1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

কেন এভাবে ইউরোপ যাচ্ছে বাংলাদেশিরা?

২১ মে ২০১৮

লিবিয়ার জোয়ারসাহারা থেকে নৌকায় ইটালির পথে রওয়ানা হয়েছেন ২০০ মানুষ৷ ৩৮ ঘণ্টা ধরে নৌকা চলছে৷ হঠাৎ পাটাতনে পানি চলে আসে৷ শেষ মুহূর্তে কোস্টগার্ড এসে উদ্ধার করায় বেঁচে যান বাংলাদেশের মাগুরার ছেলে রুবেল শেখ৷

https://p.dw.com/p/2y0OX
Tunesien Libyen Flüchtlinge aus Bangladesch an der Grenze Reisepass
ছবি: dapd

নিজে বেঁচে গেলেও অসংখ্য বাংলাদেশিকে মৃত্যুর মুখে পতিত হতে দেখেন রুবেল৷ সেটা ছিল ২০১৫ সালের ২৭ আগস্টের কথা৷ সমুদ্রপথে লিবিয়া যাওয়ার পথে ২৪ জন বাংলাদেশিসহ ১১৮ জনের মৃত্যু হয়, যা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও প্রকাশিত হয়েছে৷ কোস্টগার্ড পরে ট্রলারে থাকা জীবিত ব্যক্তিদের উদ্ধার করে বিভিন্ন ক্যাম্পে নিয়ে যায়৷ ট্রলারের পাটাতনের নীচ থেকে উদ্ধার করা হয় বাংলাদেশিসহ অর্ধশত লাশ৷ ইঞ্জিনের গরমে ও শ্বাসরুদ্ধ হয়ে তাঁদের মৃত্যু হয়েছে বলে আমাকে জানিয়েছিলেন ওই দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়া রুবেল শেখ৷

সমুদ্রপথ পাড়ি দিতে গিয়ে ২০১৫ সালে নিহত সিরীয় শিশু আয়লানের ছবি সবাইকে কাঁদিয়েছিল৷ কিন্তু আমরা কতজন জানি লিবিয়ায় নিহত বাংলাদেশি শিশু ইউসুফের কথা? বাবা রমজান আলীর সাথে শিশুটি সেদিনি ভেসে গিয়েছিলে ভূমধ্যসাগরে৷ 

‘নগ্ন করে নির্যাতন করা হয় শরণার্থীদের’

ঐ ঘটনায় নিহত বাংলাদেশিদের একজন শাহাদাতের বাড়ি লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জে৷ শাহাদাতের মা বকুল আক্তার আমাকে আহাজারি করে বলেছিলেন, ‘‘আমার একটাই ছেলে৷ ওর বাপও সৌদিতে থাকে৷ আমরা সবাই শাহাদাতকে না করেছিলাম এভাবে যেতে৷ ওর বাবাও বলেছে, তুই আমার একটাই ছেলে, যাইস না৷ কিন্তু ছেলেটা আমার পৃথিবী থেকেই চলে গেল৷ আমি কী নিয়ে বাঁচবো?''

এই ঘটনা নিয়ে আমি যে সংবাদ করেছিলাম তার শিরোনাম ছিল, ‘মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে লিবিয়া থেকে ইটালির পথে'৷ ছেলে হারানোর আড়াই বছর পেরিয়ে গেলেও শাহাদাতের মায়ের সেই আহাজারি যায়নি৷ ওদিকে সমুদ্রপথ পাড়ি দিয়ে শাহাদাত বা রুবেলদের ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টাও বন্ধ হয়নি৷ একসময় সাংবাদিক হিসেবে আর এখন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক-এর অভিবাসন বিভাগের প্রধান হিসেবে ইউরোপ ফেরতদের পুনরেকত্রীকরণের কাজ করতে গিয়ে নিয়মিত এই ধরনের ঘটনা শুনতে হচ্ছে আমায়৷

বিদেশে কর্মসংস্থানে গত বছর নতুন রেকর্ড গড়েছে বাংলাদেশ৷ ঐ বছর ১০ লাখ আট হাজার ৫২৫ জন বাংলাদেশি চাকরি নিয়ে বিদেশে গেছেন৷ আবার সে বছরেরই ৫ মে ব্রিটেনের প্রভাবশালী দৈনিক ইনিডিপেনডেন্ট একটি সংবাদ প্রকাশ করে৷ শিরোনাম ছিল ‘বাংলাদেশ ইজ নাও দ্য সিঙ্গেল বিগেস্ট কান্ট্রি অফ অরিজিন ফর রিফিউজিস অন বোটস অ্যাজ নিউ রুট টু ইউরোপ এমারজেস'৷ এই সংবাদে লিবিয়া থেকে সমুদ্রপথ পাড়ি দেয়াসহ ইউরোপে কীভাবে অবৈধ বাংলাদেশিরা প্রবেশ করছে, তার তথ্য তুলে ধরা হয়৷ ওদিকে গত বছর মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মানবপাচার বিষয়ক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অবস্থান আরেক ধাপ নীচে নেমেছে৷

সমুদ্রপথ পাড়ি দিয়ে বা অবৈধভাবে বাংলাদেশিরা যেমন ইউরোপে প্রবেশ করছেন, তেমনি দেশটিতে গিয়ে আশ্রয় চাওয়ার সংখ্যাও কম নয়৷ ইউএনএইচসিআর-এর তথ্য ঘেটে জানা গেল, গত এক দশকে প্রায় এক লাখ বাংলাদেশি ইউরোপে আশ্রয় চেয়েছেন৷ এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৭ হাজার ৭৭৪ জন আশ্রয় চেয়েছেন ২০১৫ সালে৷ আগের বছরগুলো ধরলে এই সংখ্যা লাখ দেড়েক হয়ে যাবে৷

বিখ্যাত ব্লগার অমি রহমান পিয়াল বর্তমানে আছেন সুইজারল্যান্ডে৷ তিনি বলেন, তাঁর রাজনৈতিক আশ্রয়ের কারণ ভিন্ন৷ তবে ইউরোপে যাঁরা উদ্বাস্তু হিসেবে আসছেন, তাঁদের একটা বড় অংশ অর্থনৈতিক কারণে আসছেন৷ ইটালি যাওয়া সহজ বলে বাংলাদেশের লোকজন সমুদ্রপথ পাড়ি দিয়েও যাচ্ছেন৷ 

জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) তথ্য অনুযায়ী, ভূমধ্যসাগর দিয়ে যত মানুষ প্রবেশ করেছেন, সেই তালিকার শীর্ষ দশ দেশের নাগরিকদের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান এখন অষ্টম৷ বাংলাদেশের সঙ্গে যে দেশগুলো শীর্ষ তালিকায় আছে সেগুলো হলো – সিরিয়া, নাইজেরিয়া, গায়েনা, আইভরি কোস্ট, মরক্কো, ইরাক, আলজেরিয়া, ইরিত্রিয়া এবং গাম্বিয়া৷ খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠতে পারে, বাংলাদেশের নাগরিকরা কেন আফ্রিকা বা যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার নাগরিকদের সাথে এভাবে সিরিয়া পাড়ি দিচ্ছে? 

ইউরোপীয় কমিশনের পরিসংখ্যান দপ্তর ইউরোস্ট্যাট-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০৮ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত এক লাখেরও বেশি বাংলাদেশি ইউরোপের দেশগুলোতে অবৈধভাবে প্রবেশ করেছেন৷ এই বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে না নিলে ভিসা বন্ধের হুমকিও দিয়েছিল ইউরোপ৷ এই ধরনের চাপ একটা স্বাধীন দেশের জন্য খুবই অস্বস্তিকর৷

এই তো বছর দুয়েক আগেও সাগরপথ দিয়ে হাজারো মানুষের মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে যাওয়ার কারণে বাংলাদেশ বিশ্বজুড়ে খবর হয়েছিল৷ মালয়েশিয়ার সেই গণকবরগুলোর স্মৃতি ভুলবো কী করে! এই যে বিদেশের স্বপ্নে বিভোরতায় মৃত্যুঝুঁকি নেওয়া, সেটা থামবে কবে?

কিন্তু কেন এত লোক এভাবে ইউরোপে যাচ্ছেন? সাংবাদিক হিসেবে বোঝার চেষ্টা করেছি৷ সিরিয়া, লিবিয়ায় না হয় যুদ্ধ চলছে, তাই সেখানকার নাগরিকরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সুমদ্রপথ পাড়ি দিচ্ছেন৷ কিন্তু বাংলাদেশিরা কেন জীবনের এত ঝুঁকি নিচ্ছেন? শুধুই কি ভাগ্য অন্বেষণ, নাকি যে কোনোভাবে বিদেশে যাওয়ার নেশা৷

বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম সম্প্রতি তরুণদের মধ্যে যে জরিপ করেছে, তাতে দেখা গেছে আরও ভালো জীবনযাপন এবং পেশার উন্নতির জন্য বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার ৮২ শতাংশ তরুণই নিজের দেশ ছেড়ে চলে যেতে চান৷ এ সব তরুণ মনে করেন না যে নিজের দেশে তাঁদের ভবিষ্যৎ আছে৷ তাছাড়া এমনিতেই বাংলাদেশিদের মধ্যে বিদেশ যাওয়ার স্বপ্ন ভয়াবহ৷ প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, গত চার দশকে এক কোটি বাংলাদেশি চাকরি নিয়ে বিদেশে গেছেন৷ আর এঁদের ৭৫ শতাংশই গেছেন মধ্যপ্রাচ্যে৷

অবৈধভাবে কত লোক বিদেশে যান তার কোনো হিসেব বাংলদেশের কোনো দপ্তরে নেই৷ তবে এক যুগেরও বেশি সময় অভিবাসন ও মানবপাচার বিষয় নিয়ে সাংবাদিকতা করতে গিয়ে দেখেছি, সংখ্যাটা কম নয়৷

২০১১ সালের ১৮ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবসে একটি প্রতিবেদনে দেখিয়েছিলাম, ছাত্র বা পর্যটক সেজে কিংবা নানা পন্থায় বছরে অন্তত এক লাখ মানুষ অনিয়মিত পন্থায় বিদেশে যান৷ এর কারণ, বিদেশের স্বপ্নে বিভোর বহু মানুষ মনে করেন যে সাগর, মরুভূমি পাড়ি দিয়ে বিদেশে গেলেই মিলে যাবে স্বপ্নের চাবিকাঠি৷ আর সেটা যদি ইউরোপ হয়, তাহলে তো কথাই নেই৷

ইউরোস্ট্যাট-এর পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, গত আট বছরের মধ্যে ২০১৫ সালে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক, প্রায় ২১ হাজার ৪৬০ বাংলাদেশি, ইউরোপে গেছেন৷ ইউরোপের জেলখানায় থাকা এবং দেশে ফেরত আসা অনেকের সাথেই নানা সময় কথা হয়েছে আমার৷ তাঁরা বলছেন, লিবিয়া যুদ্ধ শুরুর পর বহু মানুষ ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে প্রবেশ করেছেন৷ এছাড়া সিরিয়ায় শরণার্থীদের পরিস্থিতির সুযোগে সেই প্রচেষ্টা আরও বেড়ে যায়৷ মানবপাচারকারীরা তখন বাংলাদেশিদের ইউরোপ যেতে প্রলুব্ধ করে৷ ফলে ২০১৫ সাল থেকেই সংখ্যাটি বাড়ছে৷ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে যাঁরা কাজ করতেন, তাঁদের অনেকেই মানবপাচারকারীদের প্রলোভনে পড়ে ইউরোপের পথে পাড়ি দিয়েছেন ইতিমধ্যে৷

অবৈধভাবে ইউরোপে প্রবেশ করে গ্রেপ্তার হয়ে ফিরে আসাদের একজন ময়মনসিংহের সাইফুল ইসলাম৷ জানালেন, ইরাকে যাওয়ার জন্য জমি বিক্রয় করে দালালকে ছয় লাখ টাকা দিয়েছিলেন তিনি৷ কিন্তু সেখানে বেতন খুব কম ছিল৷ তখন একজন তাঁকে ইউরোপে যাওয়ার প্রস্তাব দেয়৷ কিন্তু ২২ দিন সাগরে থাকার পর গ্রিসের সাগর পাড়ের কাছে গেলে পুলিশে ধরে ফেলে তাঁকে৷ সাত মাস বন্দি থাকার পর ফিরে আসেন তিনি৷ তাঁর কথা, অনেকেই এভাবে যাচ্ছে৷ তাই তিনিও গেছেন৷

লিবিয়া থেকে সাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টা করেতে গিয়ে গ্রেপ্তার হওয়া অনেকেই দেশে ফিরে একইরকম নানা ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছেন৷ তাঁরা বলছেন, ঢাকা থেকে লিবিয়া বা তুরস্ক যেতে একজনকে দশ হাজার ডলারের বেশি অর্থ দিতে হয়৷ এরপর একটি চক্র ঢাকা থেকে তাঁদের দুবাই বা তুরস্কে নেয়৷ পরে বিমানে করে লিবিয়া পৌঁছান তাঁরা৷ সেখান থেকে ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টা করেন৷ এছাড়া লিবিয়ায় অনেকদিন ধরে আছেন এমন লোকজনও পরবর্তীতে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিচ্ছেন ইউরোপে যাওয়ার নেশায়৷

আইওএম-এর ঢাকার কর্মকর্তাদের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার সুবাদেও এভাবে লিবিয়া ও ইউরোপে যাওয়া লোকজনের তথ্য জেনেছি৷ আইওএম এভাবে ২০১৫ সালে ৫২১ জন, ২০১৬ সালে ৩০৭ জন এবং ২০১৭ সালে ৯২৪ জনকে ফিরিয়ে এনেছে৷ তাঁদের অনেকে বলছেন, মূলত ইউরোপে গেলেই ভাগ্য ফিরবে, এমন আশাতেই তাঁরা গিয়েছিলেন৷

ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মধ্যে সমন্বয়ের কাজ করে ফ্রন্টেক্স নামের একটি সংগঠন৷ ২০১৫ সাল থেকে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ আছে আমার৷ তারা বলছে, ইউরোপ অভিমুখে এখন শরণার্থীদের যে স্রোত, তাতে অনেক বাংলাদেশি রয়েছেন৷ বিশেষ করে লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে ইটালি (সেন্ট্রাল মেডিটেরিয়ান রুট) যাচ্ছেন হাজার হাজার বাংলাদেশি৷

ফ্রন্টেক্স-এর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ সাল থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সেন্ট্রাল মেডিটেরিয়ান রুট দিয়ে প্রবেশ করতে গিয়ে ২৮ হাজার ৮৪৪ জন বাংলাদেশি গ্রেপ্তার হয়েছেন৷ একইভাবে ইস্টার্ন মেডিটেরিয়ান রুটের স্থলপথ দিয়ে ১০ হাজার ২১৭ জন জন এবং সাগরপথ দিয়ে ৪ হাজার ৮০০ জন ইউরোপে প্রবেশ করতে গিয়ে গ্রেপ্তার হয়েছেন৷

গত দু-তিন বছরে ইউরোপে লোক পাঠানোর নামে প্রতারণা, সাগর পাড়ি দিতে গিয়ে ট্রলার ডুবি, ইউরোপের জেলে বন্দি, তুরস্কে গ্রেপ্তার, এমন অসংখ্য ঘটনার সংবাদ করতে হয়েছে৷ এখনো লোকজনের ধারণা, যে কোনোভাবে ইউরোপে যেতে পারলেই বোধহয় ভালো থাকা যাবে৷ পরিস্থিতি যে এখন ভিন্ন, ইউরোপ যে এখন আর অবৈধভাবে আসা লোকজনকে আশ্রয় দিতে রাজি নয়, বরং কাগজপত্রহীন মানুষগুলোকে নিজ দেশে ফেরত পাঠিয়ে দিচ্ছে, এমন তথ্য জানা নেই বহুজনের৷

গত বছর তো ইউরোপ বলেই বসলো, অবৈধ এ সমস্ত লোকজনকে দ্রুত ফিরিয়ে আনা না হলে বাংলাদেশের নাগরিকদের ভিসা বন্ধ করে দেওয়া হবে৷ যথাযথ কাগজপত্রবিহীন মানুষগুলোকে এখন ইউরোপ নিজ দেশে ফেরত পাঠিয়ে দিচ্ছে৷ এ জন্য গত বছরের সেপ্টেম্বরে নিউ ইয়র্কে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলী এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা ইইউ-র অভিবাসন বিষয়ক মন্ত্রী ইউরোপ থেকে অনিয়মিত বাংলাদেশিদের ফেরত আনার জন্য একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন৷

তবে এই মানুষগুলোর জীবন যেন থমকে না যায়, সেজন্য দেশে ফেরত আসার পর তাঁদের পুনরেকত্রীকরণের উদ্যোগও নিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন৷ আইওএম-এর সঙ্গে বাংলাদেশে সেই কাজটি এখন করছে ব্র্যাক৷ অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান হিসেবে ফিরে আসা এই মানুষগুলোর জীবনের গল্প শুনছি৷ বিভিন্ন পথ পাড়ি দিয়ে কীভাবে তাঁরা ইউরোপে গেছেন, সেই গল্পগুলো শুনলে গায়ে কাঁটা দেয় আজও৷

এঁদেরই একজন শরীয়তপুরের কিবরিয়া৷ তিনি প্রথমে ভারতে যান৷ সেখান থেকে দালালরা নিয়ে যায় তাঁকে পাকিস্তানে৷ এরপর জাল পাসপোর্ট বানিয়ে পাকিস্তান থেকে ইরান, তারপর তুরস্কে যান তিনি৷ প্রতি ধাপেই তাঁকে টাকা দিতে হয়৷ অন্যথায় চলে নির্যাতন৷ তুরস্ক থেকে একদিন রাতে নৌকা করে যান গ্রিসের পথে৷ গ্রিসে পৌঁছে ছ'মাস কাজ করার পর ধরা পড়লে দেশে ফিরতে হয় তাঁকে৷ বিপজ্জনক জেনেও কেন এতে বেশি বাংলাদেশি এভাবে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে? তাঁর উত্তর, ‘‘কাজ নেই দেশে৷''

কাজের সন্ধানে একটু কম শিক্ষিতরা যেমনি ইউরোপে যাচ্ছেন, তেমনি ইউরোপে গিয়ে রাজনৈতিক বা অন্য কোনো আশ্রয় চেয়েছেন এমন লোকের সংখ্যাও অনেক৷ ইউএনএইচসিআর-এর তথ্য অনুযায়ী, গত দুই দশকে প্রায় দেড় লাখ বাংলাদেশি ইউরোপে আশ্রয়প্রার্থনা করেছেন৷ এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আবেদনকারী ইটালিতে৷ এই সংখ্যা ৩২ হাজার ২৮৫ জন৷ এছাড়া ফ্রান্সে ৩১ হাজার ৪৩৭ জন, গ্রিসে ১৮ হাজার ২৩১ জন, হাঙ্গেরিতে  ১০ হাজার ২৫৬ জন, জার্মানিতে ৭ হাজার ৩০১ জন, সাইপ্রাসে ৭ হাজার, অস্ট্রিয়াতে ৬ হাজার ৪১৭ জনসহ ইউরোপের নানা দেশে কম-বেশি আশ্রয় চেয়েছেন৷

ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৭ হাজার ২১৫ জন বাংলাদেশি ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করেছেন৷ এঁদের মধ্যে ১১ হাজার ৭১৫ জনের আবেদন প্রত্যাখ্যাত হয়েছে৷ কথা হলো, এত মানুষজন কেন ইউরোপে আশ্রয় চাইছেন?

শাহবাগের গণজাগরণের আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত বর্তমানে জার্মান প্রবাসী শাম্মী হক বললেন, একটা বড় অংশ অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য আসলেও তাঁর মতো অনেকেই বাধ্য হয়ে বা বাঁচার জন্য ইউরোপে রাজনৈতিক আশ্রয়ের পথকে বেছে নিচ্ছেন৷ তিনি বলেন, যাঁরা বাধ্য হয়ে আসছেন, এই যেমন ব্লগার, অ্যাক্টিভিস্ট – তাঁদের অনেকেরই বাংলাদেশে ভালো ভবিষ্যৎ ছিল, অনেকেই সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল৷ শিক্ষা, ভালো চাকরি ইত্যাদি সব কিছুই ছিল তাঁদের৷ এঁরা যখন দেশ ছাড়তে বাধ্য হলেন, তাঁদের ঐ সুযোগটা কিংবা সময় ছিল না কোনো দেশ নির্বাচন করার৷ তাই তাঁরা যেখানে বা যে পন্থা সহজ পেয়েছেন, সেটাকেই বেছে নিয়েছেন৷ এক্ষেত্রে অবশ্য আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল৷ আর এই আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো বেশিরভাগই ইউরোপকেন্দ্রিক৷

বর্তমানে জার্মানিতে সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত শাম্মীর মতে, তিনি শুধুমাত্র একজন বাংলাদেশি ‘রিফিউজি' হয়ে থাকতে চাননি৷ জার্মানি তাঁকে সুযোগ দিয়েছে বলেই জার্মান গণমাধ্যমে তিনি একজন সাংবাদিক হিসেবে কাজ করতে পারছেন৷

বাংলাদেশের আরেকজন কার্টুনিস্ট আরিফুর রহমান রাজনৈতিক আশ্রয়ে আছেন নরওয়েতে৷ তিনি বলেন, কেউ রাজনৈতিক আশ্রয় চায় কারণ দেশে নিরাপত্তা নেই৷ নিজের অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘‘মনের সুখে দেশ ছাড়িনি৷ অনেক নির্যাতন, হয়রানির শিকার হতে হয়েছে৷ দেশে থাকলে এতদিন হয়ত বেঁচেই থাকতাম না৷'' ধর্মীয় উগ্রবাদের উত্থানকে তিনি তাঁর দেশ ছাড়ার একটা বড় কারণ বলে উল্লেখ করেন৷ 

শরিফুল হাসান
শরিফুল হাসান, ব্র্যাক-এর অভিবাসন বিভাগের প্রধানছবি: Privat

সপ্তাহখানেক আগের ঘটনা৷ ৪ ও ৫ মে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেয়ার সময় ৪৭৬ জন অভিবাসনপ্রত্যাশীকে উদ্ধার করলো স্পেনের নৌ উদ্ধার সার্ভিস৷ পরদিন ৬ মে লিবিয়ার কাছে জলসীমায় ১০৫ জন অভিবাসীকে উদ্ধার করা হয়েছে৷ মোটরবিহীন ঐ নৌকায় মিশর, লিবিয়া, নাইজেরিয়ার সাথে ছিল বাংলাদেশের অনেক নাগরিক৷ বার্তা সংস্থা এপির তথ্য অনুযায়ী, মানবপাচারকারী ও তাঁরা পৃথক নৌকায় যাচ্ছিলেন৷ তবে ভূমধ্যসাগরের মাঝখানে তাঁদের নৌ-যানের ইঞ্জিন খুলে নিয়ে পাচারকারীরা চলে যায়৷

দীর্ঘদিন অবৈধভাবে জার্মানিতে থেকে সম্প্রতি দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন নারায়ণগঞ্জের বাসিন্দা মনির হোসন৷ পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করা মনির আড়াই লাখ টাকা খরচ করে যান দুবাই৷ সেখান থেকে তিনি তুরস্কে পাড়ি জমান৷ এতে খরচ হয় ন'লাখ টাকা৷ তুরস্ক থেকে তিনি জার্মানি যান এবং সেখানে তিন বছর কাজ করেন৷ মনির জানান, তাঁর মতো অনেকেই ইউরোপে যাচ্ছেন নিজের ভাগ্যের চাকা বদলাতে৷ কিন্তু এভাবে সাগরপথে পাড়ি দিতে গিয়ে অনেকেরই প্রাণ যাচ্ছে৷

জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ থেকে ২০১৭ সালে ১৭  লাখ ৬৬ হাজার ১৮৬ জন ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেন৷ এভাবে সাগরপথে আসতে গিয়ে অন্তত ১৫ হাজার মানুষ প্রাণও হারান৷ কিন্তু তবুও ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টা থেমে নেই৷ প্রশ্ন হলো কবে থামবে? আর কত মানুষের প্রাণ গেলে হুঁশ ফিরবে আমাদের?

প্রিয় পাঠক, আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য