বাংলাদেশে রবীন্দ্রচর্চা - এক
১২ জুন ২০১১বাঙালি মানসে রবীন্দ্রনাথ নতুন ও নতুনতর প্রাণস্পন্দনের প্রতীক৷ রবীন্দ্রজয়ন্তীর এই সার্ধশতবার্ষিকেও তাই রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে আমাদের বিস্ময়ের অন্ত নেই, এখনো আমাদের জিজ্ঞাসার শেষ নেই৷ প্রাণময় তাঁর সৃষ্টির রহস্য আমাদের কাছে শেষ হয় না৷ আমরা সেই অশেষকে কবির সমগ্র সৃষ্টিলীলার সঙ্গে মিলিয়ে এখনো সন্ধান করে চলেছি৷
রবীন্দ্রনাথকে অনুভব করা, অনুধ্যান করার কাজটি বাংলাদেশে কখনো সরলরেখা অনুসরণ করে চলেনি৷ বঙ্কিম, একপেশে ও জটিল দৃষ্টিভঙ্গিতে রবীন্দ্রনাথকে অনেক সময় দেখা হয়েছে৷ আর এ অবস্থাটি সবচেয়ে বেশি দেখা গিয়েছিল বাংলাদেশ যখন পূর্ববঙ্গ বা পূর্ব পাকিস্তান ছিল তখন৷
দেশবিভাগের পর আমাদের সাহিত্য ও সংস্কৃতির বলয়ে রবীন্দ্রনাথের অবস্থান নিয়ে বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক মহলে তর্কবিতর্কের সূত্রপাত ঘটে৷ এ বিতর্ক সৃষ্টি করেন সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী দুটি ধারার বুদ্ধিজীবীগণ৷ এঁদের মধ্যে একদিকে ছিলেন বামপন্থি বুদ্ধিজীবী অন্যদিকে ছিলেন পাকিস্তানের আদর্শ ও ভাবধারার অনুসারী তথাকথিত ইসলামি তমদ্দুনপন্থি বুদ্ধিজীবী৷
বামপন্থিদের মতে রবীন্দ্ররচনা প্রগতিবিরোধী তাই তা পরিত্যাজ্য৷ আর পাকিস্তানি সংস্কৃতির বাহক বুদ্ধিজীবীর বক্তব্য: ‘‘নতুন রাষ্ট্রের স্থিতির প্রয়োজনে আমরা আমাদের সাহিত্যে নতুন জীবন ও ভাবধারার প্রকাশ খুঁজবো৷ সেই সঙ্গে এটাও সত্য যে, আমাদের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র বজায় রাখার এবং হয়তো বা জাতীয় সংহতির জন্যে যদি প্রয়োজন হয়, আমরা রবীন্দ্রনাথকেও অস্বীকার করতে প্রস্তুত রয়েছি৷''
পাকিস্তানি সংস্কৃতিপন্থী বুদ্ধিজীবীদের রবীন্দ্রবিরোধিতা ধীরে ধীরে তীব্র হয়ে ওঠে৷ এক পর্যায়ে তাঁরা রবীন্দ্রনাথেরই শুধু নয়, বাংলা ভাষার অবয়বের বিপক্ষেও অবস্থান নেন৷ তাঁদের মতে যা কিছু পাকিস্তানের আদর্শের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, তা সবই পরিত্যাজ্য৷
বামপন্থিদের রবীন্দ্রবিরোধিতা স্তিমিত হয়ে আসে৷ এক পর্যায়ে দেখা যায়, যাঁরা রবীন্দ্রনাথ ও বাংলাভাষার বিরোধিতায় লিপ্ত তাঁদেরই বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন এই বামপন্থি বুদ্ধিজীবীগণ৷
বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বিতর্কের প্রথম দিকে সকলেই যে রবীন্দ্রনাথের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন তা নয়৷ বেশির ভাগই ছিলেন রবীন্দ্রনাথের পক্ষে৷ প্রথম দিকে এঁদের নেতৃত্বে ছিলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ৷ বস্তুত এঁদেরই শক্ত অবস্থানের কারণে ঢাকার সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে প্রগতিশীলতার নতুন স্রোত বইতে শুরু করে এবং তা প্রতিক্রিয়াশীলদের রুখবার জন্য প্রস্তুত হয়৷
রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে এই রকম বিভিন্নমুখী, বিপরীতমুখী ভাবনাচিন্তার মাঝে চলে আসে ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিক৷ রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে দ্বন্দ্ব প্রকট হয়ে ওঠে প্রগতিশীল ও প্রতিক্রিয়াশীলদের মধ্যে৷ শুরু হয় প্রচণ্ড বাদানুবাদ৷
একদলের মতে রবীন্দ্রনাথ বিশ্বশান্তি ও বিশ্বমানবতার কবি৷ তাই তিনি আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য৷ এই দলের নেতৃত্ব দেন বিচারপতি এস.এম মুর্শেদ, কবি বেগম সুফিয়া কামাল, খান সারওয়ার মুর্শেদ প্রমুখ৷
অন্যদল বললেন, রবীন্দ্রনাথ যেহেতু হিন্দু তাই তিনি ভারতীয় ঐতিহ্য ও সভ্যতার ধারক ও বাহক৷ অতএব তিনি পাকিস্তানী মুসলমানদের কাছে অপাংক্তেয়৷
রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিকে, রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে এই বাদানুবাদের মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ পূর্ববঙ্গ বা বাংলাদেশে সার্থকভাবে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করেন৷ শতবার্ষিকের অনুষ্ঠানমালা রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য, সংগীত, নৃত্যকলা ও নাটককে বহু মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার কাজে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে৷ রবীন্দ্রচর্চায় তৈরি হয় আগ্রহ৷ রবীন্দ্রচর্চায় পথ দেখায় বুলবুল ললিতকলা একাডেমী, ছায়ানট, ঐকতান, ক্রান্তি, সৃজনী, সন্দীপন ইত্যাদি সাংস্কৃতিক সংঘ বা সংস্থা৷
এই পরিপ্রেক্ষিতে, রবীন্দ্রনাথের বিরোধীরা তখন বলা শুরু করলেন, ‘‘রবীন্দ্রনাথের দোহাই তুলিয়া অখণ্ড বাংলার আড়ালে আমাদের তামুদ্দনিক বিপদ ডাকিয়া আনার সুযোগ দেওয়া চলিবে না৷''
তমুদ্দনপন্থিদের সুযোগ এসে গেলো ১৯৬৫-তে পাক-ভারত যুদ্ধের সময়৷ বেতার থেকে রবীন্দ্রনাথ নির্বাসিত হলেন৷ আর সরকারি ফরমান বলে ১৯৬৭-তে রবীন্দ্রনাথ বেতারে নিষিদ্ধ হলেন৷
এই সব ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ ধীরে ধীরে বাঙালির আত্মপরিচয় ও স্বাধিকার আন্দোলনের হাতিয়ার হয়ে উঠলেন৷ নানান মাত্রায় রবীন্দ্রনাথকে অবলোকন করা শুরু হলো৷ রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে রচিত হলো নানান প্রবন্ধ ও গবেষণা গ্রন্থ৷
প্রাবন্ধিক গবেষকদের এই সব গবেষণাকর্ম এবং সংস্কৃতিকর্মীদের রবীন্দ্রচর্চায় আমাদের জাতিসত্তার জন্য রবীন্দ্রনাথ প্রচণ্ডভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠলেন৷ আমাদের জাতীয়তাবাদী ও স্বাধিকার আন্দোলনের দিনগুলোতে রবীন্দ্রনাথ হলেন নিত্যসঙ্গী৷ তারপর ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি'- হয়ে উঠলো মুক্তিকামী বাঙালির স্বপ্নের গান৷ আমাদের মুক্তিসংগ্রামে রবীন্দ্রনাথ এভাবেই অনিবার্যরূপে সংযুক্ত হলেন৷
প্রতিবেদন: ফরহাদ খান, রাজশাহী
সম্পাদনা: আব্দুল্লাহ আল ফারূক