কোন পথে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক?
৬ ডিসেম্বর ২০১৮খুব বেশিদিন আগের কথা নয়, যখন অভিবাবকরা নিজ সন্তানকে স্কুল শিক্ষকদের হাতে তুলে দিয়ে বলতেন, ‘‘মাস্টার সাহেব এর হাড্ডিগুলো শুধু ফেরত দেবেন, বাকি সবই আপনার৷'' অভিবাবকরা এমনটি বলতেন বটে, তবে শিক্ষকরা খুব কম ক্ষেত্রেই নির্দয়ভাবে শুধু পেটাতেন৷ বরং একটি শ্রদ্ধা ও প্রজ্ঞার জায়্গা ছিল, যেখান থেকে সবাই বেশ আরামেই বের হয়ে এসেছেন৷ এখনকার সমাজে যাঁরা প্রতিষ্ঠিত, তাঁরা বেশ গাল ভরেই নিজেদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষাব্যবস্থা এবং সমসাময়িক পরিবেশ নিয়ে কথা বলেন৷ অন্যদিকে শিক্ষকদের অপমানিত হওয়ার ঘটনাও বাড়ছে৷ শিক্ষকরাও অপদস্থ হন, তাঁদেরও সীমাবদ্ধতা থাকে৷ আবার তাঁদের বাড়াবাড়ির জন্য ছাত্রজীবন দুর্বিষহ হয়েছে এমন নজিরও সামনে আছে৷ সব মিলিয়ে আমাদের সেই পুরানো প্রবাদের হাত ধরেই হাঁটতে হবে যে, ‘‘যায় দিন ভালো আসে দিন খারাপ৷''
তবে খারাপ দিনগুলো যাদের জন্য আমরা রেখে যাচ্ছি, তারা আমাদের ভবিষ্যৎ এবং অনুজ৷ তাই তাদের যেকোনো অসামঞ্জস্যপূর্ণ ভবিষ্যতের দায় আমরা এড়াতে পারি না৷ অরিত্রীদের আত্মহত্যায় কয়েকটি জিনিস সামনে আসে৷ শিক্ষাজীবনের উন্মত্ত প্রতিযোগিতা, শিক্ষকজীবনের চাপ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জবাবদিহিতা এবং একটি শিশুর সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার পরিবেশ৷
উপরের সবকয়টি বিষয়ই এই মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ৷ কোনোটিই এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই৷
৩০ বছর আগের বাংলাদেশের কথা চিন্তা করলেই দেখা যায়, শিক্ষকরা স্কুলে যেমন আমাদের শিক্ষক ছিলেন, গেটের বাইরে তিনি আবার আমাদের প্রতিবেশী হয়েই থাকতেন৷ স্কুলের বাইরে হৃদ্যতা তৈরির একটা সুযোগ থেকেই যেতো৷ এমনও গল্প আমরা করি যে, অমুক শিক্ষক না থাকলে আমি পাস করতাম না৷ চলতিপথে শিক্ষক আমায় শুধরে দিয়েছেন৷ আমিও শ্রদ্ধায় নুয়ে পড়ার একটি সুযোগ পেয়েছি৷ কিন্তু যখন থেকে স্কুলগুলোতে তুমুল প্রতিযোগিতা, অভিবাবকদের দৌরাত্ম এবং কোচিং বাণিজ্য মাথাচাড়া দিয়েছে, তখন থেকে ‘শিক্ষক' শব্দটি শিক্ষার্থীদের জন্য চারদেওয়ালে সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে৷ এখন তো আমাদের শিক্ষক শ্যামলকান্তিদের কানে ধরা ও পায়ে পড়ার দৃ্শ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চর্চার বিষয় হয়ে যায়৷ শিক্ষক জেলে যায়, কিন্তু শ্যামলকান্তিকে অপমান করা ব্যক্তিদের কিছুই হয় না৷
ধরে নেই অরিত্রী হত্যার দায় শুধুই ভিকারুননিস নূন স্কুলের শিক্ষকদের৷ কিন্তু সেই শিক্ষকদের যখন অপদস্থ করা হলো, খোলা মাঠে গায়ে হাত দিলেন হাজার অভিবাবক, তখন নিজের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ সম্মানিত ব্যক্তির হাতজোড় করা মলিন মুখটি দেখে কি একজন শিক্ষার্থীর বুকও কেঁপে ওঠেনি?
সংকটের শুরু আসলে গোড়া থেকে৷ ভালো স্কুলে ভর্তি হতে হবে, ভালো ফল করতে হবে, এসব চাপে শিশুর কোমল বিকাশ নষ্ট হচ্ছে৷ একই চাপ একজন শিক্ষককে একটি সিস্টেমের মধ্যে পড়ে সামলাতে হচ্ছে৷ শিশুকে যেমন খাতায় লেখার জন্য লিখতে হচ্ছে, তেমনি শিক্ষককে খাতাটি দেখার চাপ নিয়ে সময় কাটাতে হচ্ছে৷ শিশুরা ফল খারাপ করলে জবাবদিহি করতে হয় অভিবাবককে, তেমনি কোনো শিক্ষকের ক্লাসে কতজন শিক্ষার্থী পাস করেনি গভর্নিংবডিসহ স্কুল কর্তৃ্পক্ষকে সেই জবাবও দিতে হ্য় একজন শিক্ষককে৷ একজন শিক্ষককে একজন শিক্ষার্থীর চেয়ে একটি চাপ বেশি নিতে হয়৷ সেটি হচ্ছে সংসার চালানোর চাপ৷ আবার শিক্ষাবোর্ডের চাপিয়ে দেওয়া শতভাগ পাশ, শতভাগ উপস্থিতি কিংবা ১২ মাসে ১৩ পার্বনের আয়োজনের মতো আবদার সামলাতে গিয়ে স্কুল কর্তৃ্পক্ষও খাবি খান৷ উপরন্তু থাকে গভর্নিংবডি ও অভিবাবক পরিষদের সার্বক্ষণিক চোখ রাঙানি৷
একটু খেয়াল করলেই দেখা যায়, বাংলাদেশের মতো উন্নয়্নশীল দেশে শখে বা ভালোলাগা থেকে শিক্ষকতা করছেন এমন বাস্তবতা এখন আর নেই৷ পেশা নির্বাচনের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে অনেকে নিতান্তই কিছু করার না থাকলেই শিক্ষকতায় চলে আসেন৷ আবার অনেকে টিউশনি করে বাড়তি আয় করে দ্রুত ধনী হয়ে যাবার লোভেও আসেন৷ ভালো স্কুলে ছাত্র ভর্তি করাতে যেমন লাখ টাকা অনুদানের নামে ঘুষ দিতে হয়, তেমনি শিক্ষকতার চাকরিতেও ঘুষ দিয়ে ঢুকতে হয়৷ তাই এই মুহূর্তে নিজের জমি বিক্রির টাকা দিয়ে শিক্ষক হয়েছেন তিনি সেই টাকা ওঠাবেন, না একজন ছাত্রের প্রতি মানবিক হবেন, সেটিও ভেবে দেখার বিষয়৷ অন্যদিকে অভিবাবকরা যখন ছাত্রের মাথায় ঢুকিয়ে দেন যে, ‘‘আমি এত টাকা খরচ করছি তোমার পেছনে, তাই তোমাকে ভালো রেজাল্ট করতেই হবে'', তখন চোখের সামনের শিক্ষকের সঙ্গে তারও কোনো মানবিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে না৷
তাই পুরো প্রক্রিয়াটি কফি বানানোর ভেন্ডিং মেশিনের মতো হয়ে উঠেছে৷ একপাশ দিয়ে দুধ-চিনি-কফি দিয়ে অন্যপাশ দিয়ে রেডিমেড কফি ডেলিভারি নেওয়ার মতো৷ যন্ত্রের সঙ্গে সম্পর্কের দায় থাকে না, তাই শিক্ষক অপদস্থ হলে আমরা খুব একটা কেঁপে উঠি না, অরিত্রী মারা গেলে অনেক শিক্ষকই হয়ত বিচলিত হন না৷ পারিপার্শ্বিক চাপ আমাদেরই নিষ্ঠুর করে তুলছে৷ এর শেষ কোথায়?