কেনেডির কাছে যুদ্ধ পরিস্থিতি তুলে ধরেন মিনারা
২৬ সেপ্টেম্বর ২০১২‘‘ছোট্ট ছেলে আলির কথা আমার খুব মনে পড়ে৷ মার্কিন সিনেটর এডওয়ার্ড এম কেনেডি যে আমাদের যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের এবং শরণার্থীদের দেখতে আসছেন সেই খবরটি আমাকে আলিই দিয়েছিল৷ সে একদিন বলছে, ‘আপনারা তো যান জেবি হাসপাতালে৷ কিন্তু জানেন যে, সেখানে এডওয়ার্ড কেনেডি আসছে? আপনারা আজকে জেবি হাসপাতালে যান৷ সেখানে কেনেডি আসছে৷ তাঁর সাথে গিয়ে কথা বলেন৷' আলি ছিল কাজের ছেলে৷ আমি সেসময় যে সাঈদ ভাইয়ের বাড়িতে ছিলাম, সেই বাড়ির কাজের ছেলে এসে আমাকে খবর দিল কেনেডি আসার৷ এই ছোট্ট ছেলেটির যে বুদ্ধিমত্তা - সেটি আমাকে খুব বিস্মিত করেছিল৷ ওরাও আমাদের এভাবে নানা খবর এনে দিতো৷'' ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে কীভাবে আলির মতো ছোট্ট ছেলেও সহায়তা করেছেন সেই কথায় বলছিলেন নারী মুক্তিযোদ্ধা মিনারা বেগম৷
মুক্তিযুদ্ধের এক পর্যায়ে বীর মুক্তিযোদ্ধারা কিছুটা হতাশ হয়ে পড়ছিলেন৷ এমনকি বিজয় এবং স্বাধীনতার ব্যাপারে কিছুটা সন্দেহ দানা বাঁধছিল অনেকের মনে৷ কারণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে তেমন কোনো খবর পাওয়া যাচ্ছিল না৷ এসময় বাংলাদেশের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন ও সহায়তা খুবই জরুরি ছিল৷ এমনই ক্রান্তিলগ্নে সিনেটর কেনেডি আগরতলা যান৷ সেই ঘটনা সম্পর্কে মিনারা বেগম ডয়চে ভেলে'কে জানান, ‘‘এডওয়ার্ড কেনেডি যেদিন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের দেখতে এসেছিলেন৷ আমি ও ফোরকান বেগম সেখানে গিয়েছিলাম৷ আমি সেসময়ও একটু ভালো ইংরেজি বলতে পারতাম৷ ফলে কেনেডির সাথে আমার অনেকক্ষণ কথা হয়েছিল৷ তিনি আমাদের যুদ্ধের পরিস্থিতি এবং যুদ্ধাহতদের অবস্থা দেখলেন৷ এরপর আমরা যখন কথা বলছিলাম, তখন আমরা তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে, আমাদের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কোথায় আছেন৷ তিনি বলেছিলেন, পরে জানাবো তোমাদের৷ তিনি পরে জানিয়েছিলেন যে, বঙ্গবন্ধু মিয়ানওয়ালি জেলে আছেন এবং ভালো আছেন৷ সেসময় যুগান্তর ও দ্য স্টেটসম্যান'সহ সেখানকার চার-পাঁচটা প্রথম সারির পত্রিকা কেনেডির সাথে তোলা আমাদের ছবি ছাপিয়েছিল৷ এছাড়া আমরা কীভাবে দেশের যুদ্ধের পরিস্থিতি এবং নারীদের করুণ অবস্থার কথা তাঁর কাছে তুলে ধরেছিলাম সেসবকিছুও পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল৷ এমনকি মার্কিন সরকার যদিও এই যুদ্ধে আমাদের পক্ষে ছিল না, তবুও মার্কিন জনতা স্বাধীনতাকামী বাংলার মানুষের পক্ষে উল্লেখ করে কেনেডি তাঁদের জন্য সম্ভব সকল সহযোগিতা করবেন বলে আশ্বাস দিয়ে গেছেন এমন কথাও খবরে এসেছিল৷''
দেশ স্বাধীন হলে দেশে ফিরে আবারও লেখাপড়ায় মনোনিবেশ করেন মিনারা বেগম৷ তবে একজন সৈনিক হিসেবে যুদ্ধ থেকে ফেরার পর নিজেদের অবস্থা কেমন ছিল সেসম্পর্কে তিনি বলেন, ‘‘আগে যেমন মাধ্যমিক পরীক্ষায় স্ট্যান্ড করেছিলাম যুদ্ধ থেকে ফিরে আর সেরকম ফলাফল করতে পারিনি৷ যুদ্ধ করার পর, মানুষ মারার পর, গ্রেনেড চালানোর পর মস্তিষ্কের উপর এর প্রভাব পড়ে৷ তারপরও আমি চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্সি পড়েছি৷ বাংলাদেশে আমিই প্রথম মেয়ে এই বিষয়ে পড়াশোনা করেছি৷ এছাড়া এমবিএ পড়ার পর তিতাস গ্যাস-এর প্রতিষ্ঠানে প্রথম নারী কর্মকর্তা হিসেবে চাকুরি শুরু করি৷''
সর্বশেষ তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি'র অর্থ বিভাগের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে অবসর গ্রহণ করেছেন মিনারা বেগম৷ মহিলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কেন্দ্রীয় পরিষদের সদস্য তিনি৷ এছাড়া বৃহত্তর ঢাকা সমিতির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন৷ এখনও বেশ কিছু বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় এবং অনাথ আশ্রমের সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত থেকে সমাজ সেবার কাজ করে যাচ্ছেন বীর নারী মিনারা বেগম৷
স্বাধীনতা অর্জনের ৪১ বছরে বাংলাদেশের অগ্রগতি সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘‘আমাদের অর্জন কিছু আছে অবশ্যই৷ কিন্তু একইসাথে অবক্ষয়ও রয়েছে৷ আমি মনে করি বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় বেশ ভালো আছে৷ তবে আমরা ভালো নেই৷ আমি দেশের কাছে, জাতির কাছে কিছু চাইনি এবং পাইনি৷ এছাড়া যে অর্থে আমরা দেশ স্বাধীন করেছি সেসব কিছু আমরা অর্জন করতে পারিনি৷ সেক্ষেত্রে আমাদের ব্যর্থতা আছে৷ ছোট্ট পরিসরের এই দেশে অনেক বেশি জনসংখ্যা৷ কিন্তু জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য সুষ্ঠু পরিকল্পনা এবং সেসব পরিকল্পনা অনুসারে কাজ করার মানসিকতার অভাব রয়েছে৷''
প্রতিবেদন: হোসাইন আব্দুল হাই
সম্পাদনা: জাহিদুল হক