কোন পথে এগোচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি?
২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭ইদানিং পশ্চিমবঙ্গের ভেতরে ও বাইরে বেশ গুঞ্জন শুরু হয়েছে৷ পাড়ায় চা-য়ের দোকান থেকে মোড়ের ক্লাবের আড্ডায় আলোচনার বিষয় রাজ্য রাজনীতি৷ রাজনীতি-প্রিয় বাঙালির কাছে অবশ্য এটা নতুন কিছু নয়৷ প্রশ্ন উঠছে, গত ছয় বছর ধরে শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসকে বিচলিত করে মাঝপথে কেউ সরিয়ে দিতে পারে? স্বাভাবিকভাবেই ভিন্ন মত উঠে আসছে৷ এ ব্যাপারে ভারতীয় জনতা পার্টি বেশ কিছুদিন ধরেই চেষ্টা চালাচ্ছে৷ কিন্তু, দলের শুভাকাঙ্খী থেকে সাধারণ পশ্চিমবঙ্গবাসীর মনে কেন বদ্ধমূল ধারণা যে, বিজেপি বিরোধী দল হয়ে উঠতে পারেনি৷ বিশেষত এই দলের রাজ্য নেতাদের তেমন একটা ‘ফেস-ভ্যালু’ নেই৷
এই খামতি নিয়ে তৃণমূলের মতো শক্তিকে উৎখাত করা কতটা সম্ভব, তা নিয়ে বিস্তর তর্ক-বিতর্ক বাংলার আকাশে-বাতাসে ঘোরাফেরা করছে৷ বিজেপি চাইছে কয়েকজন ‘পরীক্ষিত-নেতা’৷ সেই নেতারা যে কুমোরটুলি থেকে আসবেন না, তা বিলক্ষণ জানেন বিজেপি-র কেন্দ্রীয় নেতারা৷ এমন নেতাকে তুলে আনতে হবে প্রকৃত তৃণমূলবিরোধী অথবা সদ্য তৃণমূলবিরোধী শিবির থেকে৷ এক্ষেত্রে চাহিদা-যোগানের তত্ত্ব অনুযায়ী রাজ্যে উপযুক্ত কিছু ‘হেভিওয়েট’ মুখ ইতিমধ্যেই তৈরি আছেন৷ বঙ্গ-রাজনীতিতে এখনও প্রভাব-প্রতিপত্তি আছে, এমন একাধিক নেতা রয়েছেন, যাঁরা নিজ দলেই এখন একটু বিব্রতকর অবস্থায় আছেন৷
এরসঙ্গে যুক্ত হয়েছে দুর্গাপুজোয় প্রতিমা বিসর্জনের ইস্যু৷ মমতার সরকার একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করে বলেছে, একাদশীর দিন মুসলিম সম্প্রদায়ের মহরম৷ তাই ওইদিন বিসর্জন করা চলবে না৷ ধর্মীয় ইস্যু পেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে বিজেপি৷ কলকাতা হাইকোর্ট রাজ্যের এই বিজ্ঞপ্তির নিন্দা করে মহরমের দিনেই বিসর্জনের নির্দেশ দিয়েছে৷ সোশ্যাল মিডিয়ায় মমতার নিন্দা করছেন অনেকেই৷ বলা হচ্ছে, ভোট বাক্সের স্বার্থে মুসলিম তোষণ করছেন তিনি৷ প্রকাশ্যে মুখ না খুললেও অনেকেই এর নিন্দা করেছেন৷
এমনিতেই তৃণমূলের হাল খুব একটা ভালো ঠেকছে না৷ একাধিক ‘কাণ্ডে’ জর্জরিত দলটি৷ তৃণমূল যে স্বস্তিতে নেই তা বোঝা গেছে গত ৪ সেপ্টেম্বরের কোর-কমিটির বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রীর ভাষণে৷ তিনি সেখানে বলেছিলেন, ‘‘যারা দল ছেড়ে দিতে চান, যেতে পারেন৷ একসঙ্গে দু' দিকে থাকা যাবে না৷’’ অনেকের ব্যাখ্যা, এই কথাগুলো নাকি নেত্রী বলেছেন মুকুল রায়কে৷
আর সহ্য হচ্ছিল না৷ শেষমেশ দল ছাড়লেন একদা তৃণমূলের ‘সেকেন্ড-ইন-কমান্ড’ রাজ্যসভার সাংসদ মুকুল রায়৷ দু-বছর আগে সারদা মামলায় ফেঁসে দলের সঙ্গে দূরত্ব প্রকাশ্যে এসেছিল তাঁর৷ এবার ‘নারদ’ মর্তে নেমেছেন৷ নারদ নামের ঘুষ কেলেঙ্কারিতে ফেঁসেছেন তিনিসহ তৃণমূলের ডজন খানেক নেতা, মন্ত্রী৷ মুকুল রায় বিজেপি-র সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছেন৷
এই বিষয়ে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ তথা রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সব্যসাচী বসু রায়চৌধুরি মনে করছেন, তৃণমূল বেকায়দায় পড়েছে বলেই খুব সহজে বিরোধীরা জায়গা দখল করে নিতে পারবে, বাংলায় এমন রাজনৈতিক পরিস্থিতি মোটেও নেই৷ ২০২১ সালে পরবর্তী বিধানসভা নির্বাচন৷ তখন কী হবে সেটা পরের কথা৷ আপাতত ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনেও বিজেপি দুম করে অত্যন্ত ভালো ফল করে ফেলতে পারবে না৷ বিষয়টা অত্যন্ত কঠিন৷ এর অন্যতম কারণ হলো, মমতা বন্দ্যোপাদ্যায় সরকারের বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক প্রকল্পে গ্রামাঞ্চলের উপকৃত বহু মানুষ মমতার সঙ্গেই রয়েছেন৷
এদিকে, প্রদেশ কংগ্রেসের অবস্থা মোটেই ভালো নয়৷ জাহাজ ডুবছে বুঝতে পেরে অনেকেই প্রলোভনে কংগ্রেস ছাড়ছেন৷ এরমধ্যে জাতীয় বাধ্যবাধকতার কারণে ‘অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটি’ প্রতিদিনই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সখ্য বাড়াচ্ছে৷ সেইসঙ্গে মমতাও প্রদেশ কংগ্রেসকে তোয়াক্কা না করে সরাসরি যোগাযোগ রাখছেন সোনিয়া-রাহুল গান্ধীদের সঙ্গে৷ স্বভাবতই প্রদেশ কংগ্রেস হতাশ৷
তবে, তৃণমূল, কংগ্রেস, বিজেপির চেয়েও অবস্থা খারাপ সিপিএমের৷ ক্ষয়িষ্ণু সংগঠন৷ নিচের তলা থেকে দলে দলে কর্মীরা যোগ দিচ্ছে তৃণমূলে৷ একটা অংশ আবার নীতি, আদর্শকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সোজা গেরুয়া শিবিরে নাম লেখাচ্ছে৷ তার মধ্যে এখন ‘গোদের উপর বিষফোঁড়া’, যার নাম ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়৷ দলেরই রাজ্য কমিটির একটি অংশ খুঁচিয়ে ঘা করেছে৷ রাজ্যসভার এই সাংসদকে দল থেকে বহিস্কার করেছে সিপিএম৷ সবমিলিয়ে সিপিএমের স্বাস্থ্য ভালো নয়৷
মুকুল রায় এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে সব চেয়ে মার্জিনালাইজড৷ কিন্তু, সবথেকে প্রতিভাধরও বটে৷ অনিল বিশ্বাসের মৃত্যুর পরে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে চাণক্যের অভাব অনেকটাই মিটিয়ে এসেছেন তিনি৷ তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, তৃণমূল দলটিকে তিনি চেনেন নিজের হাতের তালুর মতো৷ এই দল মুকুল রায়ের হাতে তৈরি৷ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জনপ্রিয়তাকে ভোটবাক্স অবধি টেনে নিয়ে যাওয়ার কাজটা মুকুল করেছিলেন৷ তাঁর সমর্থকদের বক্তব্য, দলের কঠিন সময় থেকে মুকুল সংগঠন সামলেছেন৷ এখন যারা নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছেন, তারা কর্মীদের মন বুঝছেন না৷ পরে আসা কিছু নেতা আর নেত্রীকে ঘিরে থাকা কিছু আমলা সব নিয়ন্ত্রণ করছেন৷ তাই এই ডামাডোল৷
বিজেপিও ঠিক এমনই চাইছে৷ মুকুল রায়দের মতো হাই-প্রোফাইল নেতাদের দলে না এনে, মুকুলের দলকে সমর্থন করা ও আসন সমঝোতা করাই বিজেপির এ মুহূর্তের কৌশল৷ এতে নিজেদের দলীয় প্রার্থীদের ভোট বাড়িয়ে নিতেও সক্ষম হবে বিজেপি৷ বিজয়বর্গীও এই ফরমূলায় রাজি৷ দিল্লিতে বিজেপি’র হেভিওয়েট নেতাদের মুকুলের এই অবস্থানের কথা জানিয়েও দিয়েছেন বিজয়বর্গীয়৷ দিল্লি থেকে বিজেপির সবুজ সংকেত মেলার কথা মুকুলকেও জানিয়ে দেওয়া হয়েছে৷ তাই মুকুল রায়ের তৃণমূল-ত্যাগের আনুষ্ঠানিক ঘোষণার অপেক্ষাতেই রয়েছেন এ রাজ্যের আদি তৃণমূলিরা৷ তৃণমূলের উল্টোরথ এখন সময়ের অপেক্ষা৷
তৃণমূলের একাংশের মতে, সংগঠনে টান এবং প্রাণ, দুটোই চলে গেছে৷ এখন বিভিন্ন ভাতার টাকা আর পুলিশ, এই দিয়ে দল চলছে৷ এর একটা বন্ধ হলেই তৃণমূলের ভিত নড়ে যাবে৷ জেলায় জেলায় বসে যাওয়া বা বিক্ষুব্ধ কর্মীরা মুকুলের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছেন৷ বহু নেতা, জনপ্রতিনিধিও আছেন৷ মুকুল ‘জাতীয়তাবাদী তৃণমূল কংগ্রেস’ নিয়ে মাঠে নামবেন৷ জোট হবে বিজেপির সঙ্গে৷ এতে সংখ্যালঘু, বাম, কংগ্রেস এবং তৃণমূলের বহু ভোট মুকুল টানবেন৷ এটা সরাসরি বিজেপি পেত না৷ সঙ্গে যোগ হবে বিজেপির ভোট৷ এর সম্ভাবনা বেশি৷ অথবা সরাসরি বিজেপিতে যোগ৷
তবে, কোন পথে এগোবে বাংলার রাজনীতি? নতুন দল গড়ে উঠবে?
১৯৯৮ সালের পর বাংলায় তৃণমূল ছাড়া আর নতুন কোনো দল সেভাবে তৈরি হয়নি৷ সাম্প্রতিক কালে তপন ঘোষের ‘হিন্দু সংহতি’ অরাজনৈতিক সংগঠন হিসেবেই পশ্চিমবঙ্গে বেশ বিস্তার লাভ করেছে, এবং এই সংগঠনের সঙ্গে তৃণমূলের প্রকাশ্য ও গোপন আঁতাতের নানা ইঙ্গিত মিলেছে৷ বলা হচ্ছে, রাজ্যে ক্রমশই বাড়তে থাকা বিজেপির ভোটবাক্সে ভাঙন ধরানোর জন্যই এই ‘স্ট্র্যাটেজি’ নিচ্ছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ তাই ধরে নেয়া যায়, পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির আকাশে আপাতত আরও কয়েকবছর জ্বলজ্বল করবেন মমতা৷
প্রিয় পাঠক, আপনি কিছু বলতে চাইলে লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে...