কেরালার বিধ্বংসী বন্যার জন্য দায়ী প্রকৃতি, না মানুষ?
২১ আগস্ট ২০১৮ভয়াবহ বন্যায় বিপর্যস্ত ভারতের দক্ষিণী রাজ্য কেরালা গলাজলে ভাসছে৷ কেরালা বৃষ্টিপ্রধান রাজ্য হলেও এ বছরের বন্যার জন্য পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের মধ্যে নানা মত৷ পরিবেশ বিজ্ঞানী ডঃ সৌমিত্র মুখোপাধ্যায় জানালেন এর জন্য প্রকৃতি ও মানুষ সমান দায়ী৷
কেরালার চোখে জল৷ গত ৯ই আগস্ট থেকে এক নাগাড়ে মুষলধারে বৃষ্টির জন্য ভারতের দক্ষিণী রাজ্য কেরালার জনজীবন বিপর্যস্ত৷ এমনিতে কেরালা বৃষ্টিপ্রধান রাজ্য হলেও এ বছরে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ অন্যান্য বছরের তুলনায় ২৫০ শতাংশ বেশি৷ ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা, জলমগ্ন ৯ লক্ষ হেক্টর কৃষিজমি৷ জলবন্দি হাজার হাজার মানুষ৷ বন্যার পরে নানা রোগের প্রাদুর্ভাবের আশংকা৷ পুনর্বাসন এবং ওষুধপত্রের বন্দোবস্ত চলেছে পাশাপাশি৷ ত্রাণ শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে প্রায় ১১ লাখ মানুষ৷ কেরালায় বৃষ্টিপাত নতুন কিছু না হলেও এই ধরণের জানমালের ক্ষয়ক্ষতি গত ৯০ বছরের মধ্যে আর হয়নি৷ এর কারণ নিয়ে পরিবেশ ও আবহাওয়া বিশেষজ্ঞদের মধ্যে নানা মত৷ বৈশ্বিক উষ্ণায়ন এবং মানুষের অবিমৃষ্যকারিতা, বিভিন্ন কারণে ভারতের পশ্চিমঘাট পর্বতমালা ভৌগলিক দিক থেকে আজ বিপন্ন৷ লাগাতার চলছে পাথরকাটা, খনিজ সম্পদের লোভে খনন, নির্বিচারে বৃক্ষনিধন এবং নদীবক্ষে বড় বড় নির্মাণ যার অনিবার্য কারণ ভূমিধস৷ সরকারের হাতে নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা থাকা সত্বেও তা কাজে না লাগানো পশ্চিমঘাট পর্বতমালার অবস্থানগত এইসব চ্যালেঞ্জ কেরালার এই আকস্মিক বন্যা বিপর্যয়ের মূলে৷
কেরালার এই ভয়াবহ বন্যার কারণ জানতে চাইলে দিল্লির জহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিদ ডঃ সৌমিত্র মুখোপাধ্যায় ডয়চে ভেলেকে বললেন, ‘‘প্রকৃতিতে যে পরিবর্তন আসছে সেটাকে জলবায়ু পরিবর্তন বা ক্লাইমেটিক চেঞ্জ বলা হচ্ছে৷ আমাদের টোটাল হাইড্রোলজিক্যাল আবর্ত থেকে বায়ুমণ্ডলে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ খুব অল্প, ০.০০১শতাংশ৷ কিন্তু তারমধ্যে যদি কিছু পরিবর্তন হয় যেমন এ বছর যে পরিমাণ গরম পড়েছিল, তাতে বাষ্পীভবন বেশি হয়েছে৷ আর বাষ্পীভবন বেশি হওয়ায় স্বাভাবিক বৃষ্টির পরিমাণটাও বেশি হয়েছে৷ তবে হ্যাঁ, বৃষ্টির পরিমাণ সারা বছর যতটা হয়, এ বছর ততটাই হয়েছে৷ কিন্তু বৃষ্টির চরিত্রটা গেছে বদলে৷ অল্পদিনের মধ্যে প্রবল বর্ষণ হয়েছে কিছু কিছু এলাকায়৷ সব জায়গাতে সমানভাবে হচ্ছে না৷ কিছু কিছু জায়গায় অনাবৃষ্টি, কিছু কিছু জায়গায় প্রবল বৃষ্টি৷ এটাই হল জলবায়ু পরিবর্তনের ফল৷
পিঠ পেতে দুর্গতদের উদ্ধারের যে ভিডিও ভাইরালআর আমরা যদি মানুষের প্রভাব দেখি, সেটাও কম নয়৷ যেভাবে আমরা উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চালাচ্ছি, যেভাবে আমরা জমি ব্যবহার করছি সেটাও কম গুরুত্বপূর্ণ কারণ নয়৷ জনসংখ্যা বাড়ার জন্য বেশি বেশি ঘরবাড়ি বানাচ্ছি, গাড়ির পার্কিং-এর জায়গাগুলোকে কংক্রিট দিয়ে মুড়ে দিচ্ছি যারজন্য বৃষ্টির জল মাটির নীচে চুঁইয়ে যেতে পারে না৷ জমির ব্যবহার ঠিকমত না হওয়ার জন্য নানা রকম প্রাকৃতিক বিপর্যয় সৃষ্টি হচ্ছে৷ আসলে জলবায়ু পরিবর্তন মানুষ ও প্রকৃতি দুটোর মিলিত প্রভাব৷ একদিকে মানুষের কর্মকাণ্ড অন্যদিকে প্রাকৃতিক বিপর্যয়৷ যেমন ২০১৩ সালে হিমালয়ের কেদারনাথে মেঘভাঙ্গা বৃষ্টি এবং হড়পা বানে যে ধরণের বিপর্যয় হয়েছিল, তারমধ্যে মানবসৃষ্ট কারণও ছিল৷ যেমন কেদারনাথ এলাকায় যে ধরণের নির্মাণ কাজ হয়েছিল, সেটা ঐসব এলাকার উপযুক্ত ছিল না৷ কেরালাতেও জনসংখ্যা বাড়ার ফলে জমির ব্যবহার সেভাবে হয়নি৷ বনাঞ্চল ধ্বংস করলে তার নেতিবাচক পরিণাম অবশ্যই থাকবে৷ বনাঞ্চল ধ্বংস করলে ভূমিধস হবে৷ বৃষ্টির জল গাছপালায় না পড়ে সোজা পড়বে মাটিতে৷ বন্যার জলের তোড় লোকালয়ে ঢুকে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত করে, ডয়চে ভেলেকে বললেন, পরিবেশ বিজ্ঞানী ডঃ সৌমিত্র মুখোপাধ্যায়৷
কারো কারো মতে, কেরালায় একসঙ্গে চারটি বাঁধের জল একসঙ্গে ছাড়ার ফলে নাবাল এলাকাগুলি দ্রুত জলমগ্ন হয়৷ এটা নাকি তাঁদের মতে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ভুল সিদ্ধান্ত ছিল৷ জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা কর্তৃপক্ষের ত্রুটিপূর্ণ পরিকল্পনাও কম দায়ী নয়৷ সংশ্লিষ্ট ইঞ্জিনিয়ারদের আগেই এটা বোঝা উচিত ছিল৷ দ্বিতীয়ত, আবহাওয়ার পূর্বাভাসকেও যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়নি৷ পশ্চিমী হাওয়া আরবসাগরে উত্তপ্ত হলে আর্দ্রতা বাড়ে বর্ষাকালে৷ গ্রীষ্মপ্রধান দেশগুলির আবহাওয়া পশ্চিমী দেশগুলির মত নয়৷ কলকাতা, মুম্বাই, ঢাকা ও করাচিতে ছয় কোটি লোকের বাস সেখানে বন্যার ক্ষয়ক্ষতি বেসি হওয়াই স্বাভাবিক৷
করণীয় কী?
চলতি বছরের মার্চ মাসে সংসদে পেশ করা জলসম্পদ মন্ত্রণালয়ের এক রিপোর্টে বলা হয়, বর্ষাকালে লাগাতার বৃষ্টি ও বন্যার আশংকা থেকে যায়৷ কাজেই এজন্য উপযুক্ত জলনিকাশি অবকাঠামো জরুরি৷ পরিকল্পনাহীনভাবে জলাধার নির্মাণে বিধিনিষেধ, বন্যা নিয়ন্ত্রণের উপযুক্ত কাঠামো তৈরি করা ইত্যাদি৷
দেশবিদেশ থেকে ত্রাণ সাহায্য আসছে উদার হস্তে৷ কেন্দ্রীয় সরকার ইতিমধ্যেই কেরালার বন্যা দুর্গতদের জন্য ৫০০ কোটি মঞ্জুর করেছে৷ সাহায্যের আর্জি জানিয়েছেন পোপ ফ্রান্সিস৷ উপসাগরীয় দেশগুলিও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে৷ কেরালায় আটকে পড়া ২০০০ বাঙালি শ্রমিকদের ফিরিয়ে আনতে বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করেছে রেল দপ্তর৷