কেন হিন্দুত্ববাদী সংঘের সাথে দেখা করলেন জার্মান রাষ্ট্রদূত?
২২ জুলাই ২০১৯ভারতের ‘রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ' বা ‘আরএসএস' বিশ্বের সবচেয়ে বড় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন৷ মোট সদস্য সংখ্যা ৬ লক্ষেরও বেশি৷ হিন্দুত্ববাদী মতাদর্শে চালিত বিশাল এই সংগঠনের সাথে চিরকালই লেগে রয়েছে চরমপন্থি হিন্দু জাতীয়তাবাদের তকমা৷
শুধু তাই নয়, সংঘের প্রথম ‘সরসংঘচালক' বা প্রধান এম এস গোলওয়ালকর বা অন্যতম নেতা ভি ডি সাভারকর বারবার প্রকাশ্যে জানিয়েছেন এই সংগঠনের ‘হিটলার'-প্রীতির কথা৷ তবুও গত ১৭ জুলাই ভারতে জার্মানির রাষ্ট্রদূত ওয়াল্টার জে লিন্ডনার নাগপুরে আরএসএসের প্রধান কার্যালয়ে গিয়ে বর্তমান সরসংঘচালক মোহন ভাগবতের সাথে দেখা করেন৷
একটি টুইটে তিনি সে কথা জানালে, জার্মান রাষ্ট্রদূতের সাথে তথাকথিত হিটলারপ্রেমী এই সংগঠনের নেতার দেখা হওয়া নিয়ে সোশাল মিডিয়ায় ব্যাপক আলোড়ন পড়ে গেছে৷
এই সাক্ষাতের সমালোচনা করছেন ভারতের সাংবাদিক, সমাজকর্মী থেকে সাধারণ জনতার অনেকে৷
‘দ্য ওয়ার' নিউজ পোর্টালের প্রধান সিদ্ধার্থ ভাটিয়া জানান, ‘‘আরএসএসের এই হিটলার-প্রেম কোনোদিনই গোপন ছিল না৷ সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের নামে ইহুদিদের ওপর নির্যাতনের বারবার প্রশংসা করেছেন সাভারকর-গোলওয়ালকর৷''
উল্লেখ্য, এই আরএসএসেরই রাজনৈতিক দল ভারতে বর্তমানে ক্ষমতায় থাকা ভারতীয় জনতা পার্টি৷ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীসহ বিজেপির অনেক নেতাই ছিলেন ‘হিন্দু স্বাভিমান' নিয়ে লড়া এই সংঘের সাথে জড়িত৷
লিন্ডনারের পদত্যাগ চেয়ে...
জার্মান রাষ্ট্রদূত লিন্ডনার নাগপুরে আরএসএস নেতৃত্বের সাথে দেখা করার পর পিটার ফ্রিডরিশ একটি অনলাইন আবেদন শুরু করেছেন৷ সেই আবেদনে সই সংগ্রহের মাধ্যমে লিন্ডনারের পদত্যাগ চাইছেন জার্মানিতে দক্ষিণ এশীয় রাজনীতির এই গবেষক৷
পিটার জানান, ‘‘লিন্ডনারের এই সাক্ষাৎ আসলে ভারতে গড়ে ওঠা হিন্দুত্ববাদ বা হিন্দু ফ্যাসিবাদের প্রতি প্রচ্ছন্ন সমর্থনের আভাস৷'' এবিষয়ে জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাইকো মাসের হস্তক্ষেপ দাবি করেন ফ্রিডরিশ৷
কেন এই সাক্ষাৎ?
ভারতের অন্যতম জনপ্রিয় সংবাদপত্র ‘দ্য হিন্দু'কে একটি সাক্ষাৎকারে লিন্ডনার আরএসএসের সাথে বৈঠক বিষয়ে তাঁর মতামত ব্যক্ত করেন৷ সেখানে তিনি বলেন যে বর্তমান ভারতে আরএসএস বা হিন্দু জাতীয়তাবাদের উপস্থিতিকে অস্বীকার করার মতো বাস্তবতা এখন নেই৷
ভারতে জার্মান রাষ্ট্রদূত হিসাবে কর্মভার সামলানোর সবে দু'মাস পেরিয়েছে লিন্ডনারের৷ এ অবস্থায় তাঁর নাগপুর-ভ্রমণ শুধুই ছিল বর্তমান ভারতের সাংস্কৃতিক গঠনকে বুঝতে চেয়ে একটি প্রয়াস, যা অনেকেই হয়ত ভুলভাবে উপস্থাপন করছে, বলে জানান তিনি৷
উল্লেখ্য, নাগপুরে বর্তমানে চলছে মেট্রোরেল বসানোর কাজ, যেখানে প্রচুর অর্থ লগ্নি করেছে জার্মান সরকার৷ হিন্দু জাতীয়তাবাদী সংগঠনের প্রাণকেন্দ্রে তাই লিন্ডনারের ভ্রমণ যে শুধুই আদর্শিক কারণে ছিল, তা বলা যাবে না৷
ভ্রমণের আদর্শগত কোনো পিছুটান না থাকলেও, লিন্ডনার আরএসএসের কর্মকাণ্ডে নাৎসি জার্মানি বা ফ্যাসিস্ত ইটালির ছোঁয়া দেখতে পেলেও ‘দ্য হিন্দু'কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে একবারও আরএসএসের বিপক্ষে কোনো কথা বলেননি৷ তাঁর মতে, ভারতে হিন্দুত্ববাদী চিন্তা ও রাজনীতি গোটা বিষয়টাই তাঁর কাছে এখনও ‘অপরিষ্কার অথচ ইন্টারেস্টিং'৷
সম্প্রতি, ২০ জুলাই ‘অপারেশন ভ্যালক্যুরি'র (সাবেক নাৎসি কর্ণেল ক্লাউস ফন স্টাওফেনব্যের্গের হিটলারকে মারার পরিকল্পনা) ৭৫ বছর পূর্ণ হলো৷ এই উপলক্ষে জার্মান চ্যান্সেলর ম্যার্কেল রাষ্ট্রীয় পরম্পরায় শ্রদ্ধা জানান ফন স্টাওফেনব্যের্গকে৷
যে জার্মান সরকার হিটলারকে মারার পরিকল্পনার রাষ্ট্রীয় উদযাপন করে, ‘সাচ্চা দেশপ্রেমিক' নাম দেয় স্টাওফেনব্যের্গকে, সেই সরকারেরই রাষ্ট্রদূত যখন ভারতে হিটলার-প্রেমী সংগঠনের জন্য প্রকাশ্যে একটিও নিন্দাবাক্য উচ্চারণ করেননা, তখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠতে বাধ্য৷