কাজিনদের মধ্যে বিয়ে পাকিস্তানে জন্ম দিচ্ছে অসুস্থ শিশু
৯ ফেব্রুয়ারি ২০২২গফুর হুসেইন শাহ একজন শিক্ষক৷ তিনি জানেন বৃহত্তর পরিবারের ভাই-বোনদের মধ্যে বিয়ের ফলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মে কত জটিল ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে৷ তারপরও নিজের বিয়েটা পরিবারের বাইরে করতে পারেননি৷ ১৯৮৭ সালে বিয়ে করেছিলেন মামাতো বোনকে৷ এখন তিনি আট সন্তানের জনক৷ আট সন্তানের তিনজনই অসুস্থ৷ এক ছেলের মস্তিষ্কের স্বাভাবিক বিকাশ হয়নি৷ এছাড়া এক মেয়ে ঠিকভাবে কথা বলতে পারে না, অন্য মেয়েটি একটুও কানে শোনে না৷ ৫৬ বছর বয়সি শিক্ষক গফুর হুসেইন শাহ তিন সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব চিন্তিত৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘আমার আফসোস ওরা লেখা লেখাপড়াই করতে পারলো না৷ এখন সবসময় শুধু একটা কথাই ভাবি- আমি আর আমার স্ত্রী যখন থাকবো না, তখন কে দেখবে ওদের!''
শিক্ষক হয়ে, সমাজের সচেতন অংশের নাগরিক হয়েও তাহলে কেন মামাতো বোনকে বিয়ে করলেন? গফুর হুসেইন শাহ জানালেন, সামাজিক চাপের কাছে নতি স্বীকার করতে হয়েছিল তাকে৷ পাকিস্তানের অনেক জায়গায় যে এখনো পরিবারের বাইরে বিয়ে করলে সমাজচ্যুত হতে হয় – এ বাস্তবতাও উঠে এলো তার বক্তব্যে৷
গফুর হুসেইন শাহ যে নিজেই শুধু মামাতো বোনকে বিয়ে করেছেন তা-ই নয়৷ চিকিৎসকরা বলেছেন, ফুপাতো ভাই- মামাতো বোনের বিয়ের কারণেই তাদের তিনটি সন্তান জটিল শারীরিক সমস্যা নিয়ে জন্মেছে৷ তারপরও এক ছেলে আর দুই মেয়েকে নিকটাত্মীয়ের সঙ্গেই বিয়ে দিয়েছেন৷ তাই এতদিন নিজের তিন সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুর্ভাবনা হতো, এখন অন্য তিন সন্তানের সন্তানদের কী হবে সেই চিন্তায়ও থাকতে হয় গফুর হুসেইন শাহকে৷
শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ হুমা আরশাদ চিমা জানান, চাচাতো, ফুপাতো, মামাতো ভাই-বোনদের মধ্যে বিয়ের কারণে প্রতিবন্ধিত্ব, রক্তের জটিল সমস্যা, অন্ধত্ব, কানে না শোনার মতো নানা ধরনের রোগ নিয়ে জন্ম নিচ্ছে অসংখ্য শিশু৷ থ্যালাসেমিয়া নিয়ে সবচেয়ে বেশি শিশু জন্ম নিচ্ছে বলেও জানান তিনি৷
পাকিস্তানের বেশ কিছু এলাকার উপজাতীয়দের মধ্যে বিয়ে মানেই আন্তঃ-পরিবার বিয়ে৷ তারা মনে করেন, পরিবারের মধ্যে বিয়েই ইসলামসম্মত৷ তাই অনেক ক্ষেত্রে চিকিৎসকেরা অনেক চেষ্টা করেও এ ধরনের বিয়ের ঝুঁকির দিকটা কাউকে বোঝাতে পারেন না৷ করাচির ডা. সিরাজ উদ-দৌলাহ তাই কয়েকন মওলানার সহায়তাও চেয়েছিলেন৷ কিন্ত তাতে কোনো লাভ হয়নি৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘ আমি মওলানাদের বলেছিলাম জেনেটিক কিছু রোগের বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানোয় ভূমিকা রাখতে৷ তাদের অনুরোধ জানিয়েছিলাম, তারা যেন কাজিনদের মধ্যে বিয়ে যে জেনেটিক ডিজিজ বাড়াতে পারে সে বিষয়টি সবাইকে একটু বুঝিয়ে বলেন৷ কিন্তু মওলানারা মনে করেন, এ ধরনের বিয়ে শরিয়া আইনসম্মত, তাই এর বিরুদ্ধে কথা বলা সম্ভব নয়৷’’
সাম্প্রতিক উদ্যোগ এবং প্রাপ্তি
২০২০ সালের মার্চ মাসে বংশানুক্রমিক রোগের বিস্তার রোধের জন্য এক বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করে পাকিস্তানের পাঞ্জাব রাজ্য সরকার৷ লাহোরের শিশু হাসপাতালগুলোতে দেয়া হয় বিনা খরচে ‘জেনেটিক স্ক্রিনিং’-এর সুযোগ৷ জার্মানির জেন্টোজেন ডায়াগনোস্টিকসের সহায়তায় শুরু হওয়া এই উদ্যোগের ফলে বেরিয়ে এসেছে ভয়াবহ এক তথ্য৷ পাঞ্জাব স্বাস্থ্য বিভাগের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘এ পর্যন্ত আমরা ৩০ হাজার পরিবারের মধ্যে জেনেটিক ডিসঅর্ডারের আলামত পেয়েছি৷’’
ডা. সিরাজ উদ-দৌলাহ মনে করেন, আন্তঃ-পরিবার বিয়ে ব্যাপক হারে চলতে থাকলে সমস্যা খুব দ্রুত আরো খারাপ হবে আর সেই আশঙ্কা দূর করতে হলে ধর্মীয় নেতাদের সহায়তা চাইতে হবে সরকারকে৷
এস খান (ইসলামাবাদ)/ এসিবি