কালো টাকা সাদা করতে ছবি প্রযোজনা
৩১ অক্টোবর ২০২৩রেশন দুর্নীতির টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছিল বাংলা ছবির প্রযোজনাতেও। প্রাথমিক তদন্তে এমনই তথ্য পেয়েছে ইডি। ইডির হাতে রেশন দুর্নীতিতে ধরা পড়েছেন মন্ত্রী ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী বাকিবুর রহমান। তিনি সিনেমায় টাকা ঢেলেছিলেন।
বাকিবুরের ছবি
'ম্যানগ্রোভ' নামের একটি বাংলা সিনেমার প্রযোজক ছিলেন বাকিবুর। ২০১৪-র এই ছবির টাইটেল কার্ডে তার নাম রয়েছে। সূত্রের খবর, সেই 'ম্যানগ্রোভ' সিনেমার পরিচালক খাদ্য দপ্তরের কর্মী, কাহিনি লিখেছিলেন এই দপ্তরেরই এক উচ্চপদস্থ আধিকারিক। রেশন দুর্নীতিতে তৎকালীন খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক সদ্য গ্রেপ্তার হয়েছেন ইডির হাতে।
এই ছবির কুশীলবদের তালিকাতেও চমক রয়েছে। অভিনয় করেছেন সাবেক মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বান্ধবী অর্পিতা মুখোপাধ্যায়। দুজনেই নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় এখন জেলবন্দি।
টলিউডের কয়েকজন বিখ্যাত অভিনেতা-অভিনেত্রী ম্যানগ্রোভ ছবিতে কাজ করেছেন। রাখি সাওয়ান্ত, নাইজেল আকারা, দোলন রায় প্রমুখ। কিন্তু ছবি তৈরিতে হঠাৎ কেন বিনিয়োগ করতে গেলেন বাকিবুর? অনুমান করা হচ্ছে, কালো টাকা সাদা করতেই এই কৌশল নেয়া হয়েছিল।
সূত্রের খবর, তদন্তকারীরা বাকিবুরের অন্তত ১০০ কোটির সম্পত্তির খোঁজ পেয়েছেন। ব্যবসায়ীর নামে-বেনামে কিংবা পরিজনদের পরিচয় ব্যবহার করে সম্পত্তি কেনা হয়েছে। ভুয়ো সংস্থাও তৈরি করা হয়েছিল। এ সবের মধ্যে ছবিতে বিনিয়োগ দুর্নীতির টাকা সরানোর একটি কৌশল ছিল বলে মনে করা হচ্ছে।
কালো টাকা সিনেমায়
দুর্নীতির কালো টাকা সাদা করার মাধ্যম হিসেবে সিনেমায় বিনিয়োগের তথ্য এর আগেও পাওয়া গিয়েছে। স্কুলে নিয়োগ দুর্নীতিতে ধৃত সাবেক তৃণমূল যুব নেতা কুন্তল ঘোষ বাংলা ছবিতে বিনিয়োগ করেছিলেন।
টলিউডের পরিচালক ও অভিনেতাদের নাম জড়িয়ে যায় কুন্তলের সঙ্গে। পরিচালক রানা সরকার থেকে অভিনেতা বনি সেনগুপ্ত টাকা নিয়েছেন বলে অভিযোগ ওঠে। কুন্তলের টাকায় গাড়ি কিনেছিলেন বনি। কেন্দ্রীয় সংস্থার জিজ্ঞাসাবাদের মুখে পড়া এই অভিনেতা গাড়ির জন্য নেয়া ৪০ লক্ষ টাকা ফেরতও দিয়েছেন।
পুরসভার নিয়োগ দুর্নীতিতে গ্রেপ্তার অয়ন শীল টাকা ঢেলেছিলেন ছবি প্রযোজনাতে। ২০২০ সালে 'কাবাড্ডি কাবাড্ডি' নামে একটি ছবি প্রযোজনায় তিনি হাত দেন। শ্বেতা চক্রবর্তী নামে এক মডেল ও অভিনেত্রীর নাম উঠে আসে। এছাড়া টেলিভিশন ধারাবাহিক প্রযোজনাতেও অয়ন এগিয়ে এসেছিলেন বলে তদন্তে উঠে এসেছে।
টলিউডের শীর্ষ তারকা তৃণমূল সাংসদ দীপক অধিকারী ওরফে দেব গরু পাচারের টাকায় সিনেমা করেছেন বলে অভিযোগ তোলে বিজেপি। বিধায়ক ও টলিউডের অভিনেতা হিরণ চট্টোপাধ্যায়ের এই অভিযোগ দেব খারিজ করে দিয়েছেন। তবে দেবকে তদন্তকারীদের জিজ্ঞাসাবাদের মুখে পড়তে হয়েছে।
শিল্পীদের দায়
টলিউডের অভিনেতা ও শিল্পীরা বারবার বলেছেন, প্রযোজকদের টাকার উৎস বিচার করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। বাকিবুরের 'ম্যানগ্রোভ' ছবির অভিনেতা নাইজেল আকারার মন্তব্য, "কেউ কালো টাকা সাদা করার জন্য সিনেমা বানাচ্ছেন কি না, সেটা আমাদের পক্ষে যাচাই করা সম্ভব নয়। বাকিবুরকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনিও না।"
এই ছবিতে ছোট একটি চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন দোলন রায়। তিনি বলেন, "বাকিবুরকে চিনতাম না। শুটিংয়ে এসেছেন কি না, সেটাও বলতে পারব না। আমি কাজ করে টাকা নিয়েছি। এখন টাকার উৎস বুঝতে পেরে খারাপ লাগছে।"
অভিনেতা ও বিজেপি নেতা রুদ্রনীল ঘোষ বলেন, "শাসক দল ঘনিষ্ঠ কয়েকজন ব্যবসায়ী তাদের টাকা টলিউডে ঢালছেন। একের পর এক নাম উঠে আসছে। তবে পরিচালক বা অভিনেতাদের বোঝা মুশকিল টাকা কোথা থেকে আসছে।"
চিত্র পরিচালক অনীক দত্ত ডয়চে ভেলেকে বলেন, "হাতে কাজ নেই, কাজ পাওয়া সহজ নয়। তাই একজন অভিনেতা বা শিল্পী প্রযোজককে জিজ্ঞেস করতে পারেন না যে, তার টাকা সাদা না কালো। অমিতাভ বচ্চন বলতে পারেন, কোম্পানির ব্যালেন্স শিট দেখান, তবে অভিনয় করব। সেটা ক'জন পারবেন?"
পরিস্থিতি বদলাবে?
শুধু টলিউড নয়, বলিউড-সহ দেশের অন্যান্য রাজ্যের চলচ্চিত্র শিল্পেও কালো টাকার মৃগয়া অজানা কোনো বিষয় নয়। পৃথিবীর অন্যত্র এমন উদাহরণ রয়েছে। এটা বন্ধ করা কি সম্ভব নয়?
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ফিল্ম স্টাডিজের অধ্যাপক মানস ঘোষ বলেন, "সরকার এটা নিয়ে মাথা ঘামায় না। কালো টাকার একটা অংশ অর্থনীতির মধ্যে চলে আসে সিনেমায় বিনিয়োগের মাধ্যমে। সেখান থেকে সরকারেরও কিছু প্রাপ্তি হয়। নইলে ওই কালো টাকার নাগাল পাওয়া যেত না।"
অনীক দত্তের বক্তব্য, "শুধু সিনেমা তো নয়, সব শিল্পে কালো টাকা বিনিয়োগ করা হয়। প্রশাসন চাইলে তবেই এটা বন্ধ হতে পারে। অর্থাৎ কঠোর আইন দরকার। অবৈধ টাকার উৎসব বন্ধ হলেই এই বাকিবুররা আর তৈরি হবে না। তা হলে বিনিয়োগের প্রশ্নও আসবে না।"