নির্বাচকদের৷ এটা ঘটনা যে, যেই বাম আমলে ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ এবং প্রায় সময়ই রাজনৈতিক বিচারেও ভালো ছবি বাতিল হয়ে গেছে৷ মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি সেই শৃঙ্খলিত দশা থেকে কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবকে মুক্তি দিয়েছিলেন৷ উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানকে নন্দন প্রেক্ষাগৃহ থেকে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন আয়তনে অনেক বড় নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে, যাতে একসঙ্গে অনেক লোক সেটা দেখতে আসতে পারেন৷ মুষ্টিমেয় কিছু ‘সিনেবোদ্ধা'র জন্যে নয়, চলচ্চিত্র উৎসব যাতে সব অর্থেই বহুজনের উদযাপন হয়ে ওঠে, সেই চেষ্টা ছিল সেই প্রথম৷
এবারের ২২তম চলচ্চিত্র উৎসবেরও নতুন স্লোগান তৈরি হয়েছিল— ‘‘সিনেমার সবাই, সবার সিনেমা’’৷ এবং এবারও গত কয়েক বছরের রীতি মেনে মুম্বইয়ের জনপ্রিয় চিত্র তারকারা উদ্বোধনে হাজির ছিলেন৷ সস্ত্রীক অমিতাভ বচ্চন এবং পশ্চিমবঙ্গের ‘ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর’ শাহরুখ খান তো ছিলেনই, এসেছিলেন অভিনেত্রী কাজল, পরিণীতি চোপরা, অভিনেতা সঞ্জয় দত্ত৷ এঁদের মেগা গ্ল্যামারের পাশে বাংলার চলচ্চিত্রকারদের উপস্থিতি যদিও কিছুটা ম্লান ছিল, কিন্তু আমজনতার ভালো লেগেছে পছন্দের মহাতারকাদের চোখের সামনে দেখতে পেয়ে৷ এটাই অনেক বড় প্রাপ্তি বলে ধরে নেওয়া হয়েছিল৷
এরপর উৎসবের সূচনা হলো একটি বাংলা ছবি দেখিয়ে৷ কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধন বাংলা ছবি দিয়ে এই প্রথম৷ কারণ হিসেবে যেটা শোনা গেল, বাংলা ছবিকেও বিশ্বের দরবারে তুলে ধরতেই এই বেনজির সিদ্ধান্ত৷ মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির অন্যতম প্রিয় শব্দ ‘বিশ্ব বাংলা'র প্রতিফলন ছিল সেই সিদ্ধান্তে, সেটাও সবাই বুঝেছিলেন৷ কিন্তু চলচ্চিত্রকে স্রেফ বিনোদন হিসেবে দেখেন না, বরং আরও সিরিয়াস চিন্তা-ভাবনার রসদ হিসেবে দেখেন, এমন মানুষজন প্রশ্ন তুলছেন— কেন বাংলা ছবি? আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্দেশ্য কি আঞ্চলিক ছবিকে তুলে ধরা, নাকি সারা বিশ্বে হালফিলে যেসব চলচ্চিত্র তৈরি হচ্ছে, যা আলোচিত হচ্ছে বিশ্বজুড়ে, সেগুলো দেখে নিজেদের আরও ঋদ্ধ করা, আরও শিক্ষিত হওয়া? বাংলা ছবিকে প্রচারে আনার জন্য আলাদা করে বাংলা চলচ্চিত্রের উৎসব করলেই তো হয়! আর তার থেকেও কূট তর্ক যেটা, যে আমার হাতে মঞ্চ আছে বলেই গুণমানের তোয়াক্কা না করে বাংলা ছবির প্রদর্শনী করিয়ে বিশ্বের কাছে আদৌ কতটা মুখ উজ্জ্বল হবে? বিশেষ করে যেখানে অন্যান্য আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে বাংলা ছবি নির্বাচিত হয় কালেভদ্রে৷ সে ছবি দর্শক-সমালোচকদের কাছে সমাদৃত হওয়া, বা উৎসবের প্রতিযোগিতা বিভাগে পুরস্কৃত হওয়ার ঘটনা আরও বহু যোজন দূরের ব্যাপার! তা হলে কেন এমন অদ্ভুত সিদ্ধান্ত?
বাংলা চলচ্চিত্র শিল্পের সঙ্গে যুক্ত পরিচালক, শিল্পীদের অধিকাংশ অবশ্য প্রায় জয়ধ্বনি দিয়ে স্বাগত জানাচ্ছেন বৈপ্লবিক এই সরকারি সিদ্ধান্তকে৷ তাঁদের কথা শুনে মনে হচ্ছে, এর ফলে বাংলা ছবি যেন অচিরেই জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে! কিন্তু শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার হতে গেলে, আন্তর্জাতিক পরিচিতি পেতে গেলে যে অন্তত আন্তর্জাতিক মানের সমকক্ষ হতে হয়, সেই প্রাথমিক শর্তটা তাঁরা যেন বুঝেও না বোঝার ভান করছেন৷ এবং ভালো ছবি বানাতে গেলে যে চর্চা, যে নিবিড় অনুশীলনের প্রয়োজন, গত এক দশকে বাংলার চলচ্চিত্র চর্চায় তার ছাপ কোথায়, সে প্রশ্নও এঁদের কারো মাথায় আসছে না৷
সারা বিশ্বে এখন যে ধরনের ছবি তৈরি হচ্ছে, সুখ্যাতি পাচ্ছে, আধুনিক বাংলা ছবির একটাও সেই সব ছবির ধারেকাছে যেতে পারবে কিনা, সেই সমীক্ষাও হচ্ছে না৷ উল্টে, নিজের শহরে চলচ্চিত্র উৎসবে ভালো ছবি দেখার সুযোগ যে ক্রমশই সঙ্কুচিত হয়ে আসছে, সে নিয়েও এঁরা কেউ ভাবিত নন৷ নিয়মিত উৎসবে ছবি দেখতেন, এমন অনেকেই এবার উৎসাহ হারিয়েছেন৷ এঁরা প্রশ্ন তুলছেন, সিনেমা সবার জন্যে, এটা খুব ভালো কথা, শুনতে ভালো লাগে, কিন্তু ভালো জিনিসটা শেখার কী হবে! কীভাবে হবে, যদি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব তার আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গীটাই হারিয়ে ফেলে? যদি তার বিশ্ববীক্ষা না থাকে!
প্রিয় পাঠক, আপনি কিছু বলতে চাইলে নীচে মন্তব্যের ঘরে লিখুন৷