‘নারী শ্রমিক পাঠানো বন্ধ করা উচিত না’
২৯ নভেম্বর ২০১৯ডয়চে ভেলে: প্রবাসে নারী শ্রমিক পাঠানো ঠিক কবে থেকে শুরু হয়েছিল? মাঝখানে নিষেধাজ্ঞা ছিল৷ এই নিষেধাজ্ঞা আর তা প্রত্যাহারের কারণ কী?
ড. তাসনিম সিদ্দিকী: বাংলাদেশ থেকে আগে নারীদের যাওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না৷ মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার দেশগুলোতে যখন থেকে শ্রমশক্তিতে নারীকরণ হতে থাকে, গৃহের অভ্যন্তরে নারী শ্রমিকের চাহিদা হতে থাকে, ফিলিপাইন্স এবং অন্য দেশগুলো যখন আরেকটু উপরের পর্যায়ে নারী শ্রমিক পাঠাতে শুরু করে, তখন গৃহকর্মে (বাংলাদেশ থেকে) নারী শ্রমিক যাওয়া শুরু হয়৷ সরকারের জানাই ছিল না যে, নারীরা যাচ্ছেন৷ অন্যদিকে এক ধরনের পাচার ব্যাপকভাবে শুরু হয়েছিল ১৯৯৭ থেকে ১৯৯৯ সালের দিকে৷
সেই অবস্থায় নাগরিকসমাজ আন্দোলন শুরু করল৷ কারণ, বৈধভাবে তাদের যেতে না দেওয়ায় পাচারটা ব্যাপকভাবে হচ্ছিল এবং ওখানে গিয়ে তারা শ্রম অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছিলেন, শোষণের শিকার হচ্ছিলেন, তাদেরকে কোনো আইনি ব্যবস্থায় আনা যাচ্ছিল না৷ আমাদের গবেষণা এবং সিভিল সমাজের দাবির মুখে সরকার ২০০৩ সালে নারী শ্রমিক বিদেশে যাওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে৷ এসময় কতগুলো শর্ত জুড়ে দেয় (সরকার)৷ নারী শ্রমিক তখনই যেতে পারবে তার বয়স যখন ২৫-এর উপরে হবে, ছোট বাচ্চা থাকবে না, স্বামী বা বাবার অনুমতি থাকবে৷ এই ধরনের বিষয়গুলো দিয়ে ২০০৩ সালে নারী শ্রমিকের বিদেশে যাওয়া শুরু হয়৷
সৌদি সরকার ২০১৫ সালে বাংলাদেশের পুরুষ শ্রমিক নেয়ার ক্ষেত্রে নারীদের পাঠানোর শর্ত দিয়েছিল৷ এর কারণ কী?
সাত বছর ধরে বাংলাদেশ থেকে পুরুষ শ্রমিক যাওয়ার বিষয়ে সৌদি সরকার নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রাখে৷ এর জন্য মূলত ঐ দেশের একটা চক্র, অন্যান্য দেশ যারা লোক পাঠাতে চায় তাদের রাজনীতি ইত্যাদি দায়ী৷ নারী শ্রমিকের যাওয়াটা কিন্তু তখনও উন্মুক্ত ছিল এবং তারা যাচ্ছিলও৷ ...সেসময় শ্রীলঙ্কা অনেক বেশি নারী শ্রমিক প্রেরণ করত৷ তার আগে করত ফিলিপাইন্স৷ কিন্তু ফিলিপাইন্সের নারী শ্রমিকরা যাওয়া শুরু করে দিলো উন্নত বিশ্বে৷ প্রশিক্ষিত কাজ থেকে শুরু করে বিভিন্ন পেশায় তারা এমনকি সৌদি আরবেও যেতে শুরু করল৷ কিন্তু গৃহকর্মী হিসেবে তাদের যাওয়া কমে গেল৷ তারপর শ্রীলঙ্কা নারীদেরে চেয়ে পুরুষদের যাওয়ার ক্ষেত্রে বেশি উৎসাহ দিলো৷ আমরা পুরুষদের যে বাজারটা হারিয়েছি সেটা শ্রীলঙ্কা নিয়ে নিলো৷
আমাদের যারা রিক্রুটিং এজেন্সি, যারা পুরুষ শ্রমিক পাঠাতে চান এবং যারা শ্রম অভিবাসনের সাথে যুক্ত কর্মকর্তা, তারাই তখন এই সমঝোতাটা করে যে, আমরা নারী শ্রমিক পাঠাবো যদি আমাদের পুরুষ শ্রমিক তোমরা নেও৷ তারাও রাজি হয়৷ শর্ত বেঁধে দেয়ার বদলে আমি বলব আমরাই এটা প্রস্তাব করেছিলাম সেসময়৷
বিভিন্ন সময় সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে নারীরা নির্যাতিত ও লাশ হয়ে ফিরে আসছেন৷ এই বিষয়ে আপনাদের কাছে কোনো পরিসংখ্যান আছে?
বিভিন্ন সময়ে নির্যাতিত হয়ে দূতাবাস, রিক্রুটিং এজেন্সি বা বিএমইটি-এর মাধ্যমে যারা ফিরে এসেছেন, সরকারের তাদের নিয়ে একটি পরিসংখ্যান আছে৷ গত চার বছরের যে হিসাব, তাতে নারী শ্রমিক গেছেন আট লক্ষের মতো৷ অন্যায়, বিভিন্ন নির্যাতনের শিকার হয়ে প্রায় আট হাজারের মতো নারী শ্রমিক ফিরে এসেছেন৷ এদের মধ্যে লাশ হয়ে ফিরে এসেছে ৫৫ বা তার বেশি৷ আত্মহত্যা করেছেন প্রায় ৪০ জন৷
এইরকম পরিস্থিতি কেন তৈরি হলো? আমরা যে প্রক্রিয়ায় নারীদের পাঠাচ্ছি, সেখানে কি কোনো গলদ ছিল?
এখানে দুটি বিষয় আছে৷ এখন মুসানেদ প্রক্রিয়ায় সৌদি আরব লোক নিচ্ছে৷ আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় এই প্রক্রিয়ায় ঝুঁকি কমানোর একটা চেষ্টা রয়েছে৷ মধ্যসত্ত্বভোগী যেকেউ এখানে নারী শ্রমিক পাঠাতে পারবে না৷ মুসানেদ প্রক্রিয়াতেই রিক্রুটিং এজেন্সি থেকে রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে শ্রমিক ঐ দেশে যাবে৷ কিন্তু এর বাইরে বাসায় কাজ করবে এই ধরনের শ্রমিকদের যাওয়ারও একটা সুযোগ রয়েছে৷ সেগুলো অনেক ক্ষেত্রে ফ্রি ভিসা বলে পরিচিত৷ এই ফ্রি ভিসা প্রক্রিয়ার ভিতরে তো অবশ্যই গলদ রয়েছে৷ সেই তুলনায় মুসানেদ প্রক্রিয়া স্বচ্ছ বলে আমরা শুনেছি৷
তারপরও এখান থেকে হয়তো বৈধ প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়েই যাচ্ছেন, কিন্তু যাওয়ার পরে গৃহের অভ্যন্তরে তার কোনো অধিকার নেই৷ পুরোটাই নির্ভর করছে তিনি যে পরিবারে গেছেন তারা কেমন তার উপর৷ পরিবার খারাপ হলে সেখানে শ্রমিক নিগ্রহের ঘটনা ঘটছে৷... সেখানে আইনের শাসন প্রয়োগ করা যাচ্ছে না৷ সেখানে যে শ্রম আইন রয়েছে তার আওতায়ও গৃহকর্মীরা আসেন না৷ তবে সাধারণ যে ক্রিমিনাল প্রসিডিউর রয়েছে, সেখানে গৃহের অভ্যন্তরে যদি নারী শ্রমিকদের উপর কোনো অন্যায় ঘটে, তাহলে প্রতিকারের জন্য আইনি ব্যবস্থায় যাওয়ার সুযোগ রয়েছে৷
এক্ষেত্রে সৌদি আরবে বাংলাদেশ দূতাবাস কতটা ভূমিকা পালন করছে?
নয়টা শর্ত পূরণ করার পর বিএমইটি (জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো) নারীদের যেতে দিচ্ছে৷ কিন্তু ঐখানে যাওয়ার পরে গৃহের অভ্যন্তরে যে নির্যাতন ঘটছে তার উপরে আমরা কোনো নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারছি না৷ আমাদের দূতাবাস সেখানে এমন কোনো ব্যবস্থা দাঁড় করাতে পারেনি যে, ঐখানে যাওয়ার পরে এই নারী শ্রমিকদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ থাকবে৷ বলা হচ্ছে, নারী শ্রমিক সবাই মোবাইল রাখতে পারবে, বিপদ হলে যোগাযোগ করতে পারবে৷ কিন্তু আমাদের একেবারে সাম্প্রতিক উপাত্ত বলছে, যারা বিদেশে গেছেন, তাদের ৪০ ভাগের মতো মোবাইল রাখতে পারছেন৷ সৌদি আরবে এই সংখ্যা আরো কম৷ অন্যদিকে ৯৮ ভাগ পুরুষ শ্রমিকের মোবাইলে এক্সেস আছে৷ মোবাইল থাকলেও আমাদের দূতাবাস এমন কোনো ব্যবস্থা করতে পারেনি যে, প্রতিমাসে যেকজন নারী আছেন তাদের একবার করে ফোন দিয়ে তারা কেমন আছেন খোঁজ নেবেন৷
এক্ষেত্রে সরকারের প্রতিক্রিয়া বা কূটনৈতিক উদ্যোগও কি যথেষ্ট ছিল বলে মনে করেন?
আগে দুই দেশের মধ্যে ‘মেমোরেন্ডাম অব আন্ডারস্ট্যান্ডিং' হতো, এখন সেখানে ‘মেমোরেন্ডাম অব কো-অপারেশন' হয়৷ সৌদি আরব, মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশ কিংবা মালয়েশিয়া এরা ক্রমাগতভাবে শর্তগুলো শিথিল করছে৷ এই জায়গাগুলোতে দ্বিপাক্ষিক সমঝোতাগুলো ক্রমাগত ব্যর্থ হচ্ছে৷ শুধু বাংলাদেশ নয়, অন্য দেশের শ্রমিকরাও এই অবস্থায় পতিত হচ্ছেন৷ এ কারণে আমরা বারবার বলছি, দ্বিপাক্ষিক প্রক্রিয়া ছেড়ে যেসব দেশ শ্রমিক পাঠায়, তারা মিলে বহুপাক্ষিক প্রক্রিয়ায় যাওয়া উচিত৷ একসাথে যদি আমরা সবাই বলতাম, নারী শ্রমিক পাঠাবো না, তখন এই পরিস্থিতির পরিবর্তন হতো৷ দ্বিপাক্ষিকভাবে আপনি বেশিদূর এগোতে পারবেন না, কারণ, সে ধরনের শক্তি, সে ধরনের জোর আমার সরকারের নেই৷
ভুক্তভোগীদের আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার উপায় কী?
নির্যাতন, ধর্ষণের যে ঘটনা তাতে সে দেশের শ্রম আইন ব্যবহার করে নারী শ্রমিকদের প্রাপ্য অধিকার আদায়ে আমরা ভীষণভাবে ব্যর্থ হচ্ছি৷ আমাদের সরকার বলছে, ঐ দেশে যখন একজন নারী নির্যাতিত হয় সে আর তখন থাকতে চায় না, চলে আসে৷ মামলা করতে হলে তাকে থাকতে হবে৷ এই জায়গাটায় আমরা বারবার বলে আসছি দৃষ্টান্তমূলকভাবে ১০টি ঘটনা নিন৷ তাদেরকে বুঝিয়ে শেল্টার হোমে রেখে মামলা করুন৷ এভাবে আমরা যদি বিভিন্ন কেসগুলো চালিয়ে যেতাম তাহলে তারা একটা জবাবদিহিতার মধ্যে আসতো৷
সৌদি আরবে নারী শ্রমিক পাঠানোর বিষয়টি কি এখন পুনর্বিবেচনা করা প্রয়োজন বলে মনে করেন? আপনার পরামর্শ কী?
পুনর্বিবেচনা করার কথা অনেকেই প্রস্তাব করছেন, বন্ধ করে দেয়ার কথা বলছেন অনেকেই৷ আমি জোরের সাথেই বলবো, নারী শ্রমিকদের বাইরে যাওয়ার যে অধিকার, সেটা কোনো অবস্থাতেই আমরা বন্ধ করতে পারবো না, কারণ, যারা ভালো অবস্থায় থেকে তাদের অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন করেছেন, সেটার যে প্রমাণ গ্রামেগঞ্জে রয়ে গেছে, সেটা দেখে আবারও অবৈধ অভিবাসন এবং অবৈধ পথে যাওয়ার প্রবণতা বেড়ে যাবে৷ এখন যেমন রাষ্ট্রীয়ভাবে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে এই সুযোগ থেকেও তারা বঞ্চিত হয়ে যাবেন৷ সুতরাং সরকারকে আমি কোনো অবস্থাতেই নারী শ্রমিকের যাওয়ার বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করতে দেবো না৷ বরং বলব যেকোনো মূল্যে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, বাজেট বরাদ্দ দেয়া তাদের দায়িত্ব৷ যেখানে লোক পাঠাচ্ছেন সেসব এলাকায় শেল্টার হোম খোলা, কোর্টে গিয়ে বিচার চাওয়া থেকে শুরু করে যে ধরনের কাজগুলো করা দরকার, এই জায়গায় এগ্রেসিভলি কাজ করার জন্য আমি তাদেরকে দায়বদ্ধ করতে চাইবো৷
নারীর যাওয়া বন্ধ হোক আমরা চাই কারণ নারীকে আমরা একটা প্রোটেকশন হিসেবে দেখছি৷ আমরা দেখছি নারীকে প্রোটেক্ট করতে হবে৷ কিন্তু একই পরিমাণ হয়রানির শিকার কিন্তু পুরুষ হচ্ছেন৷ বন্দি করে রেখে মুক্তিপণ চাওয়া হচ্ছে, তাদেরকে বেদম প্রহারের মধ্যে রাখা হচ্ছে৷ পুরুষ শ্রমিকদের প্রসঙ্গে আমরা রাগ হই, চিৎকার চেঁচামেচি করি, কিন্তু শ্রমিক প্রেরণ বন্ধ করে দেবো বলি না৷ কিন্তু নারীর বেলায় যে মানসিকতা সেটা এক ধরনের পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা৷ নারীকে তারা প্রোটেকশনের জায়গায় দেখতে চান৷ তার অধিকার যে খর্ব হয় সেটা তারা চিন্তায় আনেন না৷ আমি বলবো, নারী এবং পুরুষ কারো উপরই অন্যায় হতে পারবে না৷
প্রিয় পাঠক, আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷