কেন চেয়ে আছো গো মা....মুখপানে..
৩ জুলাই ২০১১ছোট্ট রবির কাছেও দেশ এসে হাজির
দেশ যে পরাধীন, সে যে বহু প্রহারে জর্জরিত, দেশমাতৃকার করুণ মুখ যে নিত্যনিয়ত লাঞ্ছনায় মলিন, এই খবরটি তো শিশুকাল থেকে ঠাকুর পরিবারের ছোট্ট রবির কাছেও ছিল৷ সে বাড়ির আবহাওয়ায়, আচার আচরণে, আদবকায়দায় স্বদেশের প্রতি সুগভীর ভালোবাসার বীজ বোনা ছিল যে! একটু বড়ো হতে না হতে ততদিনে মেজদাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বদেশের মঙ্গলের চিন্তায় অস্থির৷ তৈরি করতে চান দেশীয় কাপড়ের কল৷ টেক্বা দিতে চান ফিরিঙ্গি বণিকদের৷ দেশলাই থেকে শুরু করে তাঁত পর্যন্ত, বহু চেষ্টাই করেছেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ৷ দেশীয় জাহাজ বানাবার জন্য জাহাজের খোল কিনেছে ঠাকুর পরিবার৷ জাহাজ চালিয়েছে সে সময়ের পূর্ববঙ্গে৷ সেগুলি হয়তো সবক্ষেত্রে সফল হয়নি, কিন্তু বেড়ে ওঠার সময়ে সঠিক দেশপ্রেমের ছাপটি রেখে গেছে রবীন্দ্রনাথের মধ্যে৷
গান আর দেশের প্রতি ভালোবাসা
পরাধীন দেশের কষ্ট, শোষণ আর নিপীড়নের ছবি একের পর এক আন্দোলন রবীন্দ্রনাথের মধ্যে গভীর প্রভাব ফেলেছে৷ দেশ তো শুধুই একটা ভূখণ্ড নয়, দেশ একটা বোধ, দেশ সেই সাংস্কৃতিক পরিচয়, যেখানে জীবন স্বাভাবিক চেহারা নিয়ে ধরা দেয়৷ সেই পরিমণ্ডলে বিদেশি শাসককে গ্রহণ করার জ্বালা যে কতটা, রবীন্দ্রনাথের গানে তার ফিরে ফিরে দেখা মিলেছে৷ বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় গোটা দেশের মানুষ তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছে, তিনি রাখিবন্ধন উৎসব চালু করেছেন৷ অরন্ধন গোটা দেশে৷ দুই ধর্মের মধ্যে রাজশক্তি যাতে ফাটল না ধরাতে পারে, সেদিকেই ছিল তাঁর লক্ষ্য৷ এই বাংলাভাগের বিরুদ্ধেই তাঁর গান ছিল..বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু বাংলার ফল..পুণ্য হউক পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, হে ভগবান৷
নাইট উপাধি আর জালিয়ানওয়ালাবাগ
তারিখটা ১৩ এপ্রিল, ১৯১৯ সাল৷ পাঞ্জাবিদের বিখ্যাত উৎসব বৈশাখি৷ সেই উৎসবেই তিনদিকে পাঁচিল ঘেরা জালিয়ানওয়ালাবাগের সেই চত্বরে কয়েক হাজার মানুষের শান্তিপূর্ণ ধর্মীয় জমায়েত৷ পুলিশের ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ও' ডায়ারের মনে হল, বিদ্রোহের প্রস্তুতি চলছে৷ কোন সুযোগ না দিয়ে সরু গলি দিয়ে ঢুকে এল ৫০ জন পুলিশ৷ জেনারেলের অর্ডার শুনেই শুরু হল নির্বিচারে গুলিবর্ষণ৷ নারী, পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধা – কেউ বাদ পড়েনি৷ নিহতের মোট সংখ্যা দেড় হাজারের বেশি ছিল সেদিন, দাবি কংগ্রেসের৷ জালিয়ানওয়ালাবাগে অসহায় নিরীহ নারী পুরুষের জমায়েতে জেনারেল ও'ডায়ারের ভয়ংকর অমানুষিক অত্যাচার যেদিন ঘটল, নির্বিচার গুলিতে অকারণে মারা গেল মানুষ, তার মাত্র কয়েকদিন আগেই নাইট বা সার উপাধি পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ৷ জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে সে উপাধি ফিরিয়ে দিলেন তিনি৷
স্বদেশের কাজের প্রত্যক্ষতা
স্বদেশের জন্য তিনি প্রত্যক্ষভাবে কাজ করেছেন৷ তাঁকে রাজনীতিতে সরাসরি আনার চেষ্টা ছিল সব মহল থেকেই৷ কিন্তু সেখানকার পঙ্কিল পথ তাঁর পছন্দ হয়নি৷ রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে ইংরেজি ভাষা, ইংরেজি পোষাক আর খানাপিনার বাহুল্য দেখে, ওপরওলা তোষণের নির্লজ্জ চেহারা দেখে গভীর আক্ষেপের সঙ্গে তিনি তাই লিখেছেন.. ‘‘যারা তোমারে দূরে রাখি নিত্য ঘৃণা করে/হে মোর স্বদেশ,/মোরা তারি কাছে ফিরি সম্মানের তরে/পরি তারি বেশ৷/…….তোমার যা দৈন্য মাতঃ তাই ভূষা মোর/কেন তাহা ভুলি!/পরধনে ধিক গর্ব ! করি করজোড় /ভরি ভিক্ষার ঝুলি! /পুণ্য হস্ত শাক-অন্ন তুলে দাও পাতে/তাই যেন রুচে;/মোটা বস্ত্র বুনে দাও যদি নিজ হাতে/তাহে লজ্জা ঘুচে৷'' ( কল্পনা, ভিক্ষায়াং নৈব নৈব চ') ৷
স্বদেশের যে কর্মের মাধ্যমে দেশের প্রকৃত উন্নতি সম্ভব, রবীন্দ্রনাথের মতে ছিল, তা পল্লীর মঙ্গল৷ সেই উদ্দেশ্য আর দর্শন থেকেই তাঁর শ্রীনিকেতনের যাত্রা শুরু৷ যা আজও দেশপ্রেমের উজ্জ্বল নজির হিসেবে পথিকৃৎ একটি প্রতিষ্ঠান৷
প্রতিবেদন: সুপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায়
সম্পাদনা: সঞ্জীব বর্মন