স্কুলের ব্যাগটা বড্ড ভারী
৩০ নভেম্বর ২০১৮স্কুলের ব্যাগটা বড্ড ভারী, আমরা কি আর বইতে পারি, এ-ও কি একটা শাস্তি নয়? কষ্ট হয়, কষ্ট হয়! সেই কবেই, ১৯৯৬ সালে গান লিখেছিলেন নগর কবিয়াল সুমন চট্টোপাধ্যায়৷ সেই গান বহুল জনপ্রিয় হয়েছিল৷ কিন্তু পড়ুয়াদের বইয়ের বোঝা কমানোর সেই বার্তা কি আদৌ পৌঁছেছিল ঠিক জায়গায়? স্কুল কর্তৃপক্ষ বা সরকারের টনক নড়েছিল কি? আজকের তারিখেও রাস্তাঘাটে স্কুলের বাচ্চাদের ভারী ব্যাগ পিঠে নিয়ে যেতে দেখলে উত্তরটা পাওয়া যায়৷ সেই ভুলে থাকা প্রসঙ্গে অবশেষে এলো কেন্দ্রীয় সরকারি নির্দেশিকা৷ সবক'টি রাজ্য সরকারকে জানানো হলো, স্কুলব্যাগের ওজন কমাতেই হবে৷ তার জন্য বেশ কিছু সুনির্দিষ্ট সুপারিশও করা হলো৷ যেমন, স্কুলের প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে হোমওয়ার্ক তুলে দিতে হবে,যাতে সেই বাড়ির কাজের খাতা প্রতিদিন স্কুলে বয়ে আনার ঝঞ্ঝাটই না থাকে৷ পরের দিন কোন কোন বিষয়ের বই আনতে হবে, রোজ সেটা ক্লাসের ব্ল্যাকবোর্ডে পরিষ্কার করে লিখে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হলো শিক্ষক-শিক্ষিকাদের৷
কিন্তু এতদিন পর, এই সামান্য কিছু ব্যবস্থা নেওয়া কি আদৌ যথেষ্ট হলো? বিশেষত যেখানে আধুনিক প্রযুক্তি এক বড় সহায়ক হয়ে উঠেছে? যার ভরসায় প্রথাগত শিক্ষাপদ্ধতির বাইরে গিয়ে তথাকথিত ‘স্মার্ট ক্লাসরুম’-এর প্রচলনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, সেখানে এই কেন্দ্রীয় সরকারি নির্দেশ কতটা কার্যকর হয়ে উঠবে? এই নির্দেশনামা কতটাই বা বাস্তবমুখী? কলকাতার এক নামী এবং বড় স্কুলের জুনিয়র বিভাগে পড়ান তমালী ঘোষ৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বললেন, ‘‘এটা অবশ্যই হঠাৎ গা ঝাড়া দিয়ে ওঠার মতো একটা ব্যাপার৷ কিন্তু সেটার জন্য যে পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা, পাঠ্যক্রমের, পড়ানোর পদ্ধতির, পরীক্ষার পরিকল্পনা— (সেসব) ছাড়াই হঠাৎ হোমওয়ার্ক তুলে দেওয়া আর ব্যাগের ওজন কমিয়ে দেওয়া নিতান্তই হাস্যকর৷’’ একেবারে বাস্তবিক দিকগুলো বিচার করে বলেছেন তমালী, আজ যদি ছাত্র, বা ছাত্রীরা চারটে বই নিয়ে স্কুলে যায়, তা হলে তার সিলেবাসটা কীভাবে শেষ হবে, সে দায়িত্বটা কিন্তু শিক্ষক, শিক্ষিকাদের৷ এবার তাঁরা যে সিলেবাস অনুসরণ করছেন, সেটা উচ্চতর পর্যায় থেকে স্থির করে দেওয়া হয়েছে৷ সেই জায়গায় পরিবর্তন না করে, হঠাৎ বই-খাতাপত্র কমিয়ে দেওয়া হলো, অথচ পরীক্ষা নেওয়া হবে সেই পুরনো পদ্ধতিতেই, ১০০ নম্বরের, বড় বড় উত্তর লিখতে হবে, এটার কোনো মানেই হয় না৷ কাজেই বদলটা আরো আগে, অন্য জায়গা থেকে হওয়া উচিত৷
‘‘আমাদের শিক্ষাপদ্ধতিটা কিন্তু এখনো মূলত বই এবং খাতাভিত্তিক৷ সেক্ষেত্রে অন্যভাবে শিখবার পথগুলি যদি না খোলে, তা হলে স্কুলেই সবটা হবে, আর পাঠ্যবইটাই একমাত্র মাধ্যম— এটা খুব একটা কাজের বলে মনে হচ্ছে না৷’’ ডয়চে ভেলেকে বললেন কলকাতার আরেক নামী স্কুলের শিক্ষক অংশুমান ভৌমিক৷ তাঁর বক্তব্য, ‘‘যদি টেক্সট বইগুলো স্কুলেই থাকবে, এমন একটা উদ্দেশ্য (হয়, যে) ক্লাস এইট অবধি, আপার প্রাইমারি অবধি বইগুলো স্কুলেই থাকবে, (তা হলে) স্কুলে, প্রতিটা ক্লাসঘরে সেই পরিকাঠামো কিন্তু আমরা এখনো করে উঠতে পারিনি৷ সেটা সরকারি হোক, বা বেসরকারি হোক, খুব উঁচু দরের কিছু বেসরকারি স্কুল বাদ দিলে ক্লাসরুম লাইব্রেরি ব্যবস্থাটা কিন্তু এখনো খুব একটা পাকাপোক্ত নয়!’’
নিজের আরো একটা আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন অংশুমান৷ তাঁর মতে, আমাদের পড়াশোনা চিরকালই বৃত্তমুখী, অর্থাৎ, পড়া শেষ করে তাড়াতাড়ি একটা চাকরি পেতে হবে, এটাই গড় মানসিকতা৷ এ কারণে পাঠ্য বইকে এড়িয়ে গিয়ে নানা ধরনের সাজেশন, মেড ইজির ওপর নির্ভরতা অনেক দিনের৷ বইয়ের ভার কমাতে গিয়ে সেই পাঠ্য বই না শেষে একেবারেই ব্রাত্য হয়ে যায়৷ তবে একটা কথা তমালী ঘোষ বলেছেন, অংশুমান ভৌমিকও বললেন যে, ডিজিটাল শিক্ষাপদ্ধতি, স্মার্ট ক্লাসরুমের ক্ষেত্র বরং আরো সম্প্রসারিত করা উচিত, বইয়ের ওজন সত্যিই যদি কমাতে হয়৷