কেন অশান্ত ভারতের অরুণাচল প্রদেশ?
২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯রাজ্যে বসবাসকারী ছয়টি উপজাতি গোষ্ঠীকে ‘স্থায়ী বাসিন্দা সার্টিফিকেট' বা পিআরসি দেয়া নিয়ে দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে৷
রাজ্যের নামসাই ও চাংলাং জেলায় বসবাসকারী আদিবাসী, দেওরি, গোর্খা, মিশিং, মোরান এবং সোনওয়াল কাচারির জনজাতির মানুষদের ‘স্থায়ী বাসিন্দা সার্টিফিকেট' বা পিআরসি দেয়ার সম্ভাবনা তৈরি হতেই গত ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে অশান্ত হয়ে উঠেছে অরুণাচলের রাজধানী ইটানগর৷ শহরে কারফিউ জারি হয়েছে৷ আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে ‘অল অরুণাচল প্রদেশ স্টুডেন্টস ইউনিয়ন' (এএপিএসইউ)-র দপ্তরে৷ পরিস্থিতি আয়ত্ত্বের বাইরে যেতে দেখে সেনা নামানোর সিদ্ধান্ত নেয় সরকার৷ শহরে রুট মার্চ করেছে ভারতীয় সেনা৷ লাগাতার অশান্তির জেরে ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ রাখা হয়েছে, দোকানপাট খোলেনি৷ ‘ক্যাশলেস' হয়ে পড়েছে এটিএম৷
দিল্লি থেকে পরিস্থিতির উপর নজর রাখছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক৷ কিছুদিন পর গোটা দেশে সাধারণ নির্বাচনের সঙ্গেই বিধানসভা নির্বাচন হতে চলেছে অরুণাচল প্রদেশে৷ এমনিতে শান্তির মরুদ্যান হিসেবে পরিচিত এই রাজ্যটি গণবিক্ষোভ ও রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্য প্রসিদ্ধ৷
অশান্তি মাত্রা ছাড়াতে দেখে পিছু হটেছে রাজ্য সরকার৷ বাতিল করা হয়েছে পিআরসি-র সিদ্ধান্ত৷ সরকার পুলিশের গুলিতে নিহতদের পরিবারকে ২০ লক্ষ টাকা করে আর্থিক সহায়তার পাশাপাশি পরিবারের একজনকে চাকরির দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে৷ আহতদের প্রত্যেককে ১০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়ার ঘোষণাও করা হয়েছে৷ সেইসঙ্গে রাজ্যের মুখ্য সচিব সত্য পাল এক বিবৃতি জারি করে জানিয়েছেন, ‘‘বর্তমান পরিস্থিতির কারণে পিআরসি-তে মঞ্জুরি দেয়ার সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখা হলো৷ আপাতত কোনো পদক্ষেপ নেবে না সরকার৷''
সমস্যা কোথায়?
দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে সাংবাদিকতার সূত্রে উত্তর-পূর্বের কয়েকটি রাজ্যের সঙ্গে নাড়ির টান গড়ে উঠেছে কলকাতার সাংবাদিক শুভেন্দু রায়চৌধুরির৷ অরুণাচলের ঘটনা প্রসঙ্গে তাঁর ব্যাখ্যা, ‘‘অসম রাজ্য ভেঙে একাধিক রাজ্য তৈরির সময় থেকেই এই সমস্যা জন্ম নিয়েছে৷ বহু মানুষ দীর্ঘদিন ধরে সমস্যায় জর্জরিত হয়ে রয়েছেন৷ ভারতীয় হওয়া সত্ত্বেও কোনও রাজ্য যদি নাগরিকের দায়িত্ব না নেয় তাহলে এতগুলো মানুষ যাবে কোথায়? শিশুদের বিদ্যালয়ে ভর্তি বা হাসপাতালে চিকিৎসা থেকে শুরু করে যাবতীয় সরকারি সুবিধা পেতে নানা অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয় তথাকথিত বহিরাগতদের৷ তবে, মনে রাখতে হবে, এঁদের বেশিরভাগই ভারতীয়৷'' তাঁর মতে, উভয় পক্ষকেই কাছে টেনে নিতে হবে৷ খেয়াল রাখতে হবে, কেউই যেন বঞ্চিত না হয়৷
শুভেন্দু রায়চৌধুরি বলেন, ‘‘পিআরসি-র দাবি জানানো জনজাতিগুলি এবং আন্দোলনকারী ভূমিপুত্রদের প্রতিনিধিদের মুখোমুখি বসিয়ে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে হবে৷ পারস্পরিক সহাবস্থানের সূত্র মেনে এগোতে হবে৷ সেক্ষেত্রে সরকারকে শুধুমাত্র মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করতে হবে৷ জোর করে সরকারি সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া হলে তার ফল আরও ভয়ানক হতে পারে৷''
ছ'টি জনজাতি গোষ্ঠীকে পিআরসি দেয়ার দাবি দীর্ঘ প্রতীক্ষিত৷ ১৯৯২-৯৩ থেকে পিআরসি দেয়ার কাজ স্থগিত রাখা হয়েছে৷ গতবছর পিআরসি মঞ্জুর করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছিল রাজ্য সরকার৷ তারপর থেকেই শুরু হয়েছিল একটি প্রভাবশালী গোষ্ঠীর আন্দোলন৷ সেইসময় সরকারের বক্তব্য ছিল, পিআরসি প্রদান করার আগে ‘জয়েন্ট হাই পাওয়ার কমিটি'র রিপোর্টের সুপারিশ খতিয়ে দেখবে সরকার৷ এই কমিটির চেয়ারম্যান রাজ্যের মন্ত্রী নবাম রেবিয়া৷
অরুণাচলের মুখ্যমন্ত্রী পেমা খান্ডু সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ‘‘সংবাদমাধ্যম ও সোশাল মিডিয়ায় স্পষ্ট করে জানানো হয়েছে সরকার পিআরসি নিয়ে কোনও আলোচনায় যাবে না৷''
অশান্তির ধরণ কেমন?
ইটানগরে গিয়ে হেনস্থার শিকার হয়েছেন সিনেমা নির্মাতা উৎপল বরপূজারী৷ ডয়চে ভেলেকে নিজের অভিজ্ঞতা জানালেন তিনি৷ বললেন, ‘‘ইটানগর ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে একটি ছবি প্রদর্শনের কথা ছিল৷ সেজন্য গিয়েছিলাম৷ উত্তেজিত জনতা এসে উৎসবের মঞ্চ জ্বালিয়ে দিল৷ শিল্পীদের মারধর করে তাঁদের গাড়ি-সহ যাবতীয় সরঞ্জাম জ্বালিয়ে দেওয়া হলো৷ তারপরেও ইটানগর জুড়ে তুমুল অশান্তি অব্যাহত৷ এমনকি, শপিং কমপ্লেক্সে লুটপাট চলেছে৷ পুলিশের গুলিতে কয়েকজনের মৃত্যু হয়েছে৷''
তাঁর মতে, ‘‘সরকারি ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি ছিল৷ আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের আয়োজন হলে তার উপযুক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকা উচিত ছিল৷ শিল্পীদের নিরাপত্তার বিষয়টি আরও গুরুত্ব দেওয়া জরুরি ছিল, সরকার তা করেনি৷''
রাজনীতি
তবে, এ নিয়ে রাজনীতি থামেনি৷ সমস্যার সমাধানের বদলে অভিযোগ, পালটা অভিযোগে ব্যস্ত রাজনীতিকরা৷ অরুণাচল প্রদেশের বিজেপি সভাপতি টাপুর গাও সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ‘‘এই অশান্তির পেছনে রয়েছে কংগ্রেস৷ সরকার ইতিমধ্যেই সিদ্ধান্ত স্থগিত রেখে আলোচনার কথা ঘোষণা করেছে৷ তা সত্ত্বেও রাজ্যে বিজেপি সরকারকে অস্থির করে তুলতে ষড়যন্ত্র করা হয়েছে৷''
এদিকে, রাজ্য কংগ্রেসের সভাপতি টাকাম সঞ্জয় বলেছেন, ‘‘নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে কংগ্রেসের ঘাড়ে দোষ চাপানো হচ্ছে৷ বিধানসভায় পিআরসি বিল কে এনেছে? শহর জুড়ে তুমুল অশান্তি প্রমাণ করে দিয়েছে রাজ্যে আইন-শৃঙ্খলা বলে কিছুই নেই৷ সেনাবাহিনীকে ডাকতে হয়েছে৷ মোবাইল ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে৷ এই পরিস্থিতিতে অবিলম্বে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করা উচিত৷''