এত প্রাণহানি কি এড়ানো যেতো?
২৫ জুলাই ২০২৪বৃহস্পতিবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ২ জন মারা যান।ফলে এক হিসেবে মৃতের সংখ্যা এখন ২০৩। সাম্প্রতিককালে আর কোনো সহিংসতায় বাংলাদেশে এত প্রাণহানি হয়নি।এই মৃত্যুগুলো এড়ানো কি সম্ভব ছিল না? নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও শিক্ষাবিদদের কেউ কেউ বলছেন, সরকার আগে থেকে ‘আন্তরিক' হলে মৃত্যু কমানো যেতো। নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. সাখাওয়াত হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা যে দাবি করেছিল, সেটা তো শেষ পর্যন্ত মেনে নেওয়া হয়েছে। এটাই যদি শুরুতে উদ্যোগ নিয়ে করা হতো তাহলে তো এত প্রাণহানি হতো না। বরং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ছাত্রলীগকে উস্কানি দিয়ে আন্দোলনকারীদের উপর হামলা না করালে হয়ত পরিস্থিতি এ দিকে যেতো না। ফলে আমি মনে করি, সরকার আন্তরিক হলেই প্রাণহানি কমতো।”
তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিস সিদ্দিক মনে করেন সরকারের আন্তরিকতার অভাব ছিল না৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, "আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে তৃতীয় পক্ষ না ঢুকলে পরিস্থিতি এমন হতো না। এমনকি আহত-নিহতের ঘটনাও ঘটতো না। সরকার তো শুরু থেকেই আন্তরিক ছিল প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আদালতের নির্দেশনা এলে সেভাবেই তারা করবেন। শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনে তৃতীয় পক্ষ ঢুকে যাওয়ার কারণে সংঘাতময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, যে কারণে এত মানুষ আহত-নিহত হয়েছেন। আমি আশা করি, দ্রুতই শিক্ষাঙ্গনগুলো খুলে দেওয়া হবে, শিক্ষার্থীরা ক্লাসে ফিরতে পারবেন। তাদের দাবি তো ইতিমধ্যে বাস্তবায়ন হয়েছে।”
মৃতের সংখ্যা নিয়ে ‘প্রথম আলোর বৃহস্পতিবারের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, "ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় সংঘর্ষে আহত হয়ে চিকিৎসাধীন আরও চারজনের মৃত্যু হয়েছে। বুধবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিনজন ও গত মঙ্গলবার সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একজনের মৃত্যু হয়। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভ ও পরবর্তী সংঘাতে এ নিয়ে ২০১ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেল। মৃত্যুর এই হিসাব কিছু হাসপাতাল, মরদেহ নিয়ে আসা ব্যক্তি ও স্বজনদের সূত্রে পাওয়া। সব হাসপাতালের চিত্র পাওয়া যায়নি।”
এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ১৬ জুলাই (মঙ্গলবার) ৬ জন, ১৮ জুলাই (বৃহস্পতিবার) ৪১, শুক্রবার ৮৪, শনিবার ৩৮, রোববার ২১, সোমবার ৫, মঙ্গলবার ৩ ও বুধবার ৩ জনের মৃত্যু হয়। উল্লেখ্য, গত সোম, মঙ্গল ও বুধবার মৃত্যু চিকিৎসাধীন অবস্থায় হয়েছে। তবে নিহতদের মধ্যে কতজন শিক্ষার্থী, সেটা আলাদা করে বলা হয়নি।
ডয়চে ভেলের পক্ষ থেকে মৃত্যুর সংখ্যা জানতে সরকারি একাধিক দপ্তরে যোগাযোগ করা হলেও কেউই নিশ্চিত কোনো তথ্য জানাতে পারেনি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে মৃত্যুর সংখ্যা জানার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
সংঘর্ষের পর বিদ্যমান পরিস্থিতি নিয়ে বুধবারও বৈঠক করেছেন সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে অংশ নেওয়া একাধিক মন্ত্রী জানিয়েছেন, এই আন্দোলনকে ঘিরে সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনায় যত প্রাণহানি হয়েছে, তার সঠিক সংখ্যা নিরূপণ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় সংশ্লিষ্ট দপ্তর ও সংস্থার মাধ্যমে সারা দেশের এই তথ্য সংগ্রহ করা হবে। এরপরই চূড়ান্ত তালিকা করা হবে।
চার জন সাংবাদিক নিহত, আহত শতাধিক
আন্দোলনে সংবাদের তথ্য সংগ্রহের কাজ করতে গিয়ে রাজধানী ঢাকা, সিলেট ও গাজীপুরে চার জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির তথ্য বলছে, কোটা আন্দোলন শুরু হওয়ার পর থেকে শতাধিক সাংবাদিক আহত হয়েছেন। রাজধানীসহ সারা দেশে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে হামলা, মারধর ও শারীরিকভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তারা। নিহত চার সাংবাদিক হলেন, ঢাকায় মেহেদী হাসান ও তৌহিদ জামান প্রিয়: সিলেটের এ টি এম তুরাব ও গাজীপুরে মো. শাকিল হোসেন।
মেহেদী হাসান ঢাকা টাইমস নামের একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালে সিনিয়র রিপোর্টার ছিলেন। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় যাত্রাবাড়ী থেকে দুজনকে রক্তাক্ত অবস্থায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে আসা হয়। সেখানে চিকিৎসক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর মেহেদী হাসানকে মৃত ঘোষণা করেন। ঢাকার সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়ে শুক্রবার দায়িত্ব পালনের সময় ফ্রিল্যান্স ফটো সাংবাদিক তৌহিদ জামান প্রিয় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। একই দিনে সিলেটে দায়িত্ব পালনের সময় নয়াদিগন্ত পত্রিকার সাংবাদিক এ টি এম তুরাব গুলিবিদ্ধ হন। পরদিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। এছাড়া বৃহস্পতিবার দৈনিক ভোরের আওয়াজ পত্রিকার গাজীপুরের গাছা থানা প্রতিনিধি মো. শাকিল হোসেন দায়িত্ব পালনের সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান।
শিক্ষার্থী কতজন?
আন্দোলনে নিহত শিক্ষার্থীর সংখ্যা নিয়ে কোনো পরিসংখ্যান কোথাও পাওয়া যায়নি। গত কয়েকদিন বাংলাদেশের সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ি নিহত শিক্ষার্থীর সংখ্যা অর্ধশতাধিকের কম নয়। এর বাইরে নিহতদের অধিকাংশ পথচারী। তারা গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন কতজন তার সুনির্দিষ্ট হিসেবও পাওয়া যা্চছে না কোথাও।
গত মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনে প্রাণ হারানো শিক্ষার্থীর সংখ্যা জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, "আন্দোলনে আসলে শিক্ষার্থীদের কতটুকু অংশগ্রহণ ছিল, কোন কোন জায়গায় শিক্ষার্থী ছিল আর শিক্ষার্থীদের পেছনে কারা ছিল, সেটা আগে নিরূপণ করতে হবে।” তিনি আরো বলেন, শিক্ষার্থীর সংখ্যা ধার্য করার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে এবং তার আগেই আমরা একটা অ্যাসেসমেন্ট করছি। আমরা দেখছি কিছুটা আছে তথ্য, কিছুটা অপতথ্য, কিছুটা গুজব। এই তথ্যের বিভ্রাট- সেটাকে ব্যবহার করে জনমনে সার্বক্ষণিক একটা আবেগ-উত্তেজনা বা সেটাকে ব্যবহার করে নাশকতামূলক কাজগুলোর ক্ষেত্রে যে জাস্টিফিকেশন বুঝে-শুনে কিন্তু করা হচ্ছিল...সুতরাং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পরেই কঠিনভাবে নিরূপণ করা সম্ভব হবে যে কারা কারা শিক্ষার্থী ছিলেন, আর কোন কোন প্রতিষ্ঠানের ছিলেন। সেটি কিন্তু এই মুহূর্তে নিরূপণ করা খুবই কঠিন।'' আইনমন্ত্রী আরো বলেন, ‘‘এই ব্যাপারে বিচারবিভাগীয় তদন্ত চলছে। সেটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমরা কোনো কথা বলবো না।”
মানবাধিকার সংগঠনগুলোও আহত-নিহতদের সংখ্যা নিরূপণের চেষ্টা করছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক ফারুক ফয়সাল ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আমরা কাজ শুরু করেছি। পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য যেমন নেওয়া হচ্ছে, তেমনি আমাদের কর্মীরা হাসপাতালে গিয়েও তথ্য সংগ্রহ করছেন। এখন পর্যন্ত আমরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে যে তথ্য পেয়েছি, সেখানে ৮৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। তবে এর মধ্যে শিক্ষার্থী কতজন সেটা নিশ্চিত হতে আরো একটু সময় লাগবে। তবে যে ধরনের তথ্য পাচ্ছি, তাতে নিশ্চিত করে বলতে পারি মিডিয়ার নিহতের যে তথ্য এসেছে, প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যা এর চেয়েও বেশি হবে।”
হাসপাতালে চিকিৎসাধীন যারা
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার পর্যন্তআহত ২১৭ জন রোগী ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান জানান, "১৫ জুলাই থেকে ২২ জুলাই পর্যন্ত ধারালো অস্ত্র, ছররা গুলি ও গুলির আঘাতে আহত প্রায় এক হাজার ৭১ জন রোগী ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। এই সময়ে অন্তত ৬০ জনের মরদেহ আনা হয়েছে। এছাড়া ১৯ জন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন।”
অর্থোপেডিক অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন হাসপাতাল (পঙ্গু হাসপাতাল)-এ ১৭ থেকে ২১ জুলাই পর্যন্ত এক হাজার ৩৬৯ জন রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। তাদের বেশিরভাগই গুলি ও ছররা গুলিতে আহত ছিলেন বলে জানান হাসপাতালটির পরিচালক অধ্যাপক ডা. কাজী শামীম উজ্জামান। আহতদের মধ্যে ৫৩৭ জন বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ভর্তি হয়ে চিকিৎসাধীন আছেন। এই পাঁচ দিনের মধ্যে শুক্রবার পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ ছিল বলে জানান হাসপাতাল পরিচালক। তিনি বলেন, "আমাদের সব ডাক্তার ও কর্মীদের সব ছুটি বাতিল করতে হয়েছে। তারা ২৪ ঘণ্টা কাজ করেছেন এবং আমাদের আটটি অপারেশন থিয়েটার ২৪ ঘণ্টাই খোলা রাখতে হয়েছে।”
সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. শফিউর রহমান বলেন, "এই সংঘর্ষে আহত ৫১৮ জন রোগীর চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে এখানে। তাদের মধ্যে ৩০ জনের বড় এবং ১৫০ জনের ছোট অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। গুলিবিদ্ধ রোগীদের পাশাপাশি ১২ জন ব্যক্তিকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালটিতে আনা হয়েছিল।”
জাতীয় চক্ষুবিদ্যা ইনস্টিটিউটে ৩৯৪ জন রোগীর চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে, যাদের বেশিরভাগের চোখে গুলি ও ছররা গুলি লেগেছে। তাদের মধ্যে ১৫৭ জনকে ভর্তি করা হয়েছে বলে হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে। এই হাসপাতালগুলোর বাইরে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়গনস্টিক সেন্টার ও দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে কতজন আহত হয়ে ভর্তি আছেন সে ব্যাপারে নিশ্চিত কোনো তথ্য জানা যায়নি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরও কোনো তথ্য দিতে পারেনি।
এত হতাহতের ঘটনা এড়ানো যেতো কিনা জানতে চাইলে সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক তৌহিদুল হক ডয়চে ভেলেকে বলেন, "অবশ্যই এড়ানো যেতো। শুরুতেই যদি শিক্ষার্থীদের দাবির বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হতো, তাহলেই পরিস্থিতি এদিকে যেতো না। আগেও আমরা দেখেছি, যে কোনো অধিকার আদায়ের আন্দোলনে তৃতীয় পক্ষ বা সরকারবিরোধী পক্ষ ঢুকে পড়ে। তখনই এই ধরনের সংঘাতময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ে। এবারও একই ঘটনা দেখলাম। পরিস্থিতিকে এদিকে যেতে দেওয়া ঠিক হয়নি। সবাই যদি সংযত থেকে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতেন, তাহলে ভালো হতো। দেরিতে হলেও শুভবুদ্ধির উদয় হয়েছে। ফলে আমরা আবারও স্বাভাবিক একটা অবস্থার দিকে দ্রুতই যেতে পারবো বলে আমি আশা করি।”