পশ্চিমবঙ্গের পর্যটন
২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৩এক কথায় বলতে গেলে, হেলিকপ্টারে পেয়েছে পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে৷ বিশেষ করে কোনও পর্যটন সম্ভাবনার কথা বলতে গেলেই সবার আগে বিমান অথবা হেলিকপ্টার উড়ানের খোয়াব দেখতে শুরু করেন সরকারি মন্ত্রী-আমলারা৷ যেমন কিছুদিন আগেই ঢাক-ঢোল পিটিয়ে ঘোষণা হয়েছে, আকাশপথে কলকাতা শহর দর্শনের গগনচুম্বি এক পরিকল্পনার কথা৷ রাজ্য পর্যটন উন্নয়ন নিগমের উদ্যোগে নাকি হেলিকপ্টার উড়বে কলকাতার আকাশে৷ আগে এ শহরের বড়লোকেরা ঘোড়ায় টানা ফিটন গাড়িতে চড়ে গড়ের মাঠে হাওয়া খেতে যেতেন৷ আর একালের বাবু-বিবিরা কয়েক হাজার টাকা খরচ করলেই হেলিকপ্টারে চড়ে শহরের মাথায় উড়ে উড়ে হাওয়া খেতে পারবেন৷
এবার সেই হেলিকপ্টার পর্যটনের হাওয়া লাগল সুন্দরবনের গায়ে৷ সম্প্রতি রাজ্যের পর্যটনমন্ত্রী কৃষ্ণেন্দু নারায়ণ চৌধুরি ঘোষণা করেছেন, সুন্দরবনের ঝড়খালিতে তৈরি হবে বিলাসবহুল রিজর্ট৷ অন্তত তিন তারকা খচিত সেই পর্যটন কেন্দ্রে আরও নানা আমোদের পাশাপাশি থাকবে হেলিকপ্টারে চড়ে আকাশপথে সুন্দরবন দেখার ব্যবস্থা৷ পরিবেশ যদি বিঘ্নিত হয় ওই এলাকায় হেলিকপ্টার উড়লে, বা বন্যপ্রাণীরা যদি বিরক্ত হয় – এমনতর সব সম্ভাবনা হেলায় উড়িয়ে দিয়েছেন মন্ত্রীমশাই৷ তিনি আত্মবিশ্বাসী, যে পরিবেশ দপ্তর তাঁদের সব আকাশকুসুম পরিকল্পনায় একবাক্যে সায় জানাবে৷
ঠিক কী হতে পারে সত্যিই ঝড়খালিতে হেলিকপ্টার উড়লে? তার আগে চট করে একবার দেখে নেওয়া যাক, এই ঝড়খালি জায়গাটি ঠিক কেমন৷ সুন্দরবনের যেকটি প্রত্যন্ত অরণ্য অঞ্চল যাতায়াতের আয়ত্বে আছে, ঝড়খালি তাদের মধ্যে একটি হলেও এখানে প্রকৃতিকে মানব সভ্যতার উৎপাত এখনও সেভাবে সহ্য করতে হয়নি৷ তার একটা কারণ অবশ্যই ঝড়খালির দুর্গমতা৷ মাতলা, বিদ্যেধরী এবং হেড়োভাঙ্গা – এই তিন নদী তিন দিক থেকে ঝড়খালিকে আগলে আছে৷ এর আগে ঝড়খালিতে বাণিজ্যিক তৎপরতা বলতে একমাত্র হয়েছে মাছ চাষ, যা সবদিক দিয়েই সুন্দরবনের প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে মানানসই৷
প্রায় ১৫ বিঘা জলাজমি আছে ঝড়খালিতে, যা মাছচাষের, বিশেষ করে চিংড়ি মাছ চাষের উপযুক্ত প্রাকৃতিক ক্ষেত্র গড়ে দিয়েছে৷ কিন্তু মানুষের লোভ আরও বেশি৷ ওই ১৫ বিঘা জলাজমি বুজিয়ে তার উপর তারকা-খচিত রিজর্ট গড়ে তোলার কথা ভেবেছে সরকার, কোনও বেসরকারি লগ্নিকারের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে৷ পশ্চিমবঙ্গের মূল ভূখণ্ড থেকে সেই রিজর্টে যাবেন পর্যটকরা, তার জন্যে ওই পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ, অর্থাৎ তথাকথিত ‘পিপিপি' মডেলেই ঝড়খালি যাতায়াত করবে বিলাসবহুল ক্রুজ লাইনার৷ আন্দাজ করাই যায় যে, চলতি স্টিমার বা লঞ্চে যাতায়াত করাটা বিত্তবান পর্যটকদের পোষাবে না৷
পর্যটনমন্ত্রী অবশ্য বিতর্ক এড়াতে আগাম বলে দিয়েছেন, সাধারণ মধ্যবিত্ত পর্যটকদের জন্য বাজেট-বন্ধু বন্দোবস্তও থাকবে ওই তারা মার্কা রিজর্টে৷ এবং থাকবে হেলিকপ্টার! কিন্তু শুনেই প্রমাদ গুণেছেন বন্যপ্রাণ বিশেষজ্ঞরা৷ কারণ বেচারা হরিন, বাঁদর, বুনো শুয়োর, এমনকি রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারও এত পর্যটনের উন্নয়ন বা পশ্চিমবঙ্গের আর্থিক সমৃদ্ধির মারপ্যাঁচ বোঝে না৷ তারা স্রেফ জঙ্গলে, নিজেদের জায়গায় শান্তিতে থাকতে চায়৷ কিন্তু হেলিকপ্টারের উৎকট আওয়াজে তাদের সেই শান্তি নষ্ট হবে এবং কিছুদিনের মধ্যেই তারা পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবনের দিক থেকে চলে যাবে বাংলাদেশের সুন্দরবনের দিকে, আর হয়ত ফিরবে না৷
তবে সুন্দরবনের আরও বেশি বাঘ এবং অন্যান্য বন্যপ্রাণী বাংলাদেশের দিকে চলে যাবে, এতে যতটা খুশি হওয়ার কথা, তা কিন্তু বাংলাদেশ হবে না৷ কারণ ওই সুন্দরবন অঞ্চলে ভারত এবং বাংলাদেশ এক আন্তর্জাতিক জল ও আকাশসীমার নিয়মনীতি মেনে চলে, কোনও খুশিয়াল পর্যটকের ফূর্তির খাতিরেই যেটা লঙ্ঘন করা যায় না৷ পররাষ্ট্র সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটাই সবথেকে বড় সমস্যার জায়গা হবে৷ কারণ, হেলিকপ্টারে চড়ে কেউ হাওয়া খাবে বলে আকাশসীমা পেরিয়ে বার বার অনুপ্রবেশ হবে, এটা কোনও দেশ মেনে নেবে না৷ সেক্ষেত্রে প্রতিবার উড়ানের আগে বাংলাদেশের এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের অনুমতি লাগবে, যেটা আদৌ বাস্তবসম্মত নয়৷
ফলে সুন্দরবনের আকাশে শেষ পর্যন্ত হয়ত হেলিকপ্টার উড়বে না৷ যুক্তিসঙ্গত কারণেই উড়বে না, আর সেজন্য দুই পা তুলে আশীর্বাদ করবে সুন্দরবনের যাবতীয় বন্যপ্রাণী৷