কোটা সংকটের সমাধান কি আদালতে?
১২ এপ্রিল ২০১৮বাংলাদেশের সংবিধানের ২৮ এবং ২৯ নাম্বার অনুচ্ছেদে প্রজতন্ত্রের কর্মে (সরকারি চাকরি) নিয়োগের সমতা এবং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য কোটার ব্যাপারে রাষ্ট্রকে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে৷ কিন্তু পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য রাষ্ট্র কোটা ব্যবস্থা প্রচলনে বাধ্য কিনা তা সংবিধানে সরাসরি বলা হয়নি৷
সংবিধানের ২৮ অনুচ্ছেদ: ধর্ম, প্রভৃতি কারণে বৈষম্য
(১) কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষ ভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না৷
(২) রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী-পুরুষের সমান অধিকার লাভ করিবেন৷
(৩) কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে জনসাধারণের কোনো বিনোদন বা বিশ্রামের স্থানে প্রবেশের কিংবা কোনো শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে ভর্তির বিষয়ে কোনো নাগরিককে কোনোরূপ অক্ষমতা, বাধ্যবাধকতা, বাধা বা শর্তের অধীন করা যাইবে না৷
(৪) নারী বা শিশুদের অনুকূলে কিংবা নাগরিকদের যে কোনো অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির জন্য বিশেষ বিধান-প্রণয়ন হইতে এই অনুচ্ছেদের কোনো কিছুই রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না৷
সংবিধানের ২৯ অনুচ্ছেদ: সরকারি নিয়োগ-লাভে সুযোগের সমতা
(১) প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ-লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকিবে৷
(২) কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিক প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদলাভের অযোগ্য হইবেন না কিংবা সেই ক্ষেত্রে তাঁহার প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা যাইবে না৷
(৩) এই অনুচ্ছেদের কোনো কিছুই-
(ক) নাগরিকদের যে কোনো অনগ্রসর অংশ যাহাতে প্রজাতন্ত্রের কর্মে উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব লাভ করিতে পারেন, সেই উদ্দেশ্যে তাঁহাদের অনুকূলে বিশেষ বিধান-প্রণয়ন করা হইতে,
(খ) কোনো ধর্মীয় বা উপ-সম্প্রদায়গত প্রতিষ্ঠানে উক্ত ধর্মাবলম্বী বা উপ-সম্প্রদায়ভুক্ত ব্যক্তিদের জন্য নিয়োগ সংরক্ষণের বিধান-সংবলিত যে কোনো আইন কার্যকর করা হইতে,
(গ) যে শ্রেণির কর্মের বিশেষ প্রকৃতির জন্য তাহা নারী বা পুরুষের পক্ষে অনুপযোগী বিবেচিত হয়, সেইরূপ যে কোনো শ্রেণির নিয়োগ বা পদ যথাক্রমে পুরুষ বা নারীর জন্য সংরক্ষণ করা হইতে, রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না৷
সংবিধানের এই দু'টি অনুচ্ছেদ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে যেমন সরকারি চাকরিতে নিয়োগের সুযোগের সমতার কথা বলা হয়েছে (২৯-১)৷ তেমনি পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য কোটা সংরক্ষণকে প্রটেকশন বা বৈধতা দেয়া হয়েছে (২৮-৪ এবং ২৯-৩)৷ তবে সংবিধানে সরাসরি কোথাও বলা নাই যে, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে রাষ্ট্র কোটা সুবিধা দিতে বাধ্য৷
বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে নিয়োগে এখন মুক্তিযোদ্ধা ৩০, জেলা ১০, নারী ১০ এবং উপজাতি কোটা ৫ শতাংশ৷ এই ৫৫ শতাংশ কোটায় পূরণযোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে সেক্ষেত্রে এক শতাংশ পদে প্রতিবন্ধী নিয়োগের বিধান রয়েছে, যা পুরোপুরি বাতিল হবে বলে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন৷ আর জনপ্রশাসন সচিব ড. মোজাম্মেল হক খান জানিয়েছেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিলেই প্রজ্ঞাপন জারি হবে৷ তখন আর কোনো কোটা থাকবে না৷''
সংবিধান বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. শাহদীন মালিক ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এটা একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতি৷ আমাদের আইনের ইতিহাসে অতীতে এরকম কখনো হয় নাই৷ কোটা বাড়তে বাড়তে ৫৬ ভাগ হলো৷ সেখান থেকে হঠাৎ করে শূন্য হয়ে গেল৷ বিষয়টি এক কথায় ব্যাখ্যা করা ডিফিকাল্ট৷ কিন্তু আমাদের সংবিধানের যে মূল চেতনা, সাম্যতা বা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে বিশেষ সুবিধা দেয়া যাবে, যাতে তাঁরা অন্য সবার সমান কাতারে আসতে পারে৷ ন্যায্যতা, ন্যায়পরায়ণতা এগুলো যে সাংবিধানিক ধারণা তার আলোকে আমরা মনে হয় কোটা শূন্যতে নামিয়ে আনা খুবই অস্বাভাবিক হবে৷ আমরা সমতা ও ন্যায্যতার সাংবিধানিক ধারণা থেকে দূরে সরে যাবো৷ এটা মেটেই কাম্য না৷''
কোটার কি কোনো বাধ্যবাধকতা আছে? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘বিশেষ সুবিধা পাওয়া পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর অধিকার৷ তাই এটার ব্যাখ্যা কী হবে, শূণ্য করা যাবে কিনা তা আদালতই বলতে পারবে৷ কারণ, সংবিধানেতো আর সব কিছু বলা থাকে না৷ আমার ধারণা, কেউ যদি আদালতে যান, তাহলে আদালত কোটাশূণ্যতার বিপক্ষে রায় দেবেন৷ শূণ্যতা একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতি৷ আমাদের আশেপাশে দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশে অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ কোটা ব্যবস্থা আছে৷ গণতান্ত্রিক দেশে এটা থাকে৷ যেমন ধরুন, জার্মানিতে আমরা বঙালি মুসলমানরা যদি যায় এবং যদি নাগরিকত্ব পায়, তাহলে জার্মানদের তুলনায় পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী হিসেবে বিশেষ সুবিধা চাইবে, অন্যান্য জার্মানদের সমকাতারে আসার জন্য৷ এটা সারা দুনিয়ায় স্বীকৃত৷ তাই কোটাশূণ্য করা অস্বাভাবিক৷''
সংবিধানে কোটার জন্য রাষ্ট্রকে যে প্রটেকশন দেয়া হয়েছে তা কোটা রাখার বাধ্যবাধকতা কিনা জানতে চাইলে ড. শাহদীন মালিক বলেন, ‘‘সংবিধানে তো সব সময় সবকিছু লেখা বা বলা থাকে না৷ যেমন, ২০১১ সালের আগে আমাদের সংবিধানে ‘পরিবেশ' শব্দটিই ছিল না৷ কিন্তু পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য তো অনেক মামলা হয়েছে৷ শা্ব্দিক অর্থে সব সময় সংবিধান পড়া যায় না৷ বলা হয়েছে, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য কোটা করলে সংবিধানের কোনো বিধান তার জন্য বাধা হবে না৷ কিন্তু এটার পেছনে যে ন্যায়পরায়নতা , ন্যায্যতা , সমতা, কোনো জনগোষ্ঠীকে পিছিয়ে রাখা যাবে না৷ এগুলোর আলোকে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার ব্যাখ্যা আসতে পারে৷ ব্যাখ্যা আসতে পারে যে, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে কোটা সুবিধা দিতে হবে৷ তবে সেই ব্যাখ্যা আদালত দেবেন৷''
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক এবং মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমাদের সংবিধানে যা আছে, তা ব্যাখ্যাসাপেক্ষ৷ কিন্তু আমাদের সংবিধানের স্পিরিট হলো অনগ্রসর শ্রেণিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া৷ তাঁদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রাখা৷ তাই কোটা পুরো বাতিল নয়,কোটা সংস্কারই যৌক্তিক৷ আর প্রধানমন্ত্রী কিন্তু ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রাখার কথা বলেছেন৷'' আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘মুক্তিযোদ্ধাদের আমরা সম্মান জানাবো, এটাই স্বাভাবিক৷ আর সেই সম্মানের জয়াগা থেকেই কোটা৷ কিন্তু সেটা কতদিন এবং কোন পর্যন্ত পাবেন, কী পরিমান পাবেন তা যৌক্তিক হওয়া প্রয়োজন৷''
এদিকে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কমান্ড কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি মেহেদি হাসান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রী ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও প্রতিবন্ধীদের জন্য আলাদা ব্যবস্থার কথা বললেও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কিছু বলেননি৷ আমরাও কোনো মন্তব্য করতে চাই না৷ তবে এখন মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের অপমান, অপদস্থ করা হচ্ছে৷ আমরা আমাদের সম্মান রক্ষায় আন্দোলনে যাবো৷''
এদিকে আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান কেন্দ্রীয় কমিটি এক বিবৃতিতে স্পেশাল নিয়োগের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের চাকরি দেয়ার দাবি জানিয়েছে৷ পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাভিত্তিক প্রশাসন গড়ার স্বার্থে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বহাল রাখার আহ্বানও জানিয়েছেন তাঁরা৷